ইরাবতী ডলফিনের বড় আশ্রয় বাংলাদেশ

ইরাবতী ডলফিনের প্রজাতি বিশ্ব থেকে বিলুপ্তপ্রায়। টিকে আছে সাত হাজারটি। যার ছয় হাজারটি বাংলাদেশে। গত বছরের ডিসেম্বরে নিঝুম দ্বীপের মুক্তারিয়া খালে। ছবি: দীলিপ কে দাশ
ইরাবতী ডলফিনের প্রজাতি বিশ্ব থেকে বিলুপ্তপ্রায়। টিকে আছে সাত হাজারটি। যার ছয় হাজারটি বাংলাদেশে। গত বছরের ডিসেম্বরে নিঝুম দ্বীপের মুক্তারিয়া খালে।  ছবি: দীলিপ কে দাশ

বিশ্বজুড়ে বিপন্ন হয়ে পড়া ইরাবতী ডলফিনের সবচেয়ে বড় আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। বিশ্বের কোথাও ২০০টির বেশি এই প্রজাতির ডলফিন বা শুশুক দেখা যায় না। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। এর কারণ, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার নদীগুলোতে নোনা ও মিঠাপানির 

অনুকূল ভারসাম্য।

বন বিভাগের উদ্যোগে ও জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) অর্থায়নে এক বছর ধরে চলা এক জরিপ থেকে এই তথ্য পাওয়া গেছে। ডলফিনের বসবাসের উপযুক্ত এলাকা (হট স্পট) চিহ্নিত করাই ছিল এই জরিপের লক্ষ্য। জরিপে সুন্দরবনসহ দেশের উপকূলীয় এলাকা ছাড়াও প্রধান নদীগুলোতে ডলফিনের বিচরণ এবং বসবাসের জন্য উপযুক্ত এলাকা খুঁজে পাওয়া গেছে।

এত দিন সুন্দরবন থেকে শুরু করে কর্ণফুলী নদীর মোহনা পর্যন্ত ডলফিনের বসতি দেখা যেত। সম্প্রতি ডলফিনের একটি বড় বসতি এলাকা পাওয়া গেছে নিঝুম দ্বীপের ভাটিতে। জরিপের প্রাথমিক ফলাফল বলছে, নদীতে দূষণ ক্রমাগত বেড়ে যাওয়া, কারেন্ট জালের বিস্তার, এদের বসতি এলাকায় যান্ত্রিক নৌযানের সংখ্যা বৃদ্ধির পরও দেশে ডলফিন টিকে আছে। তবে যেভাবে ডলফিনের বসতি এলাকায় মানুষের উৎপাত বাড়ছে, তাতে সামনের দিনগুলোতে এদের টিকে থাকা কঠিন হয়ে যাবে।  

বোতলনাক ডলফিন

বন বিভাগ ও ইউএনডিপির জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশে প্রায় ছয় হাজার ইরাবতী ডলফিন আছে। এগুলোসহ সারা বিশ্বে এই ডলফিন আছে মাত্র সাত হাজার। শুধু ইরাবতী নয়, বিশ্বের ৮০ প্রজাতির ডলফিনের অন্তত ১২ প্রজাতি আছে বাংলাদেশে। এর মধ্যে গাঙ্গেয় ডলফিন এবং ঘূর্ণি ডলফিনের সংখ্যাও বেশ ভালো বাংলাদেশে। বিশ্বজুড়ে বিপন্ন হয়ে পড়া এই দুই প্রজাতির ডলফিনের বসবাসও বাংলাদেশে অনেক দেশের তুলনায় বেশি। দেশের উপকূলীয় এলাকাজুড়ে সুন্দরবন, নিঝুম দ্বীপ, সেন্ট মার্টিন, সোনাদিয়া দ্বীপের পার্শ্ববর্তী এলাকা এবং বিশেষ করে, নতুন জয় করা সমুদ্রসীমায় বিপুল পরিমাণ ডলফিনের বিচরণের তথ্য উঠে এসেছে এই জরিপে।

জানতে চাইলে সরকারের ‘ডলফিনের উপযুক্ত বসতি এলাকা চিহ্নিতকরণ’ শীর্ষক জরিপ দলের প্রধান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশের উপকূল ও নদী এলাকাগুলোতে এখনো ডলফিনের টিকে থাকার মতো পরিবেশ আছে। সরকার সুন্দরবনের মধ্যে তিনটি এলাকাকে ডলফিনের অভয়ারণ্য এলাকা ঘোষণা করেছে। আমরা সুন্দরবনের পানখালি এলাকার পাশের নদীতে ডলফিনের একটি বড় বসতি দেখেছি। এ ছাড়া হালদা, কর্ণফুলী ও ব্রহ্মপুত্র নদেও ডলফিন দেখা গেছে। এই এলাকাগুলোকেও ডলফিনের অভয়াশ্রম ঘোষণা করা যেতে পারে। বিশেষ করে, বিশ্বে বিলুপ্ত হতে বসা ইরাবতী ডলফিন সর্বোচ্চ সংখ্যায় আছে বাংলাদেশে। এদের রক্ষায় আমাদের আলাদা গুরুত্ব দিতে হবে।’

