বাকের এবং বদি—হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয় দুই চরিত্র। কাল্পনিক চরিত্র হলেও নাম দুটো কিন্তু বাস্তব মানুষের। কারা তাঁরা? এই দুজন ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের দুই শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। সত্যিকারের বাকের এবং বদির খোঁজ জানিয়েছেন আনিসুল হক
ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে বসে আছি। অক্টোবর ২০১৮-এর শেষে।
হাসপাতালের লবিতে আমার সঙ্গে আমার ভাইবোন। আমার আম্মা সিসিইউতে, লাইফ সাপোর্টে, মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন।
সবাই খুব উদ্বিগ্ন।
এর মধ্যে একজন ভদ্রমহিলা এগিয়ে এলেন আমার দিকে। আপনি কি একটু আমার হাজব্যান্ডকে দেখতে আসবেন? ওর ক্যানসার। দিন ফুরিয়ে আসছে। ওর একটা শখ ছিল আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার। আমরা প্রথম আলোয় গিয়েওছিলাম। ও বাকেরের ভাই।
আমি বললাম, কোন বাকের? শহীদ বাকের?
জি। শহীদ বাকের।
আমি বললাম, চলেন।
আমিও বহুদিন ধরেই ভাবছিলাম, শহীদ বাকেরের পরিবার-পরিজনের সঙ্গে দেখা করতে হবে। আজ আমার জীবনে সেই সুযোগ এল।
তেমনিভাবে সুযোগ এসে গেল শহীদ বদির পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করার। সেটা আরও কয়েক দিন পরে। সেই গল্পে একটু পরে আসছি।
আমরা সবাই বাকের আর বদি নাম জানি। হুমায়ূন আহমেদ নাম দুটোকে বিখ্যাত করে গেছেন। হুমায়ূন আহমেদের একটা অভ্যাস ছিল, তিনি বাস্তব মানুষের নাম নিয়ে কাল্পনিক গল্প লিখতেন। আনিস সাবেত ছিলেন হুমায়ূন আহমেদের বন্ধু। তাঁর স্মরণে হুমায়ূন আহমেদ বহু বইয়ে আনিস নামে চরিত্র সৃষ্টি করে গেছেন। শ্যামলছায়া উপন্যাসে এমনকি তিনি কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমান, শওকত আলী এই ধরনের নামেও চরিত্র তৈরি করেছেন।
বাকের এবং বদি নামের বিখ্যাত দুই হুমায়ূন চরিত্রের নামকরণও করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের আসল দুই শহীদের নাম থেকে।
আগুনের পরশমণির নায়কের নাম বদিউল আলম। এই উপন্যাস থেকে হুমায়ূন আহমেদ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। বদিউল আলম চরিত্রে অভিনয় করেন আসাদুজ্জামান নূর।
কোথাও কেউ নেই—হুমায়ূন আহমেদের বিখ্যাত উপন্যাস এবং টেলিভিশন নাটক। এই কাহিনির দুটো গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র বাকের ভাই আর বদি।
বাকের নামটা হুমায়ূন নিয়েছিলেন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য শহীদ আবু বকরের নাম থেকে। বিএকেআর, বাকর—আবু বকর এভাবেই ইংরেজিতে নিজের নাম লিখতেন। সেটাই লোকের মুখে মুখে হয়ে গিয়েছিল বাকের।
হুমায়ূন আহমেদও তাঁকে শহীদ বাকের নামেই চিনতেন।
পরবর্তীকালে কোথাও কেউ নেই উপন্যাসে তিনি বাকের এবং বদি দুটো নামই ব্যবহার করেন।
কাজেই যখনই শহীদ বাকেরের ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করার প্রস্তাব এল, নিজের আম্মার সংকটাপন্ন অবস্থাতেও সেই সুযোগ গ্রহণ করতে আমি বিন্দুমাত্র দ্বিধা করলাম না।
ছয়তলায় কেবিনে গিয়ে আমি বিখ্যাত ডাক্তার মো. আবু মোজাফফর সাহেবের সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি রোগীদের পোশাক পরিহিত অবস্থায় বেডে শুয়ে ছিলেন। তাঁর স্ত্রী সামিনা বললেন, এই যে আনিসুল হক এসেছেন।
তিনি আমাকে দেখে শোয়া থেকে আধা শোয়া হলেন। বিছানায় হেলান দিয়ে বসলেন।
তিনি বললেন, আপনাকে আমরা খুঁজছি। আমার শহীদ ভাইয়ের কথা আপনাকে বলে যেতে চাই। তিনি গল্প করতে লাগলেন।
