>
- গরিবের অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহারে ফি দিতে হয় না
- পার্কে খেলা করে বিভিন্ন কাজে আসা অভিভাবকদের শিশুরা
- কার্যালয়ের ভেতরে গ্রন্থাগার আছে
কার্যালয়ের সামনে শিশুপার্ক। তাতে নানা প্রাণীর ভাস্কর্য। পরিপাটি সেই পার্কে খাঁচায় আছে নানা রকম পোষা পাখি। অ্যাকুরিয়ামে মাছ। ফটকে সার্বক্ষণিক দাঁড়িয়ে একটি অ্যাম্বুলেন্স। কার্যালয়ের ভেতরে গ্রন্থাগার। এটি কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার ভিতরবন্দ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) কার্যালয়। চেয়ারম্যান আমিনুল হক খন্দকার একে গড়েছেন নিজের মতো করে।
পার্কের বাঁ পাশে একটু উঁচুতে বসার আসন। সেখানে কথা হয় আমিনুল হকের সঙ্গে। তিনি বলেন, চেয়ারম্যান হওয়ার পর যখন তিনি ভিজিএফ, ভিজিডিসহ বিভিন্ন প্রকল্পের চাল বিতরণ শুরু করেন, তখন কার্ডধারী নারীদের সঙ্গে শিশুরা আসত। শিশুদের কেউ কেউ অপেক্ষা সইতে না পেরে কান্নাকাটি করত। তাদের সামলাতে জেরবার অবস্থা হতো মায়েদের। এসব দেখে তিনি কার্যালয়ের সামনে শিশুদের খেলাধুলার ব্যবস্থা করার কথা ভাবেন। ২০১৫ সালের শেষ দিকে তিনি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অনুমতি নিয়ে সামনের জায়গায় কয়েকটি দোলনা বসান। তা পেয়ে শিশুদের সে কী আনন্দ! এরপর তিনি পার্কটির পরিসর বাড়াতে থাকেন।
জেলার একমাত্র বাল্যবিবাহমুক্ত ইউনিয়ন এটি। জেলায় পরপর দুবার শ্রেষ্ঠ ইউপি চেয়ারম্যান হয়েছেন আমিনুল হক। এর সুবাদে পেয়েছেন সরকারিভাবে বিদেশ ভ্রমণের সুযোগ। এসব কিছু ইতিবাচক কাজের প্রতি তাঁর উৎসাহ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। নিচ্ছেন নতুন কিছু উদ্যোগ।
আমিনুল হককে অনুসরণ করে সদর উপজেলার ঘোগাদহ ইউপির চেয়ারম্যান শাহ আলম মিয়া তাঁর ইউনিয়নের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সামনে গড়ে তুলছেন শেখ রাসেল শিশুকর্নার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ভিতরবন্দের চেয়ারম্যান আমিনুল হকের কাছেই তিনি এর অনুপ্রেরণা পেয়েছেন।
ভিতরবন্দ ইউপি কার্যালয়ের পাশেই ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র। দুই প্রতিষ্ঠানের মাঝের প্রায় দুই বিঘা জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে শিশুপার্কটি। পার্কে ঢোকার মুখে ডান পাশে রয়েছে পাখিদের আবাস। খাঁচায় নানা প্রজাতির বিদেশি পোষা পাখি কিচিরমিচির করছে। আছে একটি অ্যাকুরিয়ামও। সেখানে খেলা করছে কয়েক প্রজাতির মাছ।
সরেজমিনে দেখা যায়, পাখির খাঁচা ও বসার আসনের মাঝখান দিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ভবনে ঢোকার রাস্তা। এর দুই পাশে সারি করে বসানো নানা প্রাণীর ভাস্কর্য। শুরুতেই দুই পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাঘ ও সিংহমূর্তি। গলা উঁচু করে রয়েছে জিরাফ, এক পায়ে ভর দিয়ে রয়েছে ধ্যানমগ্ন বকও। পার্কে রয়েছে ড্রাগন, রম্বুটান, চীনা লেবু থেকে শুরু করে আপেল, কমলা গাছ। বারোমাসি গাছে ফলে আছে সফেদা। গাছে ফুটে আছে সাদা জবা। ছোট্ট কৃত্রিম জলাধারে পদ্ম।
পার্কের দুই পাশের দেয়াল ঘুরিয়ে দেখালেন আমিনুল। এক পাশের দেয়াল যেন পুরো বাংলাদেশ! আরেক দেয়াল যেন বিজ্ঞানের কল্যাণে সভ্যতার এগিয়ে যাওয়ার প্রমাণ। এখানে চাকা আবিষ্কার থেকে কম্পিউটার পর্যন্ত আবিষ্কারের কাহিনি চিত্রিত আছে।
পার্কে ঘুরছিল পাশের নৈয়ারহাট কলেজের একদল ছাত্রী। মালেকা বেগম ও সোনিয়া খাতুন জানায়, কলেজে ক্লাস শেষে তারা পার্কে ঘুরতে এসেছে। এখানে এলে অনেক কিছু চোখে দেখে শেখা যায়। ঘুরে আনন্দও পাওয়া যায়।
দোলনায় দোল খাচ্ছিল কয়েকটি শিশু। তাদের মধ্যে আরফান আলী, জাহানুদ্দি ও কাজলী বলল, তারা মায়ের সঙ্গে বেড়াতে এসেছে। দোল খেতে তাদের খুব ভালো লাগে।
