ইন্দিরা গান্ধীর একাত্তরের বক্তৃতামালা

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারত একটি প্রধান মিত্র শক্তি হিসেবে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল। দেশটির সাদারণ মানুষের সমর্থন ও সহযোগিতার পাশাপাশি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পালন করেছিলেন অসামান্য ভূমিকা। পাঠকদের জন্য এখানে রইল একাত্তরজুড়ে তাঁর নানা বক্তব্যের একটি নির্বাচিত অংশের অনুবাদ।

শরণার্থী শিবিরে ইন্দিরা গান্ধী, ১৯৭১। ছবি: ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনের সৌজন্যে
শরণার্থী শিবিরে ইন্দিরা গান্ধী, ১৯৭১। ছবি: ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনের সৌজন্যে

পাকিস্তান বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রামকে ভারত-পাকিস্তান সংঘাত বলে চালিয়ে দিতে চাইছে। পাকিস্তানের এই প্ররোচণায় ভারত ভুল পথে যাবে না।...

ভারতের লোকসভায় বিতর্কে

২৭ মার্চ ১৯৭১

পাকিস্তানের ঘটনাবলি আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। কিছুদিন আগে পূর্ব বাংলায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। এই নির্বাচন যেমন ব্যাপক শ্রদ্ধা কুড়িয়েছে, তেমনই প্রত্যাশাও জাগিয়েছে। প্রত্যাশা ছিল, সমগ্র দেশের জন্য ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী নতুন একটা ভবিষ্যতের সূত্রপাত হবে। কিন্তু আমার সহকর্মী সরদার সাহেব যেমনটা বললেন, সম্ভাবনার আলোকোজ্জ্বল পথ থেকে অনেক দূরে সরে গিয়ে অন্ধকারের দিকে তারা বাঁক নিয়েছে। এই যাত্রা যেমন বিয়োগান্ত, তেমন দুর্ভোগে পূর্ণ। পূর্ব বাংলার সমগ্র জনগোষ্ঠী চরম যে দুর্দশার মুখে পড়েছে, সে তুলনায় দুর্ভোগ শব্দটি সম্ভবত অনেক ক্ষুদ্র।

পূর্ব বাংলার মানুষের জন্য আমাদের হৃদয় যে রকম ভারাক্রান্ত হচ্ছে, তাদের যন্ত্রণা আমরা যতটা গভীরভাবে ভাগ করে নিচ্ছি, তাতে করে মাননীয় সদস্যরা প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। তবে মাননীয় সদস্যরা যে ভাষায় কথা বলছেন, সরকারের পক্ষে সেই একই ভাষায় কথা বলা সম্ভব নয়। এটা এই কারণে যে আমরা এই মুহূর্তের ঐতিহাসিক তাৎপর্য সম্পর্কে গভীরভাবে অবগত, পরিস্থিতির গুরুত্ব সম্পর্কেও আমরা সচেতন। এ সময়ে আমাদের একটা ভুল পদক্ষেপ, এমনকি ভুল শব্দের প্রয়োগ, আমরা যা সংকল্প করেছি, তা থেকে আমাদের অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে যাবে।

আমাদের একটা আন্তর্জাতিক রীতি মেনে চলতে হয়, সে ব্যাপারে আইনসভাকে সচেতন হতে হবে। দলগুলো যে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করছে, সেটা দেখে আমার ভালো লাগছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলতে হয়, স্বতন্ত্র দল শেখ মুজিবুর রহমানের সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচির তারিফ করেছেন। জনসংঘ দল তাঁর ধর্মনিরপেক্ষ নীতিকে সমর্থন করেছে এবং পূর্ব বাংলার জনগণকে নিজেদের ভাই বলে সম্বোধন করেছে। আমি আশা করি, রাজনৈতিক দলগুলো আমাদের দেশের সমগ্র জনগণের প্রতি একই সমমর্মিতা পোষণ করবে।

