ইরাকে দুই বাংলাদেশিকে বৈদ্যুতিক শক-বিবস্ত্র করে নির্যাতন

নির্যাতনের শিকার মাইনুদ্দিন
ছবি: সংগৃহীত

কুমিল্লার বাসিন্দা মাইনুদ্দিন ২০১৭ সালে ইরাকের বাগদাদে যান। এরপর করোনা পরিস্থিতির শিকার হয়ে দীর্ঘদিন ধরে তিনি বেকার। এ অবস্থায় সেখানকার অপহরণ চক্রের অন্যতম হোতা শিহাব উদ্দিন ভালো কাজের প্রলোভন দিয়ে চলতি বছরের জানুয়ারিতে তাঁকে ইরাকের কিরকুকে নিয়ে যান। এরপর পরিত্যক্ত বদ্ধ কক্ষে তাঁকে শিকল দিয়ে বেঁধে বিবস্ত্র করে বৈদ্যুতিক শক ও রড দিয়ে পিটিয়ে নির্যাতন শুরু করেন। এমনকি পানির বদলে তাঁকে নিজের প্রস্রাব পান করাতেন চক্রের সদস্যরা।

নজরুল ইসলাম

এরপর অপহরণকারী চক্র এই দৃশ্য মাইনুদ্দিনের ইমো অ্যাকাউন্ট থেকে ভিডিও কল দিয়ে স্বজনদের দেখিয়ে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। পরে চক্রটিকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা পাঠালে তাঁকে ছেড়ে দেয় অপহরণকারীরা। তিনি এখন ইরাকেই আছেন।

মাইনউদ্দিনের স্ত্রী ফারজানা আক্তার বলেন, অপহরণকারী শিহাব উদ্দিন চক্রের নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে তাঁর স্বামী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ দেওয়া হয়েছে। এরপর মুক্ত হয়ে তিনি ইরাকের হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। এখন কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেছেন। বিভিন্নজনের কাছ থেকে সুদে ঋণ করে অপহরণকারী চক্রকে এই টাকা পাঠানো হয়েছে।

নিজেদের দুরবস্থার কথা তুলে ধরে ফারজানা আক্তার বলেন, টাকার অভাবে চলতে পারছেন না, বাচ্চাকে খাওয়াতে পারছেন না। অপহরণকারী চক্র ইরাকে তাঁর স্বামীর কাছ থেকে দুই হাজার মার্কিন ডলার, চারটি মুঠোফোন ও কাপড়চোপড় ছিনিয়ে নিয়ে গেছে।

অপহরণকারী চক্রের বিচার দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী খেয়ে না খেয়ে টাকা আয় করেছিলেন, সেই টাকা অপহরণকারী চক্র নিয়ে গেছে। সেই টাকা আমি ফেরত চাই।’

মাইনুদ্দিনের মতো আরেকজন ভুক্তভোগী গাজীপুরের কালিয়াকৈরের পূর্ব চান্দুরার নজরুল ইসলাম। চার বছর আগে শ্রমিক ভিসায় ইরাকের কিরকুক শহরে যান। গত বছরের ডিসেম্বরে অপহরণ চক্রের হোতা শিহাবউদ্দিন তাঁকে উচ্চ বেতনের প্রলোভন দিয়ে শহরের অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে আটকে নির্যাতন করেন। পরে চক্রের সদস্যরা নজরুলের ইমো নম্বর থেকে ভিডিও কল দিয়ে তাঁর পরিবারের কাছে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ চায়। পরিবারটি মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ২ লাখ ১০ হাজার টাকা পাঠালে চক্রের সদস্যরা নজরুলকে ইরাকের দুর্গম স্থানে ফেলে যায়।

গ্রেপ্তার জসিমউদ্দিন ফকির ও তাঁর শ্যালক মাহবুবুর রহমান (ডানে)

মাইনউদ্দিন ও নজরুলকে অপহরণ করে আটকে রেখে নির্যাতনের ঘটনায় তাঁর স্বজনেরা বাদী হয়ে সম্প্রতি রাজধানীর পল্টন ও কোতোয়ালি থানায় শিহাবউদ্দিন ও তাঁর চক্রের ২০ সদস্যের (দেশে–বিদেশে) বিরুদ্ধে অপহরণ ও মানব পাচার আইনে মামলা করেন। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ডিবির গুলশান বিভাগ ওই ঘটনায় জড়িত অভিযোগে ঢাকা ও ফরিদপুর থেকে জসিমউদ্দিন ফকির (৪৫) ও তাঁর শ্যালক মাহবুবুর রহমানকে (২৫) গ্রেপ্তার করেছে। জসিমউদ্দিন ফরিদপুরের সদরপুর থানার ৬ নম্বর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য। এ দুজনের বিরুদ্ধে ২০১৭ ও ২০১৯ সালে করা মানব পাচার আইনে একাধিক মামলা রয়েছে।

জসিম ও মাহবুবের কাছ থেকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের টাকা লেনদেনের নানা তথ্য–প্রমাণ, মুক্তিপণ হিসেবে আদায় করা অর্থ ব্যাংকে জমা দেওয়ার রসিদ, ব্যাংক চেক ও স্মার্টফোন জব্দ করা হয়। স্মার্টফোনে অপহরণ, মানব পাচারসংক্রান্ত নানা রকম স্থির চিত্র, অডিও এবং চ্যাট পাওয়া গেছে।

