সত্যেন বোস পাঠাগারটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের ছাত্র সংসদ ভবনের একটি কক্ষে।
কড়ি-বর্গার পুরোনো ভবনের দোতলায় মাঝারি এক কক্ষ। দেয়ালে ছবি হয়ে আছেন বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু, সংক্ষেপে যিনি পরিচিত সত্যেন বোস নামে। আরও আছেন স্বামী বিবেকানন্দ, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, বিপ্লবী ক্ষুদিরাম, কবি নজরুল-রবীন্দ্রনাথ, শহীদ ড. শামসুজ্জোহাসহ অনেকে। ছবির নিচে আপন আপন অমৃত বাণী। চারদিকে শেলফে বই সাজানো। মাঝে লম্বা একটি টেবিল। তার চারপাশে গোল হয়ে বসেছেন জনা পঁচিশেক পাঠক। উৎসাহজনক পরিবেশ।
তিন সদস্যের পরিচালনা কমিটির অধীনে চলছে পাঠাগারটি। ‘ইনচার্জে’র দায়িত্বে আছেন খোকন মোহন্ত। তিনি বললেন, একটি ছাত্রসংগঠনের উদ্যোগে পাঠাগারটি করা হয় ১৯৯৭ সালে। সমাজে নানা কূপমণ্ডূকতা, কুসংস্কার, প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তার বিপরীতে বিজ্ঞানমনস্কতা, প্রগতিশীল চিন্তা ও কর্মের প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পাঠাগারটির প্রতিষ্ঠা। কিন্তু তখন নির্দিষ্ট ঠিকানা ছিল না। বিভিন্ন আবাসিক হলে এই পাঠাগারের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের কক্ষে তৎপরতা চলত। বই সংগ্রহ, জমা দেওয়া, জমা নেওয়া, পাঠচক্র—সবই হতো। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে জগন্নাথ হলের ছাত্র সংসদ ভবনের এই কক্ষ তাঁরা বরাদ্দ পেয়েছেন ২০১৪ সালে। এখানে আসার পরই পাঠাগারটি একধরনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেছে বলা যায়।
আবাসিক হলের ভেতরে হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের সদস্যদের পাঠাগারে যাতায়াতে কোনো বিড়ম্বনা নেই। বেসরকারি গ্রিন ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের ছাত্র আসাদুজ্জামান। থাকেন তালতলায়। তিনি এই পাঠাগারের একজন নিয়মিত সদস্য।
বললেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তা হয়নি। তারপর একদিন পরিচয় হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইদের সঙ্গে। তাঁরা পরামর্শ দেন সত্যেন বোস পাঠাগারে এসে বইপত্র পড়ার জন্য। সেই থেকে নিয়মিত আসছেন।
পাঠাগারে ১০টি শেলফে বইয়ের সংখ্যা ১ হাজার ৪০০-এর মতো। এর মধ্যে আড়াই শ থেকে তিন শ বই আছে পাঠকদের কাছে। কিছু বই নষ্ট হয়েছে। কোন ধরনের বইয়ের প্রতি আগ্রহ বেশি, জানতে চেয়ে জানা গেল, আগ্রহটা ধ্রুপদি সাহিত্যের প্রতি, যেমন উইলিয়াম শেক্সপিয়ার, লিও টলস্টয়, উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ, আন্তন চেখভ প্রমুখ। এর বাইরে আছে অনুবাদের বই, বিশেষ করে ম্যাক্সিম গোর্কি, ভিক্টর হুগো, ড্যান ব্রাউন। এ ছাড়া বিজ্ঞানভিত্তিক বইগুলো পাঠকদের চাহিদার কেন্দ্রে থাকে। কিন্তু সমস্যা হলো, এক বইয়ের একাধিক কপির সংকট। তাই কোনো কোনো সময় এসব বই হাতে পেতে প্রতীক্ষায় থাকতে হয় পাঠকদের।
সজল কুমার দাশ পড়েন বাংলা বিভাগে, তৃতীয় বর্ষে। তিনি একাই ৩০ জনকে বইয়ের প্রতি আগ্রহী করে তুলেছেন। তাঁদের করেছেন সদস্য। বলছিলেন, ‘বই কিনে পড়তে পারি না। তাই পাঠাগারের সদস্য হয়েছি। নিজে পড়ে সমৃদ্ধ হই, বন্ধুদেরও বলি।’
খোকন মোহন্ত বলছিলেন, ‘আজকাল পাঠাগারে বসে অনেকেই চাকরির পড়াশোনা করে। সেই সুযোগ আমরা রাখিনি। এটি সত্যিকারের মৌলিক বই পড়ার জায়গা। পাঠাগারের ৭০ জন স্থায়ী সদস্যের সবাই এ বিষয়ে সচেতন।’
পাঠাগারটি সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা এবং সন্ধ্যা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত প্রতিদিনই খোলা থাকে। পাঠাগারের সুহৃদ নাঈমা খালেদ বলছিলেন কিছু সমস্যার কথা। বইপত্রসহ সম্পত্তি যা যা আছে, সবই সংগ্রহ করা। তাঁদের স্থায়ী তহবিল নেই বললেই চলে। পাঠাগারে পর্যাপ্তসংখ্যক বই নেই, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের চাহিদা মেটাতে পারে। মুখোমুখি আলাপে বোঝা গেল, পাঠাগারের সদস্যদের মধ্যে বেশ হৃদ্যতা বিদ্যমান। যাবতীয় কাজ সবাই হাসিমুখে ভাগাভাগি করে নিয়েছেন। মানুষের প্রয়োজনে নিজেকে কাজে লাগাতে বিশ্বাসী এখানকার পাঠকেরা, যে কথা বলে গেছেন বিজ্ঞানী সত্যেন বোস।