আমি আগেই বলেছি, পূর্ব বাংলায় যা ঘটছে, তা নিয়ে আমরা অসচেতন নই। এর অর্থ হচ্ছে, শুধু সেখানকার মানুষ নয়, আমাদের জন্যও বিপদ এসে হাজির হয়েছে। সেই বিপদ শুধু দেশের এক অঞ্চলের জন্য নয়, সমগ্র দেশের সামনেই সেটা এসে পড়েছে। সে জন্য পূর্ব বাংলার ঘটনাবলি নিয়ে আমাদের আগ্রহী হওয়ার অনেক কারণই আছে। প্রথমত, একজন সাংসদ যেমনটা বললেন, শেখ মুজিবুর রহমান সেই মূল্যবোধ ধারণ করেন, যে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধ আমরাও লালন করি। সেখানকার জনগোষ্ঠী তাঁর পেছনে এবং তাঁর এই মূল্যবোধের পেছনে যে অভূতপূর্ব ও অনন্য উপায়ে সমবেত হয়েছেন, সে ব্যাপারে আমরা সচেতন। সেখানে যা ঘটছে, তা নিয়ে আমরা কোনো অংশেই কম বেদনাহত নই। এ ব্যাপারে আমাদের গভীর উদ্বেগও রয়েছে। কিন্তু আমি মাননীয় সদস্যদের প্রতি কেবল একটা প্রশ্ন রেখে যেতে পারি, এই মুহূর্তে সরকার এর থেকে বেশি কিছু বলতে পারে কি না, অথবা সরকারের কি এমন কোনো কাজ করা উচিত, যেটা মানুষের মধ্যে বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারে। মাননীয় সাংসদেরা যেসব প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, তার উত্তর নিয়ে আমি ভাবছি না। আমি তাদের পরামর্শ নিয়ে ভাবছি। মাননীয় সদস্যরা জানেন যে আজ সকালে বিরোধী দলের নেতাদের নিয়ে একটি আলোচনায় আমি বসেছিলাম। সেটা ভবিষ্যতে চলমান থাকবে বলে আমি আশা করি। এই পরিস্থিতিতে পূর্ব বাংলার ঘটনাবলির সংস্পর্শে যতটা আসা সম্ভব, ততটা নিবিড়ভাবেই আমরা আছি। আমি আশা করি বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে এ বিষয়ে নিবিড় যোগাযোগ বজায় রাখব। একই সঙ্গে অন্যান্য সাংসদ, যাঁরা আমাদের কাছে আসতে চান, তাঁরা নির্দ্বিধায় আসতে পারেন, যাতে করে আমরা তাঁদের মনোভাব জানতে পারি।

সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিনের দেওয়া মধ্যাহ্নভোজে বক্তব্য

২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র ইউনিয়ন সরকার ও নেতাদের আমন্ত্রণে আবার মস্কোতে আসতে পেরে আমি আনন্দিত। বিশেষ করে আমার জন্য আনন্দের কারণ হচ্ছে, সোভিয়েত-ভারত শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তি সইয়ের পরপরই আমি এখানে আসতে পেরেছি।

ভারতের ইতিহাসে ১৯৭১ সালকে ঘটনাবহুল বছর হিসেবে স্মরণ করা হবে। আমরা নিশ্চিতভাবেই একটা সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছি। মার্চ মাস থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ঘটনাপ্রবাহের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে। আট বছর মন্দাভাবের পর এ বছরটা শুরু হয়েছিল অর্থনীতির তেজি ভাব নিয়ে। গত মার্চের সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় দৃশ্যপটে একটা বড় স্পষ্টতা এনে দিয়েছে এবং আমাদের রাজনৈতিক অভিমুখও নির্ধারণ করে দিয়েছে। আমরা আমাদের জাতীয় উন্নয়নের দ্বিতীয় পর্যায় চালু করতে মনস্থির করেছি। সমতা ও মুক্তির যে প্রতিশ্রুতি আমরা দিয়েছিলাম, সেটা বাস্তবে রূপ দেওয়ার কাছাকাছি আমরা পৌঁছে গেছিলাম।

