পদ্মা সেতুর মূল কাঠামো তৈরি হয়েছে ইস্পাত বা স্টিলের স্প্যান দিয়ে। একেকটি স্প্যানের দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার। স্প্যানগুলো আয়তাকার, ধূসর রঙের; দেখতে অনেকটা খাঁচার মতো। পদ্মা নদীর দুই পাড় যুক্ত করতে লেগেছে ৪১টি স্প্যান।
সেতুর পিলারের ওপর স্প্যানগুলো বসানো হয়েছে। আর স্প্যানের ওপরে তৈরি করা হয়েছে যানবাহন চলাচলের পথ। স্প্যানের ভেতর দিয়ে বসছে রেলপথ। আগামী মাসে রেললাইন বসানোর কাজ শুরু হবে।
অন্যান্য সেতুর মতো পদ্মা সেতুর দুটি অংশ: ১. সাবস্ট্রাকচার বা নিচের অংশ। এর মধ্যে রয়েছে পাইলিং ও পিলার। ২. সুপারস্ট্রাকচার বা ওপরের অংশ। এটিই মূল কাঠামো। এই কাঠামো বসানো শুরু হওয়ার পরই পদ্মা সেতু ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হতে থাকে।
সেতুর ইস্পাতের স্প্যানগুলোর একেকটির ওজন ৩ হাজার ২০০ টন। ভারী এসব স্প্যান বসাতে বড় বড় ক্রেন ব্যবহার করতে হয়েছে।
বিশাল আকার, বিপুল ওজন, ভারী যন্ত্রের ব্যবহার ও জটিল কাজ—এসব কারণে পদ্মা সেতুর স্প্যান বসানোর বিষয়টি নিয়ে মানুষের ব্যাপক আগ্রহ ছিল। ২০২০ সালে শেষ স্প্যান বসানোর মাধ্যমে পদ্মার দুই পাড় সরাসরি সংযুক্ত হয়।
পদ্মা সেতুর নকশা অনুমোদনের সঙ্গে যুক্ত বিশেষজ্ঞ ও সেতু প্রকল্পের কর্মকর্তারা বলছেন, সাধারণত সেতুর স্প্যানের দৈর্ঘ্য ১০০ মিটারের বেশি হলে তা কংক্রিট দিয়ে তৈরি করা ব্যয়বহুল হয়। এ ক্ষেত্রে ইস্পাতের কাঠামো বেশি উপযোগী। ইস্পাতের স্প্যানের ওজন কংক্রিটের তুলনায় কম হয়। এতে সেতুর ভিত্তির ওপর চাপও কম পড়ে। এসব বিবেচনায় পদ্মা সেতুর স্প্যান ইস্পাত দিয়ে তৈরি হয়েছে।
পদ্মা সেতুর স্প্যান তৈরি হয়েছে চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হেবেই প্রদেশের শিংহুয়াংডাও শহরের বড় একটি কারখানায়। তৈরির পর চীন থেকে স্প্যানের চালানগুলো বাংলাদেশের মোংলা বন্দরে আসতে সময় লাগে ২১ থেকে ৩০ দিন। বন্দরে আসার পর শুল্ক কর্তৃপক্ষের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে স্প্যানগুলো ওঠানো হয় ছোট ছোট জাহাজে (বার্জ)। সেগুলো মুন্সিগঞ্জের মাওয়ায় এনে রাখা হয় পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজের জন্য তৈরি করা কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড বা নির্মাণমাঠে।
নির্মাণমাঠের ওয়েল্ডিং ওয়ার্কশপে একেকটি অংশ জোড়া দিয়ে ১৫০ মিটার লম্বা স্প্যান তৈরি করা হয়। এরপর অত্যাধুনিক প্রযুক্তির (থ্রিডি) ওয়ার্কশপে চূড়ান্ত ওয়েল্ডিং করা হয়। চূড়ান্ত পর্যায়ে ধূসর রং দেওয়া হয় স্প্যানে।
পদ্মা সেতুর মূল কাঠামোতে ধূসর রং করার কারণ আছে। কারণটি হলো, ধূসর রঙের ওপর আলো পড়লে তা বেশি ফুটে ওঠে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের কর্মকর্তারা বলছেন, ভরা পূর্ণিমায় চাঁদের আলো ধূসর রঙের সেতুর সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেবে। এ ছাড়া সড়কবাতির আলোও ধূসরে ভালো ফুটবে। পদ্মা সেতুর জন্য রং সরবরাহ করছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি কোম্পানি। এই রং ২৫ বছর স্থায়ী হবে বলে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে।
পদ্মা সেতুতে বিশেষ ধরনের আলোকসজ্জার ব্যবস্থা করার সিদ্ধান্তও আছে, যাকে ‘আর্কিটেকচারাল লাইটিং’ বলা হয়। তবে সেতু উদ্বোধনের আগে তা বসানো সম্ভব হয়নি। পরে যুক্ত করা হবে। জাতীয় দিবস কিংবা বিভিন্ন উৎসবে সেতুতে আলো ফেলে নানান প্রদর্শনীর ব্যবস্থার জন্যই আর্কিটেকচারাল লাইটিংয়ের ভাবনা। দুবাইয়ের বুর্জ খলিফায় এ ব্যবস্থা রয়েছে।
পদ্মা সেতুর ৪১টি স্প্যান বসাতে ১ হাজার ১৬৮ দিন লেগেছে। শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর।
পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজের বিভিন্ন পর্যায়ে নানান কারিগরি ও প্রকৃতিগত চ্যালেঞ্জ এসেছে। কখনো নদীর তলদেশের মাটি সরে গিয়ে গভীর খাদ তৈরি হয়েছে। কখনো প্রবল স্রোত নির্মাণকাজে ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। পাইলিংয়ে জটিলতার কারণে পিলার নির্মাণে দেরি হয়েছে। এসব কারণে স্প্যান বসানোর কাজ পিছিয়েছে।
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন: