আসামিরা প্রকাশ্যে, সাক্ষীরা ভয়ে

২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতের আগুনে পুড়ে যাওয়া রামুর একটি বিহারের বুদ্ধমূর্তি। ফাইল ছবি-প্রথম আলো
২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতের আগুনে পুড়ে যাওয়া রামুর একটি বিহারের বুদ্ধমূর্তি। ফাইল ছবি-প্রথম আলো
>

• আজ ২৯ সেপ্টেম্বর রামুর বৌদ্ধবিহারে হামলার ষষ্ঠ বার্ষিকী
• হামলার ঘটনায় ১৮টি মামলার একটিরও বিচার সম্পন্ন হয়নি
• বিচার পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় বৌদ্ধরা
• বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের হতাশা

প্রভাবশালী আসামিরা জামিন নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন প্রকাশ্যে। তাঁদের ভয়ে মামলার সাক্ষীরা আদালতের চৌকাঠ মাড়াতে সাহস পাচ্ছেন না। এ অবস্থায় থেমে আছে রামুর বৌদ্ধবিহারে হামলার ঘটনায় করা ১৮ মামলার বিচার। ঘটনার ছয় বছরেও হামলাকারীরা বিচারের মুখোমুখি না হওয়ায় ক্ষুব্ধ এ সম্প্রদায়ের মানুষ।

আজ ২৯ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের রামুর বৌদ্ধবিহারে হামলার ষষ্ঠ বার্ষিকী। ফেসবুকে এক যুবকের পবিত্র কোরআন শরিফ অবমাননাকে কেন্দ্র করে ২০১২ সালের এই দিন মধ্যরাতে দুর্বৃত্তরা হামলা ও অগ্নিসংযোগ চালিয়ে ধ্বংস করে রামুর ১২টি বৌদ্ধবিহার ও ৩৪টি বসতঘর। পরের দিন ৩০ সেপ্টেম্বর অগ্নিসংযোগ করা হয় উখিয়া ও টেকনাফের আরও সাতটি বৌদ্ধবিহার ও হিন্দু মন্দিরে। এ ঘটনায় ১৯টি পৃথক মামলা করা হয়। এর মধ্যে আপসে একটি মামলার নিষ্পত্তি হলেও বাকি ১৮টি মামলার একটিরও বিচার সম্পন্ন হয়নি।

কক্সবাজার আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মমতাজ আহমদ বলেন, ২০১৫ সালে রামুর দুটি মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। কিন্তু সাক্ষীর অভাবে বিচার কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।

বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের নেতারা বলেন, ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনারকে প্রধান করে গঠিত কমিটি রামু হামলার ঘটনায় জড়িত ২০৫ জনকে অভিযুক্ত করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছিলেন। এরপর চট্টগ্রামের জেলা ও দায়রা জজের নেতৃত্বে গঠিত বিচার বিভাগীয় কমিটি ২১৮ জনকে অভিযুক্ত করে আরেকটি প্রতিবেদন দাখিল করেছিলেন। ওই দুই প্রতিবেদনে যাঁদের নাম ছিল, তাঁদের কাউকে আইনের আওতায় আনা হয়নি।

গতকাল শুক্রবার বিকেলে রামুতে কথা হচ্ছিল ভিক্ষু করুণাশ্রী মহাথেরোর সঙ্গে। তিনি বলেন, দুর্বৃত্তরা রামুর উত্তর মিঠাছড়ির পাহাড়চূড়ায় স্থাপিত ‘ভুবনশান্তি ১০০ ফুট লম্বা সিংহশয্যা গৌতম বুদ্ধমূর্তি’টি ক্ষতবিক্ষত করেছিল। কিন্তু এশিয়ার বৃহত্তম বুদ্ধমূর্তিটিকে ধ্বংস করা যায়নি। পরে রামুর বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্রের উন্মুক্ত মাঠে বুদ্ধমূর্তিটি স্থাপন করা হয়। ভিক্ষু করুণাশ্রী মহাথের এই ভাবনা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক।

গৌতম বুদ্ধমূর্তির পাশে দাঁড়িয়ে করুণাশ্রী মহাথের বলেন, সেদিন পালাক্রমে রামুর ১২টি প্রাচীন বৌদ্ধবিহার ধ্বংস করা হলো। কেন এই হামলা—তা দীর্ঘ ছয় বছরেও জানা হলো না।