শহীদ আবু বকর সৈয়দপুরে বড় হয়েছেন। তাঁদের আব্বা আবু জাফরের ছিল রেলের চাকরি। বদলি হতেন। সৈয়দপুরেই বকরের জন্ম হয়। তাঁরা চট্টগ্রামে বদলি হয়ে যান। তারপর ঢাকায় গুলশানে তাঁরা একটা প্লট পান। বকরের আব্বা সেখানে বাড়ি করেন।
১৯৫৩ সালে জন্ম হয়েছিল বকরের। কায়েদে আজম কলেজে পড়তেন। এখন যেটা সোহরাওয়ার্দী কলেজ।
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে বকর ২ নম্বর সেক্টরে খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বাধীন গেরিলা দলে যোগ দেন। আগরতলা মেলাঘর থেকে ট্রেনিং নিয়ে ফিরে আসেন। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গ্রেনেড চার্জ করেছিলেন যে গেরিলারা, বকর ছিলেন তাঁদেরই একজন।
তাঁর আরও কিছু অপারেশনের কথা শুনি বকরের ভাইয়ের মুখে। বাড়িতে এলে কিছু জানালেন ছোট ভাই আবু হায়দার। বকরের প্রথম অপারেশন ছিল কুমিল্লার গোমতী নদীর কোনো এক অংশে। নিজে সাঁতার জানতেন না। লাইফ জ্যাকেট পরে নেমে পড়েছিলেন নদীতে। এসএলআরের মাথায় রকেট লঞ্চার লাগিয়ে পাকিস্তান আর্মির গানবোটে শুট করেন। তাদের অস্ত্র-টাকাপয়সা নিয়ে ফিরে যান মেলাঘরে।
ঢাকার মুগদাপাড়ায় এক রাজাকারের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছিলেন এলাকাবাসী। এই রাজাকারকে হত্যা করেছিলেন বাকের ও তাঁর সহযোগীরা। এ ছাড়া ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্যরা ফার্মগেটে পাকিস্তানি আর্মিদের চেকপোস্টে যে গ্রেনেড চার্জ করেছিলেন, সে দলেও ছিলেন তিনি।
১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট গুলশানের বাড়ি থেকে বকরকে পাকিস্তানি সৈন্যরা ধরে নিয়ে যায়।
শহীদ রুমী, শহীদ বদি, শহীদ আলতাফ মাহমুদ, শহীদ জুয়েল, শহীদ আজাদের মতো শহীদ বকরও আর ফিরে আসেননি।
বকরের কথা আজকাল আর কেউ মনে করে না।
আমাকে ডা. মোজাফফর তাঁর ভাইয়ের যুদ্ধদিনের স্মৃতিকথা বলেন।
বলেন, আপনি লিখুন। আমরা তো আর কিছু চাই না। চাই যে আমার ভাইয়ের নামটা থাকুক। কতজনের নামেই তো ঢাকার রাস্তার নাম দেখি, আমার ভাইয়ের নামে তো কিছু হলো না।
তারপর বলেন, আমার সময় তো ফুরিয়ে আসছে। আমি তো চলে যাব। যাওয়ার আগে আপনার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা ছিল, যাক, সেটা পূরণ হলো।
আমি বললাম, কেন ভাবছেন আপনি চলে যাবেন। আমরা সবাই যাব—তা ঠিক। কিন্তু কে আগে কে পরে, তা তো বলা যাবে না।
তিনি বললেন, আমি ডাক্তার, আমি জানি আমার আর সময় নাই...আমার ক্যানসার এখন অ্যাডভান্স স্টেজে।
বদিউল আলমের বীরত্বগাথা
বদিউল আলমের কাহিনি আমরা পাই জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলিতে, হাবিবুল আলম বীর প্রতীকের ব্রেভ অব হার্ট বইয়ে এবং আমি লিখেছি আমার মা বইয়ে।
বদিউল আলমের মা রওশন আরা খানম শহীদ বদি ও আমার স্মৃতিতে একাত্তর নামে বই লিখে গেছেন। প্রথমা প্রকাশন থেকে সেই বই বের হবে অদূরভবিষ্যতে।
বদিউলের জন্ম ১৯৪৮ সালের ২৬ জুন, ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের শিলাসী গ্রামে, নানাবাড়িতে। বাবার নাম আবদুল বারী। বদির ডাকনাম ছিল তপন। বদি ১৯৬০ সালে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হন। ভালো ছাত্র ছিলেন। ১৯৬৬ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য বদি করাচি যান। ১৯৭০ সালে ঢাকায় ফিরে আসেন। তিনি এনএসএফ করতেন বলেই তাঁর বন্ধুরা বলে থাকেন।
মা বইয়ে পাচ্ছি: ২৫শে মার্চের গণহত্যাযজ্ঞ শুরুর পর ২৭শে মার্চ কারফিউ তুলে নেওয়া হলে বদি তার বন্ধু তৌহিদ সামাদকে নিয়ে হাজির হয় ধানমন্ডি ৫ নম্বরে শহীদুল্লাহ খান বাদলের ডেরায়৷ তৌহিদ সামাদের বাসা ছিল ৪ নম্বরে৷ বদিকে দেখে শহীদুল্লাহ খান বাদলের মনে নীরব প্রশ্ন জাগে: এই এনএসএফের গুণ্ডাটাকে কেন নিয়ে এসেছে তৌহিদ?
