সিলেটে ইফতারের আয়োজন ঘরোয়া পরিসরে হলে ভুনা কিংবা পাতলা খিচুড়ি। আর মেহমানদারিতে আখনি। ইফতারে এ দুটো পদই সিলেটিদের সবচেয়ে প্রিয়। খেজুর, শরবত, ছোলা-পেঁয়াজুসহ নানা পদের ইফতারি থাকলেও আখনি-খিচুড়ি থাকবেই। ইফতারিতে এ দুটো পদকেই স্থানীয় ঐতিহ্য বলে ধরে নেওয়া হয়। তবে হালে বিভিন্ন খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এখানকার বাজারে নানা উপাদেয় ও বৈচিত্র্যময় ইফতারসামগ্রী বাজারজাত করছে। সিলেটে ইফতারির আরেকটি অনুষঙ্গ বাখরখানি। ইফতারের সময় কিংবা রাতে চায়ের সঙ্গে বাখরখানি খাওয়ার প্রচলন চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। চার প্রকারের মিষ্টি ও ঝালজাতীয় বাখরখানি রয়েছে, যেগুলো সিলেট ছাড়া অন্য কোথাও মেলে না বলে জানালেন কয়েকজন বিক্রেতা। পাঁচ টাকা থেকে শুরু করে ৩০ টাকা পর্যন্ত দাম একেকটি বাখরখানির।
নগরের বন্দরবাজার, জিন্দাবাজার, চৌহাট্টা, আম্বরখানা, মদিনা মার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকায় দুপুর থেকেই চালু হয়ে যায় ইফতারির হাট। সিলেটের বাইরে ইফতারিতে ছোলা, পেঁয়াজুর সঙ্গে মুড়ি যেমন আবশ্যক অনুষঙ্গ, সিলেটিদের কাছে এটি একেবারে অচল। আখনি কিংবা খিচুড়ি ছাড়া ইফতারের কথা চিন্তাই করা যায় না। তার সঙ্গে ছোলা ভুনা থাকবেই। তবে সিলেটে বসবাসকারী অন্য জেলার রোজাদারেরা মুড়ি ও ছোলা বুটের মিশ্রণের পদ চালু রেখেছেন। পোলাও রান্নার চাল দিয়ে তৈরি হয় আখনি। এ জন্য একে একসঙ্গে আখনি-পোলাও ডাকা হয়। গরু, খাসি কিংবা মুরগির মাংস ছাড়া আখনি হয় না। যে মাংস যুক্ত করা হয়, সেই মাংসের নাম উল্লেখ করে আখনি পরিচিতি পায়। যেমন, গরুর আখনি, খাসির আখনি প্রভৃতি। পোলাও-বিরিয়ানি রান্নার প্রণালির সঙ্গে আখনির মিল রয়েছে। তাই সিলেটের আখনি খেয়ে বাইরের জেলার মানুষেরা পোলাও-বিরিয়ানির স্বাদ অনুভূব করেন। মাংসভেদে আখনির কেজিপ্রতি দাম ১২০ থেকে ১৮০ টাকা। ভুনা খিচুড়ি ৬০ টাকা কেজি হলেও পাতলা খিচুড়ি প্রতি প্লেট ২০ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হয়। এ ছাড়া অন্যান্য সামগ্রীর মধ্যে জিলাপি, পেঁয়াজু, আলুর চপ, ডিমের চপ, বেগুনি, আলুনি, শাকের পাকুড়া, সবজির পাকুড়া, কাঁচকলার চপ, চিংড়ির বড়ার কদর বেশি। দরগাহ গেটের সবচেয়ে বড় ইফতারির পসরার স্বত্বাধিকারী মুহিন ইসলাম বলেন, ‘খুচরা কেনাবেচার পাশাপাশি ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী আমরা ইফতারসামগ্রী সরবরাহ করে থাকি। চাহিদার শীর্ষে আখনি অথবা ভুনা খিচুড়ির পদ থাকে।’ এ ছাড়া ফাস্টফুডের দোকানগুলোতে মেলে চিকেন ইরানি কাবাব, চিকেন টিক্কা, চিকেন ফ্রাই, রেশমি কাবাব, চিকেন রোস্ট, চিকেন রোল হরেক পদ। পাশাপাশি ইদানীং হালিম ইফতারির একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। মিষ্টিজাতীয় দ্রব্যের মধ্যে সিলেটের বিশেষত্ব হচ্ছে আমৃতি। একসময় এটি লাল রঙের হতো। ইফতারির জন্য বিশেষভাবে তৈরি আমৃতিতে রং দেওয়া হয় না। দেখতে অনেকটা জিলাপির মতো হলেও আকার ও স্বাদে রয়েছে ভিন্নতা। হাতে গোনা কয়েকটি মিষ্টির দোকানে আমৃতি মেলে। বন্দরবাজারের কয়েকটি মিষ্টির দোকান স্থানীয়ভাবে ‘আলাইর ঘর’ (মিষ্টির ঘর) নামে সমাদৃত হয় রমজানে। সিলেটে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা থেকে মসজিদ, মক্তব, মাদ্রাসা ও এতিমখানায় ইফতারি পাঠানোর রেওয়াজ প্রচলিত রয়েছে। সিলেটে হজরত শাহজালাল (রহ.) দরগাহে বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা ও ব্যক্তিগতভাবে সরবরাহ করা ইফতার সাধারণ মুসল্লি থেকে ভিক্ষুক পর্যন্ত একই সারিতে বসে সারেন। সেখানেও আখনি সরবরাহ করা হয়।
সিলেটের ইফতার সংস্কৃতিতে আখনি-খিচুড়িই প্রধান। এ দুটিতে সিলেটি চেনা যায়, জানালেন ‘সিলেটের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি-প্রকৃতি রক্ষা আন্দোলন’-এর সমন্বয়কারী আবদুল করিম। তিনি বলেন, পাশাপাশি কনের শ্বশুরালয়ে ইফতারি পাঠানোর সংস্কৃতি প্রচলিত রয়েছে। ইফতারি পাঠানোর রেওয়াজে আখনির প্রচলন বহু পুরোনো। ছানা, পেঁয়াজু, জিলাপিসহ মিষ্টি ও ফলমূল থাকলেও আখনি ছাড়া যেন ইফতারই হয় না।