পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে মোটরসাইকেলের চলাচল আগামী পবিত্র ঈদুল আজহার আগে চালুর সম্ভাবনা কম। ঈদের পরও ঘরমুখী মানুষের ফিরতি যাত্রার চাপ থাকবে। এ অবস্থায় ঈদের পর মোটরসাইকেল চালুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। এ ছাড়া পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেলের টোল বৃদ্ধি করা যায় কি না, তা নিয়েও আলোচনা আছে। সেতু বিভাগ সূত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, পদ্মা সেতু চালুর দুই দিনের মাথায় সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তটি সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে এসেছে। টোল প্লাজায় যানজট এবং সেতুতে দুর্ঘটনা এড়াতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ২৬ জুন রাতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় দুজনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এরপরই মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
পদ্মা সেতু এখন সেতু কর্তৃপক্ষের সম্পদ। এটি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগের অধীন প্রতিষ্ঠান।
সেতু কর্তৃপক্ষের পরিচালক (প্রশাসন) মো. রুপম আনোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাত্র দুই দিন গেল, আর কয়েকটি দিন অপেক্ষা করি। এরপর মোটরসাইকেল চালুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।’
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ঈদের আগে ঘরমুখী মানুষ এবং কোরবানির পশুবাহী যানবাহনের সংখ্যা বাড়বে। ফলে এ সময় মোটরসাইকেল চালু রাখলে যানজট এবং দুর্ঘটনার আশঙ্কা বেড়ে যেতে পারে, যা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে।
ওই সূত্র আরও জানায়, ঈদযাত্রায় ভোগান্তি কমাতে ঈদের আগেই পদ্মা সেতু চালু করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ছাড়া বর্ষায় নদীতে লঞ্চ, নৌকা ও স্পিডবোট দুর্ঘটনা বেড়ে যায়। এখন মোটরসাইকেলের কারণে দুর্ভোগ কিংবা দুর্ঘটনা বেড়ে গেলে এটা ফলাও করে প্রচার হয়, যা চাইছে না সরকার।
সেতু কর্তৃপক্ষের পরিচালক (প্রশাসন) মো. রুপম আনোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাত্র দুই দিন গেল, আর কয়েকটি দিন অপেক্ষা করি। এরপর মোটরসাইকেল চালুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।’
সেতু বিভাগের সূত্র জানায়, টোল আদায়কারী প্রতিষ্ঠান কোরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে করপোরেশন (কেইসি) ও চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির (এমবিইসি) সঙ্গে চুক্তি হয়েছে শেষ মুহূর্তে। এখনো কিছু যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম আসেনি। এ অবস্থায় যানজট কিংবা সেতুর ওপর কোনো সমস্যা তৈরি হলে তা সমাধানের মতো সক্ষমতা তৈরি হয়নি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের। যেমন সরকার পদ্মা সেতুতে যানবাহন চলাচলের ঘণ্টায় সর্বোচ্চ গতিবেগ ঠিক করে দিয়েছে ৬০ কিলোমিটার। কিন্তু যানবাহন এই গতিসীমা মানছে কি না, তা মাপার যন্ত্র নেই। এর জন্য স্পিডগান কিনতে হবে। পুরো সেতু এলাকা সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনার দায়িত্বও টোল আদায়কারী প্রতিষ্ঠানের। কিন্তু সেটা এখনো হয়নি।