বদিউল বলে বাদলকে, ‘লিসেন৷ ইউ কমিউনিস্ট৷ হয়্যার আর দি আর্মস৷ লেট্স গো অ্যান্ড ফাইট৷ নিশ্চয় যুদ্ধ হচ্ছে, নিশ্চয় আর্মস পাওয়া যাবে৷ চলো৷ যুদ্ধ করব৷’
কিন্তু শহীদুল্লাহ খান বাদলের চোখমুখ থেকে বদিউল আলমের ব্যাপারে সন্দেহ দূরীভূত হয় না৷ বদিকে এড়িয়ে যায় বাদল৷ সে যায় মাসুদ ওমরের বাসায়, সঙ্গে আশফাকুস সামাদ, কী করা যায় এই নিয়ে আলোচনা করে তারা৷ সেখানে আবার এসে হাজির হয় বদি৷ অবাক হওয়া বাদলের মুখের দিকে তাকিয়ে বদি সন্দেহরেখা পড়ে ফেলে অন্তর্যামীর মতো৷ তারপর সে তার পকেটে হাত দেয়৷ বের করে একটা ব্লেড৷ একটানে বদি নিজের হাত কেটে ফেলে খানিকটা৷ ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোয় তার হাত থেকে৷ তারপর সে বাদলের হাত টেনে নিয়ে সামান্য কাটে৷ বাদলের কাটা জায়গা থেকে রক্ত বেরিয়ে এলে বদি নিজের রক্ত মিশিয়ে দেয় বাদলের রক্তের সঙ্গে৷ বলে, ‘ফ্রম টুডে উই আর ব্লাড ব্রাদারস।’
তারা চলে যায় আগরতলায়, মেলাঘরে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নেয়, খালেদ মোশাররফ ছিলেন সেক্টর কমান্ডার। তারা ঢাকায় এসে গেরিলা অপারেশন চালিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের নাভিশ্বাস তুলে ফেলে।
একটা অপারেশনের বিবরণ মা বই থেকে:
গাড়ি চলতে শুরু করেছে৷ মগবাজার থেকে ধীরে ধীরে এসে পড়ছে ময়মনসিংহ রোডে৷ রাস্তায় পাকিস্তানি আর্মির গাড়ি চলাচল করছে৷ শত্রুর গাড়ির কাছে আসতেই মুক্তিযোদ্ধাদের হাত আপনাআপনিই অস্ত্রের গায়ে চলে যাচ্ছে৷ তারা ধীরে ধীরে দারুল কাবাব পেরিয়ে ফার্মগেট মোড়ে যায়৷ ডান দিকেই তাদের লক্ষ্যবস্তু৷ আর্মি চেকপোস্ট৷ দুটো তাঁবু৷ দুজন সৈন্য নিজেদের মধ্যে গল্প করছে৷ আরেকজন সৈন্য একটা বেবিট্যাক্সি থামিয়ে এক যাত্রীকে তল্লাশি করছে৷ বাকি সৈন্যরা হয়তো তাঁবুতে রাতের খাবার খাচ্ছে বা বিশ্রাম নিচ্ছে৷ তাদের গাড়ি ডানে ঘুরে তেজগাঁও সড়কে পড়ে৷ কিছুদূর গিয়ে সামাদ ভাই গাড়ি ঘুরিয়ে ফেলেন৷ তারপর গাড়ির হেডলাইট নিভিয়ে স্টার্ট বন্ধ করে গাড়ির নিজস্ব গতি জড়তায় গাড়িটাকে এনে দাঁড় করান হলিক্রস কলেজের গেটের কাছে৷ পানের দোকানে বিকিকিনি চলছে যথারীতি৷ সামাদ ভাই বলেন, ‘আল্লাহ ভরসা৷’ পাঁচজন নেমে পড়ে৷ এক মিনিটের মধ্যে সবাই যার যার পজিশন নিয়ে ফেলে৷ দুজন সৈন্য এখনো গল্প করছে৷ তৃতীয় সৈন্যটিও তাদের