ভাবনা কেন্দ্রে কথা হয় গৌতম বুদ্ধমূর্তিকে শ্রদ্ধা জানাতে আসা কয়েকজন ভক্তের সঙ্গে। 

তাঁদের একজন নয়ন বড়ুয়া (৪৫) বলছিলেন, ‘চোখের সামনে যারা এই বুদ্ধমূর্তিটি ধংস করতে এসেছিল, তারা দিব্যি এলাকায় ঘোরাফেরা করছে। বিচার পাব—সেই আশাও ছেড়ে দিয়েছি।’ 

বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের হতাশা ও পুলিশের ভাষ্য
কক্সবাজার আদালতের পুলিশ পরিদর্শক কাজী মো. দিদারুল আলম বলেন, ১৮টি মামলা কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতসহ অধীন বিভিন্ন নিম্ন আদালতে বিচারাধীন। কিন্তু মামলার সাক্ষী বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কেউ আদালতে এসে সাক্ষ্য দিচ্ছেন না। তাই বিচার কার্যক্রমে বিলম্ব ঘটছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিচারাধীন ১৮ মামলার (রামুর সাতটি, উখিয়ায় সাতটি, টেকনাফে দুইটি ও কক্সবাজার সদরের দুইটি) আসামি ৯৯৫ জন। আসামিদের মধ্যে রয়েছেন, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান (বহিষ্কৃত) তোফাইল আহমদ, কক্সবাজার পৌরসভার সাবেক মেয়র সরওয়ার কামাল, উখিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান (বহিষ্কৃত) ও উখিয়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি সরওয়ার জাহান চৌধুরী, উখিয়া উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা সুলতান মাহমুদ চৌধুরী, জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ও জেলা জামায়াতের সাবেক সেক্রেটারি শাহজালাল চৌধুরী, জামায়াত নেতা ভিপি বাহাদুর প্রমুখ।

কক্সবাজার আদালতের পিপি মমতাজ আহমদের ভাষ্য, মামলার ভবিষ্যৎ ভালো না। সাক্ষীদের ধরে আনলেও আদালতে হামলার ব্যাপারে মুখ খুলছেন না। সাক্ষীদের বেশির ভাগই বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোক। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীরা যদি সাক্ষ্য না দেন, তাহলে অপরাধীরা সহজে পার পেয়ে যেতে পারেন। হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া ১৮ মামলার সব আসামি ইতিমধ্যে জামিনে মুক্ত হয়েছেন।

তিনটি মামলার আসামি নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান (বহিষ্কৃত) তোফাইল আহমেদ। তাঁর ভাষ্য, হামলার রাতে তিনি বিজিবি ও পুলিশের সহযোগিতায় নাইক্ষ্যংছড়ির ৪২টি মন্দির রক্ষা করেছিলেন। তারপরও তাঁকে রামুর তিনটি বৌদ্ধমন্দির হামলার মামলার আসামি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে তিনি কয়েক মাস জেলও খেটেছেন। বিচারকাজ সম্পন্ন না হওয়ায় তিনিও হতাশ বলে জানালেন।

কোনো মামলার বিচার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন রামু উপজেলা বৌদ্ধ ঐক্য ও কল্যাণ পরিষদের সাধারণ সম্পাদক তরুণ বড়ুয়া। তিনি বলেন, ‘হামলার এক বছরের মাথায় আমরা ধ্বংসস্তূপের ওপর নতুন বৌদ্ধবিহার পেয়েছি। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজনকে নিরাপত্তাও দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু হামলার ঘটনায় যারা জড়িত ছিল তারা আইনের আওতায় আসেনি। তারা এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাই নিরাপত্তার কারণে বৌদ্ধরা সাক্ষ্য দিতে সাহস পাচ্ছে না।’

মামলার সাক্ষীদের সাক্ষ্য দিতে অনাগ্রহের বিষয়টি স্বীকার করেন রামু বৌদ্ধ ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও পুরাকীর্তি সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু। তিনি বলেন, মামলার দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেক সাক্ষী নিজেদের নিরাপত্তা, লাভ–ক্ষতি চিন্তা করে আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা দিয়ে যাচ্ছি। মামলার সাক্ষীদের নিরাপত্তা দেওয়ার কথা আমরা বলেছি। তবু তাঁরা আসছেন না।’