আমাদের আইনসভার অধিবেশন সবে এক সপ্তাহ পার হয়েছিল, সাংসদেরা তখনো একে অন্যের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়ে ব্যস্ত ছিলেন, ঠিক সে সময়েই আমাদের সীমানার ওপারে ঘটনাগুলো ঘটতে শুরু করে। আমাদের ধারণাতীত সমস্যার মুখোমুখি হতে হলো। পূর্ব বাংলায় জনগণের সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের বড় ধরনের সংঘাত শুরু হলো। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডে লাখ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হলো। তারা ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করল। প্রতিবেশীর ঘরে যখন আগুন লাগে, তখন বিচলিত না হয়ে কেউ পারে না। পূর্ব বাংলা কিংবা বাংলাদেশ যে নামেই বিশ্ব ডাকুক না কেন, সেখানকার ঘটনাবলি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে আর বিবেচনা করার সুযোগ নেই। পূর্ব বাংলা থেকে ৯০ লাখের বেশি মানুষ আমাদের দেশে এসেছে। তাদের কি নিজেদের দেশে বেঁচে থাকা ও কাজ করার অধিকার নেই? তাদের আত্তীকরণ করে নেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আমাদের নিজেদেরই বহু সমস্যা রয়েছে। আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠী রয়েছে, নতুন করে সমস্যা যুক্ত করে নেওয়ার প্রয়োজন আমাদের নেই। প্রকৃতপক্ষে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঠেকাতে অনেক অর্থ ও প্রচেষ্টা ব্যয় হচ্ছে।

এটি ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার বিবাদ নয়। এটি একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। কিন্তু এর গুরুভার ভারতের ওপর চেপেছে। এ ভার বহনে আমাদের সম্পদ, অর্থ কিংবা অন্য সামর্থ্য সীমিত হয়ে আসছে। এ রকম একটা গুরুতর বিয়োগান্ত ঘটনায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যে মাত্রায় সাড়া দেওয়ার প্রয়োজন ছিল, তারা তাতে ব্যর্থ হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এখন স্পষ্ট দায়িত্ব হচ্ছে, এই শরণার্থীরা (সব ধর্মের) যাতে কোনো ভয় ছাড়াই তাদের জন্মভূমিতে ফিরে যেতে পারে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সে রকম পরিস্থিতি তৈরি করা।

পূর্ব বাংলার মানুষের এই মৃত্যুযন্ত্রণা বিশ্বের অনেক সরকারকে তাড়িত করছে না। আমাদের সংযম শুধুই ফাঁকা কথাতেই প্রশংসিত হচ্ছে। কিন্তু এ সংকটে মৌলিক যে বিষয়টি যুক্ত রয়েছে এবং এশিয়ার শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য বড় হুমকি যেটি রয়েছে, সেটি উপেক্ষা করা হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। আমরা আনন্দিত যে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতারা পাকিস্তানকে একটি রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছানোর পরামর্শ দিয়েছেন। এতে পূর্ব বাংলার জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে। আমরা আশা করি, এ প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হবে।

একাধিক দেশ সফর শেষে লোকসভায় দেওয়া ভাষণ

১৫ নভেম্বর ১৯৭১

বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও জার্মানি সফর শেষে আমি সবে দেশে ফিরে এসেছি।...

বাংলাদেশ এবং পশ্চিম পাকিস্তানসংলগ্ন আমাদের সীমান্তে ভীতিকর পরিস্থিতি থাকা সত্ত্বেও আমি এ সফর করেছি, যাতে করে আমাদের আকাঙ্ক্ষার আন্তরিক বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আমাদের সেই আকাঙ্ক্ষাটা হলো, আমরা কোনো কিছুই অব্যাখ্যাত রাখব না। আমাদের ওপর যে গুরুভার চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেটার লাঘব এখান থেকে হতে পারে। যারা আমাদের নিরাপত্তায় হুমকি সৃষ্টির জন্য কিছু একটা অজুহাত পেতে হন্যে হয়ে আছে, তারা এখন পিছিয়ে আসতে বাধ্য হবে। আমাদের দেশের জনগণের সম্পূর্ণ আস্থা এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার ঐক্য আমাকে জাতির এই বিপদে বিদেশ সফরের আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে।

