দিন দিন দেশের অভ্যন্তরে কমে যাচ্ছে মুক্ত জলাশয়ের মৎস্যসম্পদ। গত এক দশকে বিভিন্ন ধরনের মাছের নাম এসেছে বিলুপ্তির তালিকায়। মুক্ত জলাশয়ের মধ্যে আছে প্লাবন ভূমি, নদী, খাল, বিল, কাপ্তাই হ্রদ ও সুন্দরবন। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সংগৃহীত মাছের শতকরা ৪১.৩৬ ভাগ সরবরাহ আসে মুক্ত জলাশয় থেকে। এর আয়তন ৪০.৪৭ লাখ হেক্টর, যা মোট অভ্যন্তরীণ জলাশয়ের শতকরা ৮৮.৪৬ ভাগ।
তথ্য বলছে, বাংলাদেশের জলাশয়ে ২৬০ প্রজাতির দেশীয় মাছ, ১২ প্রজাতির বিদেশি মাছ এবং ২৪ প্রজাতির চিংড়ি রয়েছে। এর মধ্যে ৬১ প্রজাতির মাছ আজ একেবারে হারিয়ে যেতে বসেছে।
উল্লেখযোগ্য হলো: সরপুঁটি, রানি, খলশে, মহাশোল, মেনি, নান্দিনা, রিটা, বেলে, তারাবাইম, বাগাড়, বাচা, চিতল, কালবাউশ, গনিয়া, মধুপাবদা, শিং, নাপতেকই, লাল চান্দা, নামা চান্দা, তেলিটাকি, ভুতুম, বাটা ইত্যাদি।
এর মধ্যে এলাকাভেদে কিছু মাছ এখনো পাওয়া গেলেও অধিকাংশ মাছই এখন আর পাওয়া যায় না।
কী কারণে বিলুপ্তি ঘটছে
জার্মানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘ডয়চে ভেলে’র এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, বাংলাদেশে মৎস্যসম্পদ আশঙ্কাজনক হারে কমার জন্য বিশেষজ্ঞরা বেশ কিছু কারণ শনাক্ত করেছেন। যেমন: অবাধে মুক্ত জলাশয় ভরাট হওয়া, কারেন্ট জালের ব্যবহার, প্রজনন মৌসুমে ডিমওয়ালা মাছ ধরা, রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের যথেচ্ছ ব্যবহার, অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, পানি সেচের/মাধ্যমে সব মাছ তুলে ফেলা, পাটি বাঁধ দিয়ে সব মাছ ধরা, কলকারখানার বর্জ্য জলাশয়ে ফেলা, জলাশয়ে বিষ প্রয়োগ, আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষ, সচেতনতার অভাব ইত্যাদি।
এ ছাড়া সরেজমিন ঘুরে আরও কিছু কারণ চিহ্নিত করা গেছে। যেমন: মুক্ত জলাশয়ে ব্যক্তিগত মৎস্য খামার (স্থানীয় ভাষায় বাবজা) দেওয়া, টানাজাল (স্থানীয় ভাষায় বেহাল) ব্যবহার করে মাছ আহরণ, খাল শুকিয়ে মাছ ধরা ইত্যাদি।
উত্তরণে যা করণীয়
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য এখনই কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। না হলে অদূর ভবিষ্যতে দেশে আমিষের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এ ছাড়া বিভিন্ন মৎস্যসম্পদের পাশাপাশি জলজ সম্পদও বিলুপ্ত হতে পারে, ফলে প্রকৃতি হারাতে পারে ভারসাম্য। বিশেষজ্ঞরা তাই নিচের পদক্ষেপগুলো নিতে বলছেন দ্রুত।
কারেন্ট জালের ব্যবহার রোধ করা
