তুরস্কের সমুদ্রসৈকতে পড়ে থাকা সিরীয় শিশু আয়লান কুর্দির ছোট্ট নিথর দেহের ছবিটি কারও ভোলার কথা নয়। ২০১৫ সালে তার ছবিটি পত্রপত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে বড় ধরনের ঝাঁকুনি খায় অভিবাসী-সংকট নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ইউরোপ। ঘুম ভাঙে বিশ্ববাসীরও। বদলে যায় অভিবাসীদের বিষয়ে অনেকের দৃষ্টিভঙ্গি।
বিপজ্জনকভাবে ইউরোপে পাড়ি জমাতে গিয়ে ভূমধ্যসাগরে ডুবে প্রতিবছর অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারান। এই দুর্ভাগাদের দলে থাকা বেশির ভাগই এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার। ভাগ্যবদলের স্বপ্ন নিয়ে দুচোখ যখন ইউরোপের দিকে হাতছানি দিয়ে ডাকে, ঠিক তখনই সলিলসমাধি ঘটে এসব মানুষের অনেকের। এ দলে বাংলাদেশিদের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। করোনা মহামারির কারণে বিশ্বজুড়ে ভ্রমণ বিধিনিষেধ থাকায় গত বছরে প্রাণঘাতী এ যাত্রায় তুলনামূলক কম লোক শামিল হলেও ২০২১ সালে আবার বাড়তে শুরু করে অবৈধপথে ইউরোপ যাত্রা।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) মতে, অতীতের মতো ২০২১ সালেও অনিশ্চিত ওই যাত্রায় শেষ পর্যন্ত অনেকে টিকে থাকতে পারেননি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, এ বছরের জুলাই পর্যন্ত ৭ হাজার ৪১৮ জন অভিবাসী ও শরণার্থী সমুদ্রপথে স্পেনের ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে পৌঁছেছিলেন। এ যাত্রাকালে প্রাণ হারান অন্তত ২৫০ জন।
অভিবাসন নিয়ে কাজ করা স্প্যানিশ এনজিও ক্যামিনান্দো ফ্রন্টেরাসের (ওয়াকিং বর্ডারস) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মৃত মানুষের এ সংখ্যা আইওএমের অনুমানের চেয়ে ৮ গুণ বেশি হতে পারে। ডুবে যাওয়া অভিবাসীবোঝাই অনেক নৌকার হদিস পর্যন্ত মেলেনি।
ইউরোপের সীমান্তরক্ষী বাহিনী ও কোস্টগার্ডের সমন্বয়ে গঠিত ‘ফ্রনটেক্স’-এর তথ্য অনুযায়ী, এ বছর নভেম্বর পর্যন্ত ১ লাখ ৮৪ হাজার ১৮০ জন অভিবাসী অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশ করেছেন। করোনা মহামারি শুরুর আগের সময়ের তুলনায় এ সংখ্যা প্রায় ৬০ শতাংশ বেশি। আর ২০১৯ সালের তুলনায় বেশি ৪৫ শতাংশ।
বিপজ্জনক এ ইউরোপ যাত্রায় বেশ কয়েকটি রুটকে (পথ) অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে ফ্রনটেক্স। এগুলোর মধ্যে মধ্যভূমধ্যসাগরীয় রুট সবচেয়ে বিপজ্জনক। ইউরোপে অবৈধভাবে প্রবেশের ক্ষেত্রে অভিবাসীদের পছন্দের শীর্ষে এ রুট। নভেম্বর পর্যন্ত রুটটি ব্যবহার করে প্রায় ৬৪ হাজার ৪০০ জন অবৈধ অভিবাসী ইউরোপে প্রবেশ করেন; যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ৮৯% বেশি ও ২০১৯ সালের তুলনায় বেশি ৩৮০%। এই পথে গমনাগমনকারীদের মধ্যে শীর্ষে আছেন তিউনিসীয়, মিসরীয় ও বাংলাদেশিরা। বাংলাদেশিরা মূলত লিবিয়া থেকে এ পথ ব্যবহার করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি জমান। তাঁদের মূল গন্তব্য থাকে ইতালি।
ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়া লোকজনের মধ্যে শীর্ষে বাংলাদেশের নাগরিকেরা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লিবিয়া থেকে সাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে ২১ জুন নৌকাডুবিতে ১৭ বাংলাদেশি প্রাণ হারান। ওই যাত্রায় তিউনিসিয়ার কোস্টগার্ড ভূমধ্যসাগর থেকে বাংলাদেশিসহ ৩৮০ জনকে জীবিত উদ্ধার করে। এর আগে গত ২৪ জুন ২৬৭ জনকে উদ্ধার করে তিউনিসিয়ার কোস্টগার্ড; যাঁদের মধ্যে ২৬৪ জনই বাংলাদেশি।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সাল থেকে এ বছরের জুন পর্যন্ত নানা দেশের মোট ২২ লাখ ২৪ হাজার ২৪৫ জন অভিবাসী এভাবে সাগরপথ পাড়ি দিয়ে ইউরোপে এসেছেন। নৌকাডুবিসহ নানা কারণে পথে প্রাণ হারিয়েছেন ২১ হাজার ৭০৭ জন।
