ইশারা ভাষা দিবস আজ

ইশারা ভাষার জন্য উদ্যোগ নেই

হাসপাতাল এমনকি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করা সরকারি প্রতিষ্ঠানেও দোভাষী নিয়োগ দেওয়া হয়নি।

ফাইল ছবি

তাসনিয়া তারতুসি ও তাঁর স্বামী সালেহ আহমেদ—দুজনই বাক্‌-শ্রবণপ্রতিবন্ধী। তাসনিয়া ঢাকা আর্ট কলেজ থেকে অনার্স করে বাংলাদেশ শিশু একাডেমিতে বাক্‌-শ্রবণপ্রতিবন্ধী শিশুদের আর্ট শেখান। সালেহ বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চারু ও কারুকলায় মাস্টার্স করেছেন।

তাসনিয়া ও সালেহ গ্রামীণফোনের কাস্টমার কেয়ারে বাক্‌-শ্রবণপ্রতিবন্ধীদের ভিডিও কলের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে সহায়তা করছেন।

তাসনিয়ার ছোট বোন তানজিলা তারতুসি বিটিভির ইশারা ভাষায় খবর পড়েন। তিনি বলেন, তাঁর বোনের ক্লাস ও পরীক্ষার সময় মা ইসরাত জাহান পুরো সময় ক্যাম্পাসে বসে থাকতেন। বোন ও দুলাভাই চিকিৎসকের কাছে গেলে তাঁকেও সঙ্গী হতে হয় ইশারা ভাষায় দোভাষীর দায়িত্ব পালনের জন্য। কেননা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা হাসপাতালে সরকারিভাবে কোনো দোভাষী নেই।

ইশারা ভাষায় দোভাষীর সংখ্যা ১০ থেকে ১২ জন। নির্যাতনের শিকার নারী বা অন্যান্য মামলায় আদালতে দোভাষীর মাধ্যমে জবানবন্দি দেওয়ার সুযোগ নেই। হাসপাতাল, এমনকি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে কাজ করা সরকারি প্রতিষ্ঠানেও দোভাষী নিয়োগ দেওয়া হয়নি।

আজ বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক ইশারা বা সাংকেতিক ভাষা দিবস। ২০১৮ সাল থেকে দিবসটি পালিত হচ্ছে। ২০০৯ সালে একুশে গ্রন্থ মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলা ইশারা ভাষাকে ‘অন্যতম ভাষা’ হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি বিটিভিসহ অন্যান্য টেলিভিশন চ্যানেলের প্রধান সংবাদে ও রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে ইশারা ভাষা উপস্থাপনের নির্দেশ দেন। বিটিভি ও দেশ টিভি ছাড়া আর কোনো চ্যানেলে এটি বাস্তবায়িত হয়নি।

সরকার বিষয়টি নিয়ে আন্তরিক। ইশারা ভাষার উন্নয়নসহ বিভিন্ন দিক আলোচনায় আছে।
মো. কামরুল ইসলাম চৌধুরী, পরিচালক (প্রতিষ্ঠান), সমাজসেবা অধিদপ্তর

বাক্‌-শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, সরকারিভাবে দিবস পালন ছাড়া আর কোনো উন্নয়ন হয়নি ইশারা ভাষা বা এই ভাষা ব্যবহারকারী জনগোষ্ঠীর। বেসরকারি হিসাবে এ ভাষা ব্যবহারকারী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৩০ লাখের বেশি। তবে গতকাল বুধবার পর্যন্ত সমাজসেবা অধিদপ্তরের জরিপ কার্যক্রমে আসা বাক্‌প্রতিবন্ধী ১ লাখ ৫৭ হাজার ৮১৯ জন। শ্রবণপ্রতিবন্ধী ৭৮ হাজার ৫৭৪ জন। বাক্‌-শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পাশাপাশি অটিস্টিক, নিউরোলজিক্যাল ডিজঅর্ডার ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকে ইশারার মাধ্যমে যোগাযোগে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।