আমার এ সফরে আমি কয়েকটি দেশের সরকারপ্রধান ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আমাদের ধারণাগুলো বিনিময় করতে সক্ষম হয়েছি। এটা এমন এক সময়, যখন বিশ্বে একটা গুরুত্বপূর্ণ বদল হচ্ছে। বৈশ্বিক স্বার্থ, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এবং আরও নির্দিষ্ট করে বলতে, বাংলাদেশের পরিস্থিতি এবং আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোয় যে হুমকি বিরাজ করছে এবং এ অঞ্চলে শান্তি কী করে প্রতিষ্ঠা হবে—এসব বিষয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছি। আমাদের আলোচনা নির্দিষ্ট কিছু ভুল ধারণার অবসানে সহযোগিতা করেছে। উদ্ভূত সমস্যার মূল কারণ কী, সেটা তাদের মনোযোগে এসেছে। সেটা হলো পাকিস্তানের সামরিক শাসকেরা তাদের নিজেদের জনগণের রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে অস্বীকার করেছে এবং তাদের ওপর সন্ত্রাসের রাজত্ব চাপিয়ে দিয়েছে। ভারতমুখী বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর স্রোতের ফলাফল কী হতে পারে, সেটিও তাদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। আমার মনে হয়েছে, ওই দেশগুলো এবং তাদের সঙ্গে অন্য দেশগুলোও বুঝতে পেরেছে, বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছানো ছাড়া প্রান্তিক সমস্যাগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করলে তাতে ফলাফল কিছু আসবে না। বেশির ভাগ দেশ এটা অনুধাবন করতে পেরেছে যে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি অত্যাবশ্যক। পাকিস্তানের সামরিক শাসনের ওপর এ বিষয়টিকে স্থান দিয়েছে।...

মূল বিষয়টাকে পাশ কাটানো ও জাতিসংঘকে যুক্ত করার পথ খোঁজার মাধ্যমে ধোঁয়াশা সৃষ্টির চেষ্টা করছে পাকিস্তান। তারা বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রামকে ভারত-পাকিস্তান সংঘাত বলে চালিয়ে দিতে চাইছে। পাকিস্তানের এই প্ররোচণায় ভারত ভুল পথে যাবে না।...

যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময়ে আমাকে জানানো হয়েছে পাকিস্তানে আর তারা অস্ত্রবাহী জাহাজ পাঠাবে না। এ ব্যাপারে একটি আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এসেছে। আমাকে আভাস দেওয়া হয়েছে, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি থেকেও কোনো অস্ত্র সরবরাহ করা হবে না।

আমার আন্তরিক আশা হচ্ছে, এই বিবৃতিতে বর্ণিত পদক্ষেপগুলো যৌথ কিংবা এককভাবে কেউ যদি নেয়, সেটা পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের এই উপলব্ধি দেবে যে সামরিক আস্ফালন অথবা ভারতের সঙ্গে জবরদস্তির সামরিক সংঘাত কোনো ভালো ফল বয়ে আনবে না। সৎ পরামর্শ জয়ী হওয়ার মতো যথেষ্ট দেরি এখনো হয়নি। কঠোর বাস্তবতা উপেক্ষা করে কেউ সামনে এগোতে পারে না। বাংলাদেশের জনগণের এবং একই সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের বৈধ ও ন্যায্য আকাঙ্ক্ষাকে কেউ উপেক্ষা ও পদদলিত করতে পারে না।

৯০ লাখের বেশি শরণার্থীর যে বোঝা আমরা বহন করছি, তাতে সমব্যথী হওয়া খুব স্বাভাবিক একটা রেওয়াজ। শরণার্থীদের ত্রাণসহায়তার জন্য তহবিল বাড়ানোর একটা লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। আমার সফরের সব দেশই একমত হয়েছে যে বাংলাদেশের ভেতরে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করা দরকার, যাতে শরণার্থীর স্রোত আর ভারতমুখী না হয়। যারা ইতিমধ্যে ভারতের মাটিতে আশ্রয় নিয়েছে, তারা যেন পূর্ণ মানবিক মর্যাদা নিয়ে মাতৃভূমিতে ফিরতে পারে, সেটার উদ্যোগ ত্বরান্বিত করতে তারা সম্মত হয়েছে।

এখানে আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই যে আমাদের সমস্যা আমাদের হয়ে বিশ্বসম্প্রদায়, এমনকি যেসব দেশে আমি সফর করে এসেছি, তারা এসে সমাধান করে দেবে, সে ভরসা আমি করি না। আমরা তাদের সমবেদনা এবং নৈতিক ও রাজনৈতিক সমর্থনকে স্বাগত জানাই। কিন্তু এ পোড়ার ক্ষত আমাদের এবং বাংলাদেশের জনগণকেই বহন করতে হবে।