ব্র্যাকের গবেষণায় দেখা গেছে, ২৬ থেকে ৪০ বছর বয়সী লোকজন সবচেয়ে বেশি ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করছেন। তাঁদের মধ্যে ৩১ থেকে ৩৫ বছরের লোকই বেশি। গত কয়েক বছরে ইউরোপ ও লিবিয়া থেকে ফেরত আসা ২ হাজার ২৮৪ বাংলাদেশির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মাদারীপুর, মুন্সিগঞ্জ, শরীয়তপুর, ঢাকা, নোয়াখালী, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা জেলা থেকে বেশি লোক এভাবে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। একেকজন ইউরোপে যেতে ৩ থেকে ১৫ লাখ টাকা খরচ করেছেন।
মধ্য ভূমধ্যসাগরীয় রুটের পর বাংলাদেশিরা বেশি ব্যবহার করেন বলকান রুট। গত কয়েক বছরে এ রুট দিয়ে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার বাংলাদেশি ইউরোপে গেছেন। এভাবে ঢুকতে গিয়ে বসনিয়ার জঙ্গলে এখনো শতাধিক বাংলাদেশি আটকে আছেন। তাঁদের মধ্যে একজন তাহসান (ছদ্মনাম)। ভূমধ্যসাগর পার হয়ে তাঁর ইতালিযাত্রার কিছু দুঃসহ স্মৃতি তুলে ধরা হলো:
মার্চ মাস। রাত আনুমানিক দুইটা। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের প্রায় ৩৫ জন পুরুষের একটি দল বসনিয়া থেকে ক্রোয়েশিয়া সীমান্ত অতিক্রম করে। বসনিয়া সীমান্ত থেকে ইতালি পর্যন্ত ঘন জঙ্গল ও তুষারাবৃত পাহাড়ের মধ্য দিয়ে তাঁদের দুই সপ্তাহের যাত্রা শুরু হয়। সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার এই চেষ্টাকে অভিবাসীরা ‘খেলা’ বলে থাকেন। তবে তাঁদের এ ভ্রমণ কখনো খেলার মতো হালকাভাবে নেওয়া যায় না, কিংবা প্রচলিত কোনো ভ্রমণের সঙ্গেও তুলনা করা যায় না। নিজেদের সব জামাকাপড় ও ১৪ দিনের জন্য প্রয়োজনীয় খাবারদাবার পিঠে বহন করে চলছিলেন তাঁরা।
যাত্রার একপর্যায়ে দলের সদস্যরা ২০ কিলোমিটার হেঁটে গ্লিনা নদীতে পৌঁছান। ২২ বছর বয়সী তাহসানের মতে, ওই নদী প্রায় ২৫ মিটার চওড়া। মার্চে দিনের বেলা মোটামুটি গরম থাকলেও সীমান্ত এলাকায় রাতের তাপমাত্রা রাতে মাইনাস ১ বা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে যায়। এমন হাড়কাঁপানো ঠান্ডার মধ্যেই অনেকে লাফ দিয়ে সাঁতারে নদী পার হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু একজন ঠান্ডার কারণে সাঁতার কাটতে না পেরে পানিতে ডুবে যান। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ ছিল যে ডুবে যাওয়া ব্যক্তিকে উদ্ধারের চেষ্টা করাও সম্ভব হচ্ছিল না কারও পক্ষে।
তাহসানের সঙ্গে আরও অন্তত পাঁচ বাংলাদেশি ও ৩০ পাকিস্তানি ছিলেন। তাঁদের অনেকে সাঁতার জানতেন না। ওই ব্যক্তির ডুবে যাওয়ার দৃশ্য দেখে সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এ কারণে ঝুঁকি নিয়ে আধা কিলোমিটার দূরে একটি সেতুর ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন অনেকে। কিন্তু সেতুর ওপর দিয়ে পার হওয়া ছিল আরও ঝুঁকিপূর্ণ। সেখানে গেলে যেকোনো সময় পুলিশের হাতে ধরা পড়ার সম্ভাবনা ছিল। এ কারণে তাহসানের সঙ্গে থাকা বাংলাদেশিরা সাঁতরে, অনেক কষ্টে নদী পার হন।