নাগেশ্বরী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শঙ্কর কুমার বিশ্বাস বলেন, ভিতরবন্দের শিশুপার্কটি শুধু বিনোদনের উৎস নয়, সবার জন্য শিক্ষণীয়ও। মানুষ বই পড়ে যা শেখে, এখানে তার অনেক কিছুই দেখতে পাবে।
শিশুপার্কের সামনেই ভিতরবন্দ ইউপি কার্যালয়ের ভবন। এর একটি চেয়ারম্যানের কক্ষ। আরেকটিতে এজলাস। এই কক্ষে মূলত গ্রন্থাগার গড়ে তুলেছেন আমিনুল হক। কুড়িগ্রামের ইতিহাস-ঐতিহ্য থেকে শুরু করে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রের সব কটি খণ্ড।
আমিনুল হক বলেন, এখানে নাম নিবন্ধন করে বিনা মূল্যে যে কেউ বই নিতে পারেন। এক সপ্তাহের মধ্যে বই ফেরত দিতে হয়। এরপর চাইলে আবার একই বইয়ের জন্য সময় নেওয়া যায়। নতুন বই তো নেওয়াই যায়। আস্তে আস্তে পাঠক বাড়ছে। কেউ বই দিতে চাইলে এখানে দিতেও পারেন বলে জানান তিনি।
এ গ্রন্থাগার থেকে নিয়মিত বই নেন কামরুন্নাহার বেগম। তিনি বলেন, হুমায়ূন আহমেদ ও মুহম্মদ জাফর ইকবালের অনেক বই নিয়েছেন তিনি। সেগুলো নিজে পড়েছেন, সন্তানদেরও পড়তে দিয়েছেন।
গরিবের অ্যাম্বুলেন্স
ইউনিয়নের গরিব মানুষকে জরুরি চিকিৎসাসেবা দিতে একটি অ্যাম্বুলেন্স সংগ্রহ করেছেন আমিনুল হক। তিনি বলেন, ইউপির জন্য সরকারিভাবে অ্যাম্বুলেন্স দেওয়া হয় না। কিন্তু প্রত্যন্ত এ এলাকার নারীদের প্রসবকালীনসহ বিভিন্ন সংকটের সময়ে অন্য রোগীদের দ্রুত হাসপাতালে নিতে সমস্যা হয়। এ পরিস্থিতিতে তিনি বিষয়টি এলাকার একজন ব্যবসায়ীকে জানান। ওই ব্যবসায়ী একটি অ্যাম্বুলেন্স কিনে দেন এবং তা পরিচালনার জন্য একটি কমিটি করে দেন। এটি ব্যবহারের জন্য রোগীকে কোনো ফি দিতে হয় না। শুধু যাতায়াতের জন্য তেলের খরচ দিতে হয়।
সম্প্রতি স্থানীয় বাসিন্দা লিয়াকত আলীর শাশুড়ি মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে (স্ট্রোক) অসুস্থ হয়ে পড়েন। লিয়াকত বলেন, তখন অনেক রাত। গাড়িঘোড়া পাওয়ার উপায় ছিল না। হঠাৎ ইউপির অ্যাম্বুলেন্সের কথা মনে পড়ে। খবর দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে তা পাওয়াও যায় এবং শাশুড়িকে রংপুর মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। বড় ধরনের বিপদের হাত থেকে রক্ষা পায় রোগী। মাত্র ৬০০ টাকা তেল খরচ দিতে হয়েছে তাঁকে।
শুধু জনহিতকর কাজই নয়, আমিনুল হক চেয়ারম্যান হওয়ার পর জেলায় সবচেয়ে বেশি কর আদায় করেছেন তাঁর ইউনিয়নে। এসব কর্মকাণ্ডের ওপর ভিত্তি করে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে জেলার শ্রেষ্ঠ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। আমিনুল হক বলেন, তিনি তাঁর এলাকায় যেকোনো প্রকল্পের অধীনে চাল, গম বিতরণের আগে সে বিষয়ে মাইকিং করেন। এরপরও কেউ নির্ধারিত দিনে না এলে তাঁর জন্য বরাদ্দ রেখে দেন। এ মাইকিংয়ের সময় তিনি নানা বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচারণাও চালান। শ্রেষ্ঠ চেয়ারম্যান হওয়ার পর তিনি সরকারিভাবে একবার মালয়েশিয়া ও আরেকবার ফিলিপাইন সফরের সুযোগ পান।
জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মোছা. পারভীন সুলতানা বলেন, ভিতরবন্দ ইউপির চেয়ারম্যান আমিনুল হক খন্দকার নানা দিক থেকেই জনপ্রতিনিধিদের জন্য অনুসরণীয় হতে পারেন। তাঁর কাজ সারা দেশের জন্য মডেল হতে পারে।
আমিনুল হক খন্দকার মাত্র ২০ বছর বয়সে সৌদি আরব চলে যান। সেখানে তিনি ২২ বছর কাটান। এরপর দেশে আসেন। ২০১১ সালে প্রথমবার ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচন করেন এবং বিজয়ী হন। ২০১৬ সালে প্রথমবার জাতীয় পার্টির হয়ে নির্বাচন করেন। সেবারও তিনি বিপুল ভোটে জয়ী হন। তিনি তিন সন্তানের জনক।