আমাদের নিরাপত্তার ওপর যে হুমকি, তাতে করে আমাদের স্বাধীনতা সুরক্ষায় এবং সীমানার অখণ্ডতা রক্ষায় শেষ জীবিত ব্যক্তিটি পর্যন্ত নিজেদের প্রস্তুত রাখতে হবে। বাংলাদেশের সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আমরা অবশ্যই সীমানা থেকে আমাদের বাহিনী সরানোর মতো কোনো ঝুঁকি নেব না। তারা আমাদের নিরাপত্তার ওপর গুরুতর হুমকি সৃষ্টি করেছে।

মধ্যরাতের পর জাতির উদ্দেশে ভাষণ

৩ ডিসেম্বর ১৯৭১

আমি আপনাদের সামনে এমন এক মুহূর্তের কথা বলতে এসেছি, যখন আমাদের দেশ এবং জনগণ গভীর এক বিপদের মুখে। কয়েক ঘণ্টা আগে, ৩ ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে পাঁচটার কিছুক্ষণ পর, পাকিস্তান আমাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধে নেমে গেছে। আজ বাংলাদেশের যুদ্ধ ভারতের যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। এটা আমার ওপরে, আমার সরকারের ওপরে এবং ভারতের জনগণের ওপরে মহান এক দায়িত্ব অর্পণ করেছে। যুদ্ধের পথ বেছে নেওয়া ছাড়া আমাদের দেশের জন্য আর কোনো বিকল্প ছিল না। আমাদের সাহসী সেনা কর্মকর্তা ও সৈন্যরা দেশের প্রতিরক্ষার জন্য নিজ নিজ যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান নিয়েছেন। সমগ্র ভারতের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। যেকোনো ধরনের ক্ষয়ক্ষতির জন্য আমরা প্রস্তুত আছি।

আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে এই উচ্ছৃঙ্খল ও বিনা প্ররোচনার আগ্রাসনের নিষ্পত্তি এবং সেটা চূড়ান্তভাবে উপড়ে ফেলা আমাদের জনগণের ঐক্যবদ্ধ ইচ্ছা। এ ক্ষেত্রে সরকার সব রাজনৈতিক দল ও প্রত্যেক ভারতীয় নাগরিকের পরিপূর্ণ ও অবিচলিত সমর্থনে আশ্বস্ত হতে চায়। দীর্ঘ কষ্ট ও ত্যাগের জন্য আমাদের অবশ্যই প্রস্তুত হতে হবে।

আমরা শান্তিপ্রিয় জনগণ। কিন্তু আমরা জানি যে শান্তি স্থায়ী হতে পারে না, যদি আমরা আমাদের গণতন্ত্র এবং জীবনধারাকে পাহারা দিয়ে না রাখতে পারি। সুতরাং, আজ শুধু আমাদের সীমানার অখণ্ডতার জন্য লড়ছি না, আমরা আমাদের মৌলিক আদর্শকে রক্ষার জন্যও লড়ছি। এই আদর্শ আমাদের দেশকে শক্তি জোগাচ্ছে এবং এর ওপর ভিত্তি করে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ অগ্রগতি নিশ্চিত করতে পারব।

আগ্রাসনকে অবশ্যই মোকাবিলা করতে হবে। ভারতের জনগণ এ আগ্রাসন মোকাবিলা করবে বীরত্বপূর্ণ সহিষ্ণুতা ও সংকল্প দিয়ে এবং শৃঙ্খলা ও সর্বোচ্চ ঐক্য দিয়ে।

লোকসভায় বাংলাদেশকে ভারতের স্বীকৃতি

৬ ডিসেম্বর ১৯৭১

বাংলাদেশের জনগণের সাহসী সংগ্রাম মুক্তির আন্দোলনের ইতিহাসে বীরত্বের নতুন অধ্যায় খুলে দিয়েছে।

এর আগে, তারা তাদের সাধারণ নির্বাচনে একটা বড় গণতান্ত্রিক বিজয় অর্জন করেছিল। সেই বিজয়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অধিকার স্বীকার করে নিয়েছিলেন। আমরা কখনোই জানতে পারব না কিসের প্ররোচনায় এই কল্যাণবোধ ও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ বদলে গেল। সেটা যদি সত্যিই হবে, তাহলে এত প্রতারণা ও ঘৃণার প্রকাশই-বা কেন?

