ঈদের ফিরতি যাত্রা ভয়ংকর

দুর্ঘটনাকবলিত প্রাইভেট কার। গতকাল ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার রামগোপালপুরে। ছবি: সংগৃহীত
দুর্ঘটনাকবলিত প্রাইভেট কার। গতকাল ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার রামগোপালপুরে।  ছবি: সংগৃহীত

ঈদের ফিরতি যাত্রার সময় প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে সড়ক। ঈদের দিন থেকে পরবর্তী এক সপ্তাহ দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি—দুটিই বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়। ঈদের সময় সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনার শিকার হন পথচারীরা। আবার বাস ও মোটরসাইকেলে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে। 

গত ঈদুল ফিতরের আগে-পরের ১৫ দিনের সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি নিয়ে করা এক গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই) গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এই গবেষণা করেছে। 

এআরআইয়ের গবেষণার তথ্য অনুসারে, গত ঈদুল ফিতরে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে ১৭২টি। এসব দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ১৫৪ জন। এর মধ্যে ঈদের আগের সাত দিনে ৫০টি দুর্ঘটনা ঘটে। আর ঈদের দিন থেকে পরের আট দিনে দুর্ঘটনার সংখ্যা ১২২টি। ঈদের আগে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ৭২ জনের। পরের আট দিনে প্রাণ হারান দ্বিগুণ, ১৪৪ জন। এবারের ঈদুল আজহার চিত্রও এমনই। ঈদের ফিরতি যাত্রা শুরু হওয়ার পর গত বৃহস্পতিবার এক দিনেই সড়কে ২৫ জনের প্রাণ ঝরেছে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঈদের আগে যানজটের কারণে সড়ক–মহাসড়কে যানবাহনের গতি কম থাকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতাও বেশি থাকে। এ জন্য যাত্রী পরিবহন বেশি হলেও দুর্ঘটনার হার কম। কিন্তু ঈদের ফিরতি যাত্রায় সড়ক অনেকটাই ফাঁকা থাকার কারণে চালকেরা ইচ্ছেমতো গাড়ির গতি তোলেন। দ্রুত যাত্রী নামিয়ে পুনরায় যাত্রী ধরার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েন। এ ছাড়া দুর্ঘটনার আরেকটি বড় কারণ, চালকের ক্লান্তি। কারণ, ঈদের আগে থেকে একটানা গাড়ি চালান চালকেরা। ফলে তাঁরা বিশ্রামের সুযোগ পান না। চালক-মালিক—দুই পক্ষই বাড়তি আয়ের আশায় ঈদের আগে-পরে ১৫ দিন বিরামহীন বাস চালিয়ে থাকেন।

এআরআইয়ের তথ্য বলছে, ২০১৬ থেকে গত ঈদুল ফিতর পর্যন্ত সাতটি ঈদ উদ্‌যাপিত হয়েছে। এসব ঈদে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১ হাজার ৬১৩ জন। প্রতি ঈদের আগে-পরের সময়টাতে গড়ে প্রাণ হারান ২৩০ জন। অবশ্য যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে, ঈদের আগে-পরের ১৩ দিনে গড়ে ৩০০ মানুষের প্রাণহানি হয়। 

সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সূত্র বলছে, একই সড়কে ছোট, বড়, কম গতির ও বেশি গতির যানবাহন চলে। ফাঁকা সড়কে বেশি গতির যানবাহনগুলো কম গতির যানবাহনকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় অনেক সময় দুর্ঘটনার জন্ম দেয়। মহাসড়কে দূরপাল্লার পথের বাস ঘণ্টায় ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার গতিতে চলে। গড়ে প্রতি এক মিনিট পরপর এসব বাস অন্য যানকে ঝুঁকিপূর্ণভাবে পেরিয়ে যাওয়ার (ওভারটেক) চেষ্টা করে। ফলে গতি ও চালকের বেপরোয়া মনোভাব বন্ধ না হলে দুর্ঘটনা কমানো যাবে না। 

মোটরযান আইন অনুসারে, একজন চালক একটানা পাঁচ ঘণ্টা যানবাহন চালাতে পারেন। এক ঘণ্টা বিরতি দিয়ে দিনে সর্বোচ্চ আট ঘণ্টা চালানোর সুযোগ রয়েছে। কিন্তু চালকের সংকটের কারণে এটা মানা হয় না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছর চালকের বিশ্রাম ও কর্মঘণ্টা মানার বিষয়ে নির্দেশনা দেন। তবে এই নির্দেশনা পরিবহনমালিক-শ্রমিকেরা মানছেন না। 

>ঈদের আগের চেয়ে পরে প্রাণহানি দ্বিগুণ
সাত ঈদে ১ হাজার ৬১৩ জনের মৃত্যু সড়কে
৫৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনার কারণ অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো
৩৭ শতাংশ দুর্ঘটনার কারণ চালকদের বেপরোয়া মনোভাব


১৯৯৮ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে এআরআই একটি গবেষণা করেছে। এই গবেষণার তথ্য বলছে, দেশে ৫৩ শতাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানোর জন্য । আর চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে দুর্ঘটনা ঘটে ৩৭ শতাংশ। পরিবেশ-পরিস্থিতিসহ অন্য কারণে দুর্ঘটনার পরিমাণ ১০ শতাংশ। অর্থাৎ চালকের বেপরোয়া মনোভাব ও গতির কারণে ৯০ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে। 

পুলিশ ও বিআরটিএ সূত্র বলছে, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে বাসের চেয়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশা বেশি চলাচল করে। উত্তরবঙ্গের প্রতিটি মহাসড়কে নছিমন, করিমন ও ভটভটি অবাধে চলছে। সারা দেশেই মোটরসাইকেল বেড়েছে বিপুল পরিমাণে। ২০১০ সালের পর গত সাড়ে আট বছরে দেশে মোটরসাইকেল নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে প্রায় ১৯ লাখ। অথচ বেশির ভাগ মোটরসাইকেল চালকেরই লাইসেন্স নেই। বিআরটিএর হিসাবে, ৫৯ শতাংশ মোটরসাইকেল চালকের লাইসেন্স নেই। 

এআরআইয়ের গবেষক কাজী সাইফুন নেওয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, সড়কে বেপরোয়া গতিই বেশি প্রাণহানির জন্য দায়ী। আর ঈদের পরে বেশি দুর্ঘটনার পেছনে চালকের ক্লান্তি একটা বড় বিষয়। ফেনীতে গত বৃহস্পতিবার গাছের সঙ্গে বাসের ধাক্কায় সাতজনের প্রাণহানির পেছনে চালকের ক্লান্তি কাজ করতে পারে। চালক ঘুমিয়ে না পড়লে এমনটা খুব একটা হয় না। এ ছাড়া ঈদে বাড়তি আয়ের আশায় নগর পরিবহনের অনেক ফিটনেসবিহীন বাস দূরপাল্লায় চলাচল করে। এসব যান কারিগরিভাবে ত্রুটিযুক্ত থাকে এবং চালকও অদক্ষ হয়। এ জন্যই ঈদের সময় প্রাণহানি বেশি।