ঘূর্ণি ডলফিন

বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ডলফিনের যত প্রজাতি আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ইরাবতী ডলফিন। এর যেসব বৈশিষ্ট্য আছে, তার সঙ্গে অনেকে মানুষের মিল খুঁজে পান। প্রজাতিগতভাবে এরা এমনিতেই স্তন্যপায়ী। মানুষের মতোই এদের গায়ের রক্ত গরম। মা–বাবা ও সন্তানসহ এরা একটি পরিবারের মতো নদী-সাগরে ঘুরে বেড়ায়। আরও বড় অর্থে এরা দল বেঁধে থাকে। এক স্থানে দীর্ঘদিন থাকার পর, পানির নিচ দিয়ে সাঁতরে ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে গিয়ে স্থির হয়। প্রাচীন শিকারি মানবদের স্বভাবও ছিল একেক সময় একেক জঙ্গলে থাকা।

স্বভাবে লাজুক ডলফিনের এই প্রজাতিটি পানির মধ্যে সন্তর্পণে পরিবার নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। নিশ্বাস নেওয়ার জন্য এরা অন্যদের মতো পানির ওপরে উঠে লাফালাফি করে না। পিঠের ওপরে বাঁকানো কুঁজটি উঁচু করে নিশ্বাস নেয়। যেমন ঘূর্ণি ডলফিন নিশ্বাস নেওয়ার জন্য লাফ দিয়ে পানির ওপরে উঠে পড়ে, তারপর পাক খেতে খেতে আবার পানিতে ঝাঁপ দেয়। গাঙ্গেয় ডলফিন শরীরের ঊর্ধ্বাংশ পানির ওপরে তুলে নিশ্বাস নেয়। বোতল নাক ডলফিন নাক উঁচু করে ফুসফুসে অক্সিজেন নেয়।

হামব্যাকড ডলফিন

যুক্তরাজ্যভিত্তিক বন্য প্রাণীবিষয়ক সংস্থা ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটির (ডব্লিউসিএস) পক্ষ থেকে ২০০৬ সালে প্রথম বাংলাদেশের ডলফিনের ওপর একটি পূর্ণাঙ্গ জরিপ করা হয়। এরপর একই সংস্থা থেকে আলাদাভাবে ইরাবতী ডলফিনের ওপর আরেকটি জরিপ করে তা একটি আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশ করা হয়। তাতে প্রথম বেরিয়ে আসে বাংলাদেশে ইরাবতী ডলফিনের সংখ্যা বিশ্বে সর্বোচ্চ, ৫ হাজার ৮০০টি। এর আগে মনে করা হতো ভারতের দক্ষিণ উপকূলে সবচেয়ে বেশি ইরাবতী ডলফিন থাকে। এ ছাড়া মিয়ানমারের ইরাবতী নদী, কম্বোডিয়ার মেকং অববাহিকা, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার উপকূলে এদের দেখা যায়।

ডব্লিউসিএস, বাংলাদেশের দেশীয় পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশে অনেকগুলো নতুন স্থানে ইরাবতী ডলফিনের বসবাস দেখেছি আমরা। ২০০৬ সালের জরিপে প্রথম বাংলাদেশে যে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ইরাবতী ডলফিনের বসবাস, তা জানা যায়। এই সংখ্যা কমেছে বলে আমরা দেখতে পাইনি।’

ফলস কিলার হোয়েল ডলফিন

বিশ্ব বন্য প্রাণী তহবিলের (ডব্লিউডব্লিউএফ) ডলফিন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি ইরাবতী নদীতে এই প্রজাতির ডলফিনের প্রথম দেখা মেলে। পরবর্তী সময়ে পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ ভারতে এদের পাওয়া যায়। থাইল্যান্ডের ব্যাংককের কাছে ইরাবতী ডলফিনের জন্য একটি অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে সপ্তাহে দু-একটি এই প্রজাতির ডলফিন দেখতে পাওয়া যায়; যা দেখতে বিপুলসংখ্যক পর্যটক এসে বসে থাকেন। মালয়েশিয়া ও কম্বোডিয়ায় ইরাবতী ডলফিনের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য দেশ দুটির সরকার বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে মালয়েশিয়ায় ইরাবতী ডলফিন বেড়েছে বলে দেশটির গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচারও হয়েছে।

বিশিষ্ট বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ রেজা খানের মতে, মূলত প্রাকৃতিক কারণে বাংলাদেশে ইরাবতীসহ ১২ প্রজাতির ডলফিনের বসতি রয়েছে। একসময় বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা ও মেঘনা নদীতেও হরহামেশা ডলফিন দেখা যেত। স্থানীয়রা এদের বলত শিশু। শিশুর মতোই মানুষ এদের আদর করত। কিন্তু এই নদীগুলো দূষিত হয়ে পড়ায় ও জেলেদের নৌকায় আটকে যাওয়ার পর এদের মেরে ফেলার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় এরা সরে গেছে। দেশের উপকূলীয় এলাকাগুলোতে এখনো এই ডলফিন টিকে আছে। তিনি বলেন, ‘সরকার সুন্দরবনের মধ্যে তিনটি এলাকাকে ডলফিনের অভয়াশ্রম ঘোষণা করেছে। কিন্তু ওই এলাকা দিয়ে জাহাজ চলাচলের অনুমতিও দিয়েছে। এর আশপাশে রামপালসহ বড় শিল্প–কারখানা গড়ে তোলার অনুমতি দিয়ে রেখেছে। এই জায়গাগুলো পরিষ্কার করতে হবে। কারণ, প্রকৃতির এই অপূর্ব সুন্দর সম্পদটি আমাদের দেশ থেকে হারিয়ে যাক, তা আমরা চাই না।’