যদিও কারেন্ট জাল ব্যবহারে আইন করেছে সরকার, তবে সে আইন মানা হয় না তেমন। শুধু কারেন্ট জাল নয়, নির্ধারিত ফাঁসজাল যদি ছাড়া যায়, তাহলে মাছের বিলুপ্তি রোধ করা অনেকটা সম্ভব এবং সেই সঙ্গে মাছের উৎপাদনও বেড়ে যাবে। গবেষণায় দেখা গেছে, বছরে যে পরিমাণ জাটকা ধরা পড়ে, তার মাত্র শতকরা ২৫ ভাগ যদি রক্ষা করা যায়, তাহলে বছরে দেড় লাখ মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদন সম্ভব, যার বাজারমূল্য ৬০০ কোটি টাকা। শুধু ইলিশ নয়, বর্ষা মৌসুমে এসব জালের অবাধ ব্যবহারে ডিমওয়ালা মাছসহ ধরা পড়ছে অবাধে। ফলে বংশবৃদ্ধি হচ্ছে না অধিকাংশ মাছের।
প্রজনন মৌসুমে ডিমওয়ালা মাছ না ধরা
বর্ষা মৌসুমে তথা প্রজনন মৌসুমে যদি আমরা মাছ না ধরি, তাহলে মাছের উৎপাদন অনেক বেড়ে যাবে। একই সঙ্গে পাটি বাঁধ এবং সেচ দিয়ে জলাশয় শুকিয়ে ফেলা পাটি বাঁধ এবং সেচ দিয়ে জলাশয় শুকিয়ে সব মাছ ধরে ফেলায় পরের বছরের মাছের উৎপাদন আগের তুলনায় কমে যাচ্ছে। অনেক প্রজাতির মাছ হারিয়ে যাচ্ছে কোনো ‘মা’ মাছ না থাকার দরুন।
অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ না করা
বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচসহ বিভিন্ন কারণে অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ নির্মাণের ফলে মাছের অবাধ বিচরণ সীমিত হচ্ছে। চাঁদপুর বন্যা নিয়ন্ত্রণ সেচ প্রকল্পের ফলে প্রথম দুই বছরে মাছের উৎপাদন কমেছে ৩৫ শতাংশ। গেল কয়েক বছর নাগাদ বাংলাদেশে মোট ৬ হাজার ১৩৪ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এতে খাদ্য উৎপাদন কিছুটা বাড়লে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।
রাসায়নিক সারের যথেচ্ছ ব্যবহার রোধ করা
রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও কারখানার বর্জ্যের প্রভাবে অপেক্ষাকৃত নাজুক প্রকৃতির মাছের প্রজনন, বিচরণ এবং খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। কিছু মাছ, যেমন: কই, শিং, মাগুর, পুঁটি, শোল, টাকি, গজার, বেলে, টেংরা এসব মাছ সাধারণত কম পানিতে বা ধানিজমিতে ডিম দেয় এবং বাচ্চা লালন করে। কাতলা, রুই, মৃগেল, কালিবাউশসহ অন্যান্য মাছের ছোট পোনা নিচু জমির ধানখেতকে লালনভূমি হিসেবে ব্যবহার করে। রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও কলকারখানার বর্জ্যের কারণে মাছের পাশাপাশি জলজ অন্যান্য প্রাণীর প্রজনন, বিচরণ ও লালনক্ষেত্র দূষিত হচ্ছে।
এ ছাড়া আরও কয়েকটি বিষয়, যেমন আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষের ক্ষেত্রে মাছের কিছু প্রজাতিকে রাক্ষুসে মাছ হিসেবে চিহ্নিত করে ধ্বংস করার কারণে বিলুপ্ত ঘটছে বেশ কিছু প্রজাতির। যেমন: মহাশোল, গজার, টাকি, বোয়াল ইত্যাদি।
মাছ বিলুপ্তি, করণীয়সহ এসব বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আনিছুর রহমান জানান, করোনার প্রভাবে ইতিমধ্যেই জলাশয়ে পানির দূষণ কমেছে, ফলে উৎপাদন বেড়েছে ইলিশের। পাশাপাশি দেশীয় বিলুপ্ত ছোট মাছের প্রায় ৬১টি জাতের মধ্যে ১৭টি জাতকে গবেষণার মাধ্যমে আমরা ফিরিয়ে এনেছি। আমরা আশাবাদী, ধীরে ধীরে আরও বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।