সেতুর টোল প্লাজার ছয়টি বুথের মধ্যে একটিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে টোল আদায়ের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এর জন্য যে প্রস্তুতি দরকার, তা করতে ছয় মাস সময় লাগবে বলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে। স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু হলে টোল আদায় আরও দ্রুত হবে। তখন মোটরসাইকেলের জন্য একটি বুথ নির্দিষ্ট করে দেওয়ার পরিকল্পনা আছে। এ পরিস্থিতিতে সেতুতে যানবাহন চলাচলের যে চারটি মূল লেন রয়েছে, এর দুই পাশে (হার্ড শোল্ডার) মোটরসাইকেলের জন্য নির্দিষ্ট করা যায় কি না, তা নিয়েও আলোচনা রয়েছে।
পদ্মা সেতুর গাড়ি চলাচল ও আয়ের পূর্বাভাস তৈরি করা হয়েছে ২০০৫ সালে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সময়। এরপর ২০১০ সালে তা আরেকবার হালনাগাদ করা হয়। এতে মোটরসাইকেলের হিসাব আলাদা করা হয়নি। এগুলোকে হালকা যানবাহন তথা কার-জিপের সঙ্গে মিলিয়ে ধরা হয়েছে। কিন্তু গত কয়েক বছরে রাইড শেয়ারিং ব্যবস্থায় মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহন বেড়ে গেছে। ফলে ব্যক্তিগত মোটরসাইকেল ও রাইড শেয়ারিংয়ের মোটরসাইকেল মিলে সেতুতে চাপ তৈরি করেছে।
টোল আদায়ে যুক্ত একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে প্রথম আলোকে বলেন, অনেক মোটরসাইকেল শুধু এপার-ওপার করছে। তারা যাত্রীর কাছ থেকে ২০০ টাকা করে আদায় করছে। এভাবে ঘোরাঘুরি করে জট বাড়াচ্ছে। আবার ১০০ টাকা টোল দিয়ে একযাত্রায় ৪০০ টাকা ভাড়া আদায় করছে। এভাবে চলতে দিলে আগামী ছয় মাসেও মোটরসাইকেলের এই দাপাদাপি বন্ধ হবে না।
পদ্মা সেতুর টোল আদায় কার্যক্রম তদারক করার জন্য সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তাদের কয়েকটি দল মাওয়া ও জাজিরা টোল প্লাজায় দায়িত্ব পালন করছে। তারা টোল প্লাজায় মোটরসাইকেলের জট, সেতুতে বাড়তি গতিতে চলাচল, হেলমেট ছাড়া চালকসহ তিনজন নিয়ে মোটরসাইকেল চালানোসহ নানা বিষয়ে সেতু কর্তৃপক্ষকে লিখিত ও মৌখিক প্রতিবেদন দিয়েছে। এর ভিত্তিতে একটি বৈঠক করে মোটরসাইকেলের বিষয়ে পরবর্তী করণীয় ঠিক করা হবে বলে সূত্র জানিয়েছে। তবে এই বৈঠক কবে হবে, সেটি এখনো ঠিক হয়নি।
পদ্মা সেতু চালুর পরদিন ২৬ জুন থেকে টোল দিয়ে যানবাহন চলাচল শুরু করে। প্রথম দিনই ৬১ হাজার ৮৫৬টি যানবাহন পারাপার হয়। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশই মোটরসাইকেল বলে জানিয়েছেন সেতু বিভাগের কর্মকর্তারা। প্রথম দিন টোল আদায় হয় পৌনে তিন কোটি টাকার মতো।
২৭ জুন থেকে পদ্মা সেতু দিয়ে মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ করে সেতু বিভাগ। ওই দিন সেতু দিয়ে মোট যানবাহন চলাচল করে ১৫ হাজার ২৭৪টি। অর্থাৎ আগের দিনের তুলনায় যানবাহন পারাপার চার ভাগের এক ভাগে নেমে আসে। এদিন টোল আদায় হয়েছে প্রায় ২ কোটি টাকা।
তবে মোটরসাইকেল এভাবে বন্ধ রাখার বিষয়ে ভিন্নমতও আছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের মধ্যে। সংস্থাটির কর্মকর্তাদের কেউ কেউ বলছেন, সেতু নির্মাণ করা হয়েছে মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নে। এর সর্বোচ্চ ব্যবহার হওয়াই উচিত। এ ছাড়া সেতু কর্তৃপক্ষ স্বায়ত্তশাসিত একটি প্রতিষ্ঠান। সেতু নির্মাণ করা হয়েছে সরকারের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে। তা ফেরত দিতে হবে ৩৫ বছরে। ফলে মোটরসাইকেলের আয় থেকে বঞ্চিত করা ঠিক হবে না।