সংবাদপত্র বিক্রয়কর্মীদের কাজটি একটা মহৎ পেশা। জ্ঞান বিক্রয়ের চেয়ে গৌরবের কাজ আর কী হতে পারে। আমরা গর্ব করে বলি, আমরা সংবাদপত্র বিক্রয়কর্মী, আমরা আলোর ফেরিওয়ালা। অন্য অর্থে আমরা হকার–এজেন্টরা দুরন্ত ও দুর্বারও বটে। আমাদের আটকাতে পারে না হরতাল, করোনা মহামারি, লকডাউন, ঝড়বাদল, বন্যা এমনকি কারফিউ।
সংবাদপত্র বিক্রয়কর্মীরা আমাদের সহকর্মী অথবা আমাদের ব্যবসায়িক অংশীদার, আমাদের অত্যন্ত আপনজন। ভোরের আলো ফোটার আগেই হকার ভাইয়েরা পাঠকের হাতে প্রথম আলো পৌঁছে দিতে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন।
প্রথম আলোর প্রতি পাঠকদের ভালোবাসা অনেক। গত বছর এক অনুষ্ঠানে একজন ইউএনও বলেছিলেন, ‘আমি প্রথম আলোর পড়াশোনা পাতা পড়ে আজ ভূমি অফিসার হয়েছি।’ একজন পাঠক বলেছিলেন, ‘আমরা প্রথম আলোর জন্য দোয়া করি, প্রথম আলোর সম্পাদকের জন্য দোয়া করি। আল্লাহর কাছে চাই, আমার ছেলে যদি প্রথম আলোর মতো ভালো হইত। বন্ধুসভার মতো ভালো হইত।’
প্রথম আলো ২৩ পেরিয়ে ২৪ বছরে পা বাড়িয়েছে। এই দীর্ঘ যাত্রাপথে আমরা এজেন্ট-হকার ভাইদের সব সময় পাশে পেয়েছি সহযাত্রী ও অংশীজন হিসেবে। আপনাদের এই সহযোগিতা ও ভালোবাসা আমাদের এগিয়ে যেতে ভরসা জুগিয়েছে প্রতিটি দিন। আজ প্রথম আলো বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম বাংলা গণমাধ্যম।
হকার–এজেন্ট ভাইদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা, আগামী দিনেও তাঁরা এভাবেই আমাদের পাশে থাকবেন। একটি সত্যিকারের শিক্ষিত বাংলাদেশ গড়তে এই হকার ও এজেন্ট ভাইদের গুরুত্ব অপরিসীম। সারা বিশ্বের তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ভালোভাবেই চলছিল এই হকার ও এজেন্ট ভাইদের জীবন। হঠাৎ বিষে ভরা ২০২০ নিয়ে এল আমাদের সবার জন্য করোনার মতো এক ভয়াবহ মরণব্যাধি। সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশও লকডাউনের নামে অচল হয়ে গেল।
সারা দেশ অচল হলেও থেমে যায়নি প্রথম আলোর পথচলা। আমাদের এজেন্ট ও হকার ভাইয়েরা ভয় ও শঙ্কা নিয়েই ছুটে চলেছেন পাঠকের বাড়ি বাড়ি। ২১ এপ্রিল ২০২০ সারা দেশের সব অফিসের মতো আমাদের অফিসও সাময়িক বন্ধ করে দেওয়া হয়। আমরা সবাই হোম অফিসের মাধ্যমে ৫ জুন পর্যন্ত ৪৩ দিন পত্রিকা প্রকাশ ও সরবরাহ অব্যাহত রাখি। আমাদের অনেক সহকর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন, এর মধ্যে পাঁচজন সার্কুলেশন কর্মীও আক্রান্ত হন। দুজন জ্যেষ্ঠ সহকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়ে আমাদের ছেড়ে চলে যান। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে আরেকজন সহকর্মী চলে যান। তাঁদের প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা।
২৫ মার্চ ২০২০, লকডাউনের প্রথম দিনেই সরাসরি প্রভাব পড়েছিল পত্রিকার সার্কুলেশনের ওপর। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এজেন্টরা ফোন করছিলেন, অপর প্রান্ত থেকে সব এজেন্টই প্রায় একই রকম শঙ্কা নিয়ে বলছিলেন, কাল থেকে কী হবে, বুঝতে পারছি না। আপাতত পত্রিকা বন্ধ রাখুন। এত দ্রুতই সবকিছু হয়ে যাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল একটা দুঃস্বপ্ন দেখছি। পরে সারা দেশের সব হকার ও এজেন্ট ভাইদের মাস্ক ও হ্যান্ড সেনিটাইজার বিতরণ করা হয় প্রথম আলোর পক্ষ থেকে।