আমরা বলি যে শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর দল আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারকে প্রতিরোধ করার জন্য অহিংস আন্দোলনের পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু তাদের ওপর হঠাৎ করেই বর্বর সামরিক হামলা চালানো হয়। এ পরিস্থিতিতে স্বাধীনতা ঘোষণা ছাড়া তাদের সামনে আর কোনো বিকল্প ছিল না। ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট মিলে মুক্তিফৌজ গঠন করে, পরে সেটি মুক্তিবাহিনীতে পরিণত হয়। পূর্ব বাংলার হাজার হাজার তরুণ তাদের স্বাধীনতা এবং ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের জন্য জীবন উৎসর্গের সংকল্প নিয়ে এই বাহিনীতে যোগ দেয়। বাংলাদেশের সমগ্র জনগোষ্ঠী যে ঐক্য, সংকল্প ও সাহস নিয়ে লড়ছে, সেটা বিশ্ব গণমাধ্যমে লিপিবদ্ধ রয়েছে।

এই ঘটনা আমাদের সীমানার কাছেই ঘটছে। এর ফলে আমাদের বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর ভার বহন করতে হচ্ছে, যা আমাদের দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিচ্ছে। এটা স্বাভাবিক যে বাংলাদেশের মানুষের ন্যায়সংগত সংগ্রামে আমাদের সহানুভূতি তাদের প্রতিই থাকবে। কিন্তু তাদের স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে হঠকারিতা আমরা করিনি। কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সেটা কতটা ফলপ্রসূ হচ্ছে ও ভবিষ্যতে সেটার প্রভাব কী, সেই বাস্তবতার নিরিখেই নিতে হয়।

জনগণের প্রতিরোধ

বাংলাদেশের জনগণের সর্বসম্মত প্রতিরোধ এবং তাদের সংগ্রামের সফলতায় এটা ক্রমাগত স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে তথাকথিত মাতৃরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষে বাংলাদেশের জনগণকে আর নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব নয়।...

এখন পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছে। আমাদের দিক থেকে একটা সাধারণ দ্বিধা হচ্ছে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের কোনো পথ এখনো খোলা আছে কি না। কিংবা আমাদের কোনো পদক্ষেপ হস্তক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হবে কি না। সেটা যদি হয়, তাহলে বিষয়টা তার গুরুত্ব হারাবে। বাংলাদেশের জনগণ তাদের মৌলিক অস্তিত্ব রক্ষায় যুদ্ধ করছে আর এখন ভারতের জনগণ তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া আগ্রাসনকে পরাজিত করতে লড়াই করছে। এই দুই স্বার্থ আমাদের এক পক্ষভুক্ত করেছে।

বাংলাদেশের স্বীকৃতি

আমি আনন্দের সঙ্গে লোকসভাকে জানাতে চাই যে বিদ্যমান পরিস্থিতির আলোকে এবং বাংলাদেশ সরকারের কয়েকবারের অনুরোধে সাড়া দিয়ে এবং ভারত সরকার সর্বোত্তম সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনার পর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এটা আমাদের আশা, সময়ের ব্যবধানে আরও অনেক রাষ্ট্র গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে এবং খুব শিগগির তারা জাতিসংঘের সদস্য হবে।

এই মুহূর্তে আমাদের ভাবনা নতুন এই রাষ্ট্রের পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘিরে। আমি নিশ্চিত যে এই আইনসভা তাদের পক্ষ থেকে আমাকে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর সহকর্মীদের কাছে শুভেচ্ছা ও উষ্ণ অভিনন্দন পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ দেবে।

বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে যে বার্তা আমরা পেয়েছি, সেটার একটা অনুলিপি আইনসভার টেবিলে উত্থাপন করছি। মাননীয় সদস্যদের আমি আনন্দের সঙ্গে জানাতে চাই, বাংলাদেশ সরকার তাদের রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সাম্যভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠাকে (যেখানে ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ কিংবা বিশ্বাসের কারণে বৈষম্য করা হবে না) গ্রহণ করেছে। বিদেশনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার জোটনিরপেক্ষতা, শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান এবং উপনিবেশবাদ, বর্ণবাদ, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী অবস্থান ঘোষণা করেছে। এই সব আদর্শ ভারতও লালন করে।

সূত্র: বাংলাদেশ ডকুমেন্ট, খণ্ড ১ ও ২, ইউপিএল, ঢাকা

অনুবাদ: মনোজ দে