ভাববেন না, নদী পার হয়েই ওই দলের সদস্যরা ইউরোপের মুক্ত হাওয়া খেয়ে বেরিয়েছেন। বরং সেখানে (ক্রোয়েশিয়া) গিয়ে ভোর হওয়ার জন্য বা নদীর পানি গরম হওয়ার জন্যও অপেক্ষা করতে পারেননি তাঁরা। কেননা, সেখানে প্রতি মিনিটই ছিল তাঁদের কাছে এক বিপজ্জনক ‘খেলার’ মতো। পুলিশের দেখা না পাওয়া পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্ত ছিল গন্তব্যের দিকে যাওয়ার সুযোগ। আবার প্রতিটি মুহূর্ত ছিল ধরা পড়ার ভয়–আতঙ্কে জড়ানো।
সীমান্ত পার হওয়ার পর সকাল হলেও তাপমাত্রা ছিল শূন্যের নিচে। তাহসান বলেন, ‘আবহাওয়া এতই ঠান্ডা যে আমাদের হাত ঠিকমতো কাজ করছিল না। হাতের রং পাল্টে কালো হয়ে যাচ্ছিল। আঙুল জমে যাওয়ায় শুকনো জামাকাপড়ের জন্য তিনি ব্যাগটা পর্যন্ত খুলতে পারেননি।’
শেষ পর্যন্ত এ দলের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়। পরের দিনই ক্রোয়েশীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে দলটি ধরা পড়ে যায়। শেষমেশ দুটি বড় ভ্যানে করে সীমান্তে ফিরিয়ে নিয়ে বসনিয়ায় ঠেলে দেয় তারা।
মূলত অভিবাসী ও শরণার্থীরা পশ্চিম ইউরোপ যাত্রায় বলকান অঞ্চলের জঙ্গলকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করেন। এ কঠিন যাত্রায় অনেকে দুর্ঘটনাজনিত আঘাত ও ১৯৯০-এর দশকের যুগোস্লাভ যুদ্ধে অক্ষত রয়ে যাওয়া ল্যান্ডমাইনে পা দিয়ে প্রাণ হারান।
এ যাত্রার সবচেয়ে বিপজ্জনক বাধা হলো গ্রামাঞ্চলের মধ্য দিয়ে যাওয়া অসংখ্য নদ–নদী; যা অভিবাসীদের গন্তব্যে পৌঁছাতে পার হতে হয়।
মধ্য ভূমধ্যসাগর ও পূর্ব ইজিয়ান সাগরে ডুবে যাওয়া অভিবাসীদের দুর্দশার কথা ভালোভাবে নথিভুক্ত করা হলেও, বলকান অঞ্চলের বিভিন্ন নদ–নদীতে মৃত্যুর ঘটনাগুলোর দিকে খুব কমই মনোযোগ দেওয়া হয়। ভূমধ্যসাগরের লিবিয়া উপকূলে টহল দেয় বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও উদ্ধারকারী জাহাজ, আছে আন্তর্জাতিক হটলাইন। কিন্তু বলকান অঞ্চলে এমন উদ্যোগ তেমনটা চোখে পড়ে না। ফলে এ অঞ্চলে নৌকাডুবিতে মারা যাওয়া অভিবাসী বা অন্যান্য দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর ঘটনা রেকর্ড করার কোনো সর্বজনীন ডেটাবেস নেই।
তবে বলকান অঞ্চলে যে গুটি কয়েক বেসরকারি ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সংস্থা কাজ করে, তার মধ্যে রয়েছে ডেনিশ রিফিউজি কাউন্সিল (ডিআরসি)। সংস্থাটি ২০১৯ সালের আগস্ট থেকে বসনিয়া অঞ্চলে উদ্বাস্তু বা অভিবাসী ডুবে যাওয়ার ১৯টি ঘটনা রেকর্ড করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃত সংখ্যা অবশ্যই অনেক বেশি, যদিও তা নির্ধারণ করা অসম্ভব। ডিআরসির গত ছয় মাসের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এ অঞ্চলে অভিবাসীদের মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে বাংলাদেশিরা। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ক্রোয়েশিয়ায় ঢুকে ইতালি কিংবা জার্মানিতে প্রবেশ করতে সক্ষম হলেও অনেকে ব্যর্থ হন। তাঁদের পুশব্যাক করা হয় বসনিয়ায়।
ক্রোয়েশিয়া সীমান্তবর্তী উত্তর-পশ্চিম বসনিয়ার ভেলিকা ক্লাদুসাতে অনেক শরণার্থী শিবির আছে। শিবিরের বাসিন্দাদের মধ্যে আছেন কিছু বাংলাদেশিও। এসব শরণার্থীর ভবিষ্যৎ অনেকটাই অনিশ্চিত। ভাগ্যবদলের স্বপ্ন নিয়ে প্রিয় মাতৃভূমি ছেড়ে এখনো অবৈধ পথে ইউরোপ পাড়ি জমাচ্ছেন যে বাংলাদেশিরা, তাঁদের অনেকেরও সে স্বপ্ন হোঁচট খেয়ে বেড়াচ্ছে ওই শরণার্থীদের মতোই ইউরোপের জলে–জঙ্গলে।
তথ্যসূত্র: রয়টার্স, আল-জাজিরা, ইউএনএইচসিআর, আইওএম, ব্র্যাক