একসময় পরিস্থিতি এমন হলো, সারা দেশের আমাদের লাখ লাখ পাঠক হকারদের বাসায় পত্রিকা দিতে নিষেধ করলেন। তবে মন থেকে আমার একটি বিশ্বাস ছিল যে এটি সাময়িক সিদ্ধান্ত। সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা আমাদের এজেন্ট এবং হাজার হাজার হকার ভাইকে নিয়ে এ বিপর্যয় আমরা কাটিয়ে উঠবই।
তাৎক্ষণিকভাবে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, আমাদের একজন পাঠকও যদি থাকেন, তাঁর যাতে কোনোভাবে পত্রিকা পেতে সমস্যা না হয়, এ জন্য কিছু না কিছু করা দরকার। তাই পরের দিন থেকে দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ও আবাসিক এলাকার ফার্মেসিগুলোতে প্রথম আলোর সরবরাহ নিশ্চিত করা হলো। কারণ, কঠোর লকডাউনের সময় ফার্মেসি ছাড়া অন্য কোনো দোকান বা প্রতিষ্ঠান খোলা ছিল না।
শুরু হয় নতুন একটি যুদ্ধ। সব হকার ভাইকে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে দেশের সব এজেন্ট ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলি। পাশাপাশি হকার ভাইদের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের মূল্যবান মতামত নিই। বেশির ভাগ হকার এবং এজেন্ট ভাইবলছিলেন, শহরের সব আবাসিক এলাকার গেট বন্ধ। পত্রিকা নিয়ে পাঠকের বাসায় যাওয়া তো দূরের কথা, এলাকায় ঢোকা যাচ্ছিল না। ভাবতে থাকলাম কী করা যায়। বুঝতে পারলাম যে এ অবস্থার উন্নতির জন্য সব এজেন্ট, হকার ভাই এবং আমরা—সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। কাজটি অনেক কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। এজেন্ট ও হকারভাইদের নিয়ে আমরা আবাসিক এলাকাগুলোতে যাওয়া শুরু করি। যেখানেই বাধা পাই, আমরা তাঁদের বোঝাই যে ছাপা কাগজের মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়ায় না। কথাটি পত্রিকার মাধ্যমেও পাঠকদের জানানো হয়। করোনার সময় সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ জানার জন্য সংবাদপত্রের বিকল্প নেই। এরপর অনেক এলাকায় হকার ভাইদের নিয়ে আমাদের পুরোনো পাঠকদের এক দিনের জন্য সৌজন্য কপি দিই। আর পত্রিকার সঙ্গে একটি সচেতনতামূলক লিফলেটও বিতরণ করি। যেখানে ছাপা কাগজের মাধ্যমে করোনাভাইরাস না ছড়ানোর বিষয়টি স্পষ্টভাবে লেখা ছিল, পাশাপাশি তাঁদের আবার পত্রিকা পড়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়। অনেক এলাকায় বিশেষ চিকিৎসকের সাক্ষাৎকারসহ সচেতনতামূলক লিফলেটও বিতরণ করি। বিভিন্ন ফার্মেসি, মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিক্রেতাদের দিয়েও পত্রিকা বিক্রি করানো হয়।
একটা সময় করোনার প্রকোপ কমলে হকার ভাইয়েরা ফিরে আসতে শুরু করেন। তাঁরা আবার আবাসিক এলাকা ও প্রতিষ্ঠানগুলোতে যান। আস্তে আস্তে পুরোনো পাঠকেরাও পত্রিকা নিতে শুরু করেন। এভাবেই আমাদের হকার ভাইয়েরা পাঠকের হাতে হাতে তুলে দেন পাঠকেরই পছন্দের পত্রিকা প্রথম আলো।