দুই মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ডিবি গুলশান বিভাগের উপকমিশনার মশিউর রহমান আজ শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, জহিরুল ইসলাম ও শিহাবউদ্দিনের নেতৃত্বে চক্রের সদস্যরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আদনান, কিশোরগঞ্জের সুলতানসহ ইরাকের বিভিন্ন শহরে থাকা অন্তত ৩৫ বাংলাদেশিকে আটকে রেখে মুক্তিপণ দাবি করেছে। ডিবি এসব ব্যক্তিকে উদ্ধারে সেখানকার বাংলাদেশের দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। জসিম ও মাহবুব ছাড়াও তিনজনকে আটক করা হয়েছে। তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

যেভাবে পাচার হয়

ইরাকের বিমানবন্দর, হাসপাতাল, হোটেল, দোকান ও অবকাঠামো নির্মাণ এলাকায় চাকরি দেওয়ার কথা বলে ভিজিটর (ভ্রমণ) ভিসায় বাংলাদেশ থেকে ইরাকে লোক পাঠানো হয়। বিশেষত বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চল থেকে যাঁরা যান, তাঁদের কাছ থেকে চার থেকে ছয় লাখ টাকা নেয় চক্রটি। দুবাই পৌঁছানোর পর চক্রের সদস্যরা ভিজিটরদের গ্রহণ করে ১৫-২০ দিনের জন্য বিভিন্ন ক্যাম্পে রাখে। পরে দুবাই থেকে ভিজিট ভিসায় পাঠানো হয় ইরানে। সেখানে ভিসা, টিকিট ও থাকা-খাওয়ার জন্য তাঁদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। এরপর সেখান থেকে আকাশপথে বা বাসে করে তাঁদের পাঠানো হয় ইরাকে। ইরাকে পৌঁছানোর পর বিভিন্ন ক্যাম্পে তাঁদের আটকে রেখে চলে নির্যাতন ও মুক্তিপণ আদায়।

ভিজিট ভিসায় ওয়ার্ক পারমিট নেই

ভিজিট ভিসায় আকামা বা ওয়ার্ক পারমিট থাকে না। ভাষাজ্ঞান ও কর্মদক্ষতায় অনগ্রসর এই মানুষগুলোর জন্য অর্থ উপার্জনের পরিবর্তে একসময় জীবনধারণ কঠিন হয়ে ওঠে।

যেভাবে গড়ে ওঠে অপহরণকারীর চক্র

জহিরুল ইসলাম ২০১২ সাল থেকে ইরাকে আছেন। তাঁর বাড়ি ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলার পূর্ব কান্দিতে। ইরাকে তিনি অপহরণ এবং মুক্তিপণ আদায়ের একটি শক্তিশালী চক্র গড়ে তোলেন। ২০১৭ সালে জহিরুলের আপন ভাই জসিম উদ্দিন সেখানে যান। দেড় বছর ইরাকে থেকে জসিম মানব পাচার এবং নির্যাতনের নানা কৌশল রপ্ত করে এবং দেশে ফিরে আসেন। চক্রটির একটি অংশ ইরাকে আছে। সেই অংশের সদস্যরা হলেন জহিরুল, শিহাব উদ্দিন, জিয়া, সুলতান আহমেদ। তাঁরা স্থানীয় ইরাকি বাড়ির মালিক ও তত্ত্বাবধায়কদের সহযোগিতায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের অত্যাচার-নির্যাতন করেন। এরপর চক্রটির বাংলাদেশে থাকা সহযোগীদের (হাবিব, আক্কাস, বাবলু মোল্লা, মমিন ও তাঁর ভাই আকরাম) মাধ্যমে ভুক্তভোগী পরিবারের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেন। শিহাব উদ্দিনের বাড়ি রাজবাড়ীর কাউখালী উপজেলার কোয়ারদিতে।

অপহৃত হন যাঁরা

মূলত ইরাকের বাগদাদ, বসরা, কিরকুক ও আরবিল—এই চার শহরে শ্রমিকদের ওয়ার্ক পারমিট বা আকামা দেওয়া হয়। এই ভিসায় যাওয়া অভিবাসীরা অন্য শহরে অবৈধ। যে প্রতিষ্ঠানে অভিবাসীদের পাসপোর্ট জমা নেওয়া হয়, সেই প্রতিষ্ঠানে ওই শ্রমিক একপ্রকার জিম্মি হয়ে পড়েন। ফলে এই অভিবাসীদের অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার স্বাধীনতা থাকে না। ওই সব প্রতিষ্ঠান থেকে পালিয়ে যাওয়া শ্রমিক, পাসপোর্ট হারানো শ্রমিক এবং কাজ না পাওয়া শ্রমিকেরা অপহরণকারী চক্রের শিকার হন।

মুক্তিপণের টাকা লেনদেন

বাংলাদেশে অবস্থানরত অপহরণকারী চক্রের সদস্য জসিম ও মাহাবুব ইরাকে মোবাইল ব্যাংকিং নম্বর পাঠায়। ইরাক থেকে সেই মোবাইল ব্যাংকিং নম্বর ভুক্তভোগীদের পরিবারের কাছে পাঠানো হয়। ঢাকায় অবস্থানরত অপহরণকারী চক্রের সদস্য মাহবুব ওই মোবাইল ব্যাংকিংয়ের টাকাগুলো তুলে তাঁর দুলাভাই জসিম ফকিরের কাছে পাঠান, যা একাধিক বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে বিভিন্নজনের কাছে বণ্টন করা হয়।