আইন ও সনদের বাধ্যবাধকতা: সরকার জাতিসংঘ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার সনদ এবং ঐচ্ছিক প্রতিপালনীয় বিধিবিধান অনুসমর্থন করেছে। ২০০৮ সাল থেকে কার্যকর হওয়া এই সনদ ইশারা ভাষার স্বীকৃতি ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের জন্য শরিক রাষ্ট্রকে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিয়েছে। শুধু সনদ নয়, ২০১৩ সালে সরকার যে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করেছে, তাতেও প্রমিত বাংলা ইশারা ভাষা প্রণয়ন ও উন্নয়নে প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম গ্রহণ, হাসপাতাল, আদালত, থানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব জায়গায় ইশারা
ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলা আছে।

রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ১৯৯৪ সালে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বধির সংস্থা যৌথভাবে বাংলা ইশারা ভাষার অভিধান প্রকাশ করে। তবে এখন পর্যন্ত প্রমিত ইশারা ভাষা প্রণয়নে উদ্যোগ নেয়নি সরকার।

মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর নজরানা ইয়াসমীন জানালেন, সরকারিভাবে দিবস পালন ছাড়া ইশারা ভাষার তেমন অগ্রগতি হয়নি। তাঁর সংস্থায় ইশারা ভাষায় নাটকের মাধ্যমে বাক্‌-শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য আইন ও সনদের বিভিন্ন ধারা তুলে ধরে সচেতনতা তৈরির একটি প্রকল্প চলমান।

শিক্ষার সুযোগ কম: সমাজসেবা অধিদপ্তর আটটি শ্রবণপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয় পরিচালনা করছে। এতে মোট আসন ৭২০টি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ঢাকা সরকারি বধির হাইস্কুল এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় (অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত) একটি স্কুলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার সুযোগ আছে।

ঢাকা সরকারি বধির হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক আমিনুল ইসলাম বলেন, উচ্চশিক্ষার সুযোগ সীমিত থাকায় পিছিয়ে থাকতে হচ্ছে এই শিক্ষার্থীদের।

নিজেদের তাগিদেই দোভাষী: বাক্‌-শ্রবণপ্রতিবন্ধী শাহ বাবুল আহমেদ ও নাজমা বেগমের মেয়ে বদরুন নাহার দেশ টিভির একটি খবরে দোভাষীর দায়িত্ব পালন করছেন।

বিটিভির দোভাষী আরাফাত সুলতানার বাবা আবদুল হক এবং মা রিফাত সুলতানাও বাক্‌-শ্রবণপ্রতিবন্ধী। আরাফাত জানালেন, বিটিভির সন্ধ্যা ছয়টার খবরে দোভাষী রাখা হয়েছে। করোনার আগে বেলা দুইটার খবরে দোভাষী ছিল, এ খবর অন্যান্য টেলিভিশন চ্যানেল সম্প্রচার করত। করোনায় এ খবর সম্প্রচারই বন্ধ রয়েছে।

বিটিভিতে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বাক্‌-শ্রবণপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ধর্ষণসহ বিভিন্ন মামলায় আদালতে দোভাষীর দায়িত্ব পালন করেন আরিফুল ইসলাম। তাঁর দুই ভাই এবং এই দুই ভাইয়ের স্ত্রী বাক্‌-শ্রবণপ্রতিবন্ধী।

আদালতে দোভাষী নিয়োগ হয়নি: দেশের বিভিন্ন আদালতে ১৭টি মামলায় দোভাষীর দায়িত্ব পালন করা আরিফুল ইসলাম বলেন, দোভাষীর মাধ্যমে ভিকটিমের জবানবন্দি নেওয়া হলে ন্যায়বিচার পাওয়ার পথটি সুগম হয়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আনোয়ার সাদাত নরসিংদীতে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় ২০১০ সালে দোভাষীর সহায়তায় একটি মামলা পরিচালনা করেন। তিনি বলেন, জমিসংক্রান্ত মামলার অভিযুক্ত আসামি প্রথমে ভেবেছিলেন ভুক্তভোগী এ মামলায় সুবিধা করতে পারবেন না। তবে দোভাষী নিয়োগের পর পরিস্থিতি পাল্টে গেলে আসামি আপস করতে বাধ্য হন এবং ক্ষতিপূরণ দেন ওই প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রতিষ্ঠান) মো. কামরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সরকার বিষয়টি নিয়ে আন্তরিক। ইশারা ভাষার উন্নয়নসহ বিভিন্ন দিক আলোচনায় আছে।