করোনা বিপর্যয়ের মধ্যেও দেশের শীর্ষস্থানীয় বিভাগীয় এবং জেলা পর্যায়ের এজেন্টরা একটি দিনের জন্যও পত্রিকা বন্ধ রাখেননি। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, খুলনা, বরিশাল, রংপুরসহ বিভিন্ন জেলায় আমাদের এজেন্টরা একটি কথাই বলেছিলেন, একজন হকারও যদি না থাকে, শুধু একজন পাঠক থাকলেও আমরা তাঁর জন্য পত্রিকা আনব, আমাদের সেন্টার আমাদের পত্রিকা অফিস খোলা রাখব। যখন কঠোর লকডাউন, বাইরে কেউ ছিল না, ভোরের আলো ফোটার আগেই আমাদের এজেন্ট এবং হকার ভাইয়েরা সেন্টারে চলে আসতেন। এই ভোরবেলায় রাস্তায় একটি রিকশাও চলত না, তিন থেকে চার কিলোমিটার পর্যন্ত হেঁটে আমাদের এজেন্ট এবং সেন্টার সুপারভাইজাররা পত্রিকা বিতরণের জন্য চলে আসতেন। তাঁদের সবার মনে একটাই বিশ্বাসই ছিল, পাঠক আবার পত্রিকা পড়বেন। একসময় এই বিপর্যয় আমরা কাটিয়ে উঠব।
আমাদের এজেন্ট ও হকার ভাইদের এই হার না–মানা যুদ্ধ আমাদের সাহস জুগিয়েছে। তাঁরাই আমাদের লাখ লাখ পাঠকের হাতে ভোরবেলায় তুলে দিচ্ছেন প্রথম আলো। আমরা প্রথম আলো পরিবার সারা দেশের সব এজেন্ট এবং হকার ভাইদের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই তাঁদের এই নিরলস প্রচেষ্টার জন্য। আমাদের যেসব এজেন্ট ভাই এবং হকার ভাই করোনায় আক্রান্ত হয়ে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, আমরা তাঁদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।
আমরা শ্রদ্ধাভারে স্মরণ করি কামাল ভাই, হারুন ভাই, ফজলুর রহমান ভাই, নির্মলদা, আবদুল বারী লস্কর ভাই, নুরুল ইসলাম ভাই ও শওকত আলী বাবুল ভাইকে, যাঁরা আর আমাদের মাঝে নেই।
আমরা প্রথম আলোর পক্ষ থেকে করোনায় আক্রান্ত হকার ও এজেন্ট ভাইদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। আমাদের অফিসে সার্বক্ষণিক দুজন চিকিৎসক ছিলেন পরামর্শ দেওয়ার জন্য। করোনাকালে হকার ও এজেন্ট ভাইদের আয় কমে যাওয়ায় আমরা পত্রিকার কমিশন ৩৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ করেছি।
প্রথম আলো সব সময় হকার ও এজেন্ট ভাইদের পাশে আছে, থাকবে। কোনো হকার মারা গেলে বা দুর্ঘটনায় কবলিত হলে তাঁদের পরিবারের পাশে থাকার চেষ্টা করি। আমরা এজেন্ট ও হকার ভাইদের মেধাবী সন্তানদের বৃত্তি প্রদান করি। বৃত্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে সিলেটের অরুণদার মেয়ে প্রীতি পাল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আমরা তাঁকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। এ ছাড়া ২০১৭ ও ২০১৮ সালে ঢাকা, বগুড়া ও চট্টগ্রামের হকার ভাইদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে আয়োজন করা হয়েছিল ‘হকার প্রীতি ফুটবল টুর্নামেন্ট’।
পাঠকের হাতে সংবাদপত্র পৌঁছে দেওয়ার জন্য শুরু থেকেই যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করছিলেন, আমরা তাঁদের কৃতজ্ঞতা জানাই। যেমন সালেহ আহমেদ জিহাদী ভাই, মো.ইসহাক ভাই, আবদুল মালেক ভাই, মো.ইব্রাহীম ভাই, সেকান্দার ভাই, মনসুর আলী ভাই, সামসুল হক ভাই, মো.সালাম ভাই, মোস্তফা কামাল ভাই,আনোয়ার ভাই, আবদুল হাই ভাই, বুজরত আলী খান, যুগলি কিশোর দাদা, হেকমত উল্লাহ ভাই, নুরুল ইসলাম ভাই, মো. নজরুল ইসলাম ভাই।
হকার–এজেন্ট ভাইয়েরা রোজ ভোর-সকালে পাঠকের হাতে প্রথম আলো পৌঁছে দিতে যেভাবে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন, সে জন্য আমরা তাঁদের অভিবাদন জানাই। অতিমারির সংকটের মধ্যেও আপনারা পেশা ছেড়ে যাননি, এ জন্য আমরা জানাই অশেষ ধন্যবাদ।
ইতিমধ্যে পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আমরা সবাই মিলে আবারও সুদিনে ফিরছি। পরিবারের সবাইকে নিয়ে সুস্থ থাকবেন, ভালো থাকবেন।
● অরূপ কুমার ঘোষ : মহাব্যবস্থাপক, সার্কুলেশন সেলস