কাছে এসে গল্প জুড়ে দেয়৷ গেরিলাদের বুক কাঁপছে৷ বদি নির্দেশ দেয়: ‘ফায়ার৷’ আলম গুলি চালায় তিন সেন্ট্রিকে লক্ষ্য করে৷ সেন্ট্রিরা সঙ্গে সঙ্গে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে৷ আর বাকি চারজন গেরিলা একযোগে ব্রাশফায়ার করতে থাকে দুই তাঁবু লক্ষ্য করে৷ তিনজন প্রহরারত সৈন্যকে ধরাশায়ী করে আলমও তাক করে তাঁবু দুটো৷ রচিত হয় গুলির মালা৷ স্বপন নির্দেশ দেয়: ‘রিট্রিট’৷ জুয়েল আর পুলু বোমা চার্জ করে৷ সবাই দৌড়ে এসে উঠে পড়ে গাড়িতে৷ সামাদ ভাই গাড়িতে টান দেন৷ ময়মনসিংহ সড়ক ধরে গাড়ি এগিয়ে চলে৷ তখন সবার খেয়াল হয় গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত হয়নি৷ দারুল কাবাব ঘরের অপারেশন তাই হতে পারে না৷
১৯৭১ সালের ২৯/৩০ আগস্ট পাকিস্তানি সৈন্যরা ঢাকার অনেকগুলো গেরিলা শেল্টারে হামলা চালায়। মগবাজারের আজাদদের বাড়ি থেকে ধরা পড়ে জুয়েল, আজাদ প্রমুখ। রুমী, জামি, শরিফ সাহেবকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় এলিফ্যান্ট রোডের বাড়ি থেকে। বাকেরকে ধরা হয় গুলশানের বাড়ি থেকে। বদিকে ধরা হয় ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপালের বাড়ি থেকে, এটা ছিল বদির বন্ধুর বাড়ি।
প্রতিটা গেরিলার ওপরে পাকিস্তানি বাহিনী চালায় অকথ্য অত্যাচার। কারও মুখ থেকেই কথা বের করতে পারেনি তারা। কিন্তু বদি, বাকের, রুমি, জুয়েল, আলতাফ মাহমুদ, আজাদ আর কোনো দিনও মায়ের কোলে ফিরে আসেননি।
মনে করা হয়, ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বরে এঁদেরকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়।
ভাইয়ের নামটা বেঁচে থাক
শহীদ আবু বকর, বীর বিক্রমের ভাই ডা. মোজাফফর, আবু হায়দার, আবু মাজহার কিংবা শহীদ বদিউল আলম, বীর বিক্রমের ভাই সাইফুর আলমের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। এঁরা বলেন, আমরা তো বৈষয়িক কিছু চাই না। শুধু চাই, আমাদের ভাইয়ের নামটা যেন থাকে।
ঢাকায় কতজনের নামেই তো কত রাস্তা হলো। আমাদের ভাইদের নামে তো কিছু হলো না।
আমি বলি, আপনাদের ভাইদের নাম তত দিন থাকবে, যত দিন বাংলাদেশ থাকবে। হুমায়ূন আহমেদ একভাবে তাঁদের নাম ধরে রেখেছেন, এখন আমাদের কাজ হবে প্রকৃত বাকের, প্রকৃত বদির পরিচয়টাও তুলে ধরা।
এই লেখাটা সেই ঋণ শোধের প্রাথমিক প্রয়াসমাত্র।