আলোর পথে ১৯ বছরের সাহসী যাত্রা

সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান।

সংকটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ।
মুক্ত করো ভয়, আপনা-মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়।

প্রথম আলোর ১৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ছিল আজ শনিবার। এ উপলক্ষে সব কর্মীর উপস্থিতিতে আজ আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন ট্রান্সকম গ্রুপ ও প্রথম আলোর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মিডিয়া স্টারের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান। সিএ ভবন মিলনায়তন, কারওয়ান বাজার, ৪ নভেম্বর। ছবি: আবদুস সালাম

প্রথম আলোর ১৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ছিল আজ শনিবার। এ উপলক্ষে সব কর্মীর উপস্থিতিতে প্রতিবছরের মতো আয়োজিত অনুষ্ঠানের একেবারে শেষে পরিবেশনা ছিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশা জাগানিয়া এ সংগীত।

সমস্বরে গাইলেন দেশের নামী সঙ্গীতশিল্পীরা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন বাপ্পা মজুমদার, প্রিয়াঙ্কা গোপ, অনিমা রায়, দিনাত জাহান, কনা, ইমরান, সাব্বির ও কিশোর। তাঁদের কণ্ঠে কণ্ঠ মেলালেন প্রথম আলোর অগ্রযাত্রার সহযোদ্ধা সব কর্মী। সংকোচের বিহ্বলতায় নিজেকে অপমান না করে, অজানা আশঙ্কায় শঙ্কিত না হয়ে, নিজের মাঝে শক্তির সংরক্ষণ করে জয় করার গল্প এটি। এ গল্প লাখো পাঠকের মন জয় করার, সাহসিকতার, অদম্য মনোবলের। প্রতিকূলতার মধ্যে নির্ভীক থাকার।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে সিএ ভবনে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সকাল সাড়ে ১০টায় মিলনায়তন ঠাসা কর্মীদের উপস্থিতি আর তাঁদের মুহুর্মুহু করতালিতে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়ে উৎসবের আমেজ।

দুহাত তুলে অতিথি ও কর্মীদের উচ্ছ্বাস। ছবি: প্রথম আলো

উৎসবে প্রথম আলোর প্রত্যয় আর আশাবাদের কথা শোনান ট্রান্সকম গ্রুপ ও প্রথম আলোর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মিডিয়া স্টার লিমিটেডের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান। তিনি বলেন, ‘১৯ বছর এখন। তবে এখানেই থেমে থাকা নয়, আরও দীর্ঘ পথ যেতে হবে। আর পথে ঠিক থাকতে হবে। যেমনটি ছিল এত দিন।’

লতিফুর রহমান বলেন, প্রথম আলোর প্রচার সংখ্যা এখন পাঁচ লাখের বেশি। দেশের শ্রেষ্ঠ দৈনিক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে এটি। এর কারণ প্রথম আলোর নির্ভীক চরিত্র। তিনি বলেন, ‘দিনের শেষে এসে পাঠক বুঝতে পারেন—কোনটি ঠিক, কোনটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। পাঠকই প্রকৃত বিচারক। তাঁরাই পুরস্কৃত করে, আবার শাস্তিও দেন। সাহস, মূল্যবোধ, অনুপ্রেরণা নিয়ে পাঠকের মনে ঠাঁই করে নিয়েছে প্রথম আলো। এসবই পত্রিকার যোগ্যতার স্বীকৃতি।’

প্রথম আলোর ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা এ পত্রিকাকে অনেক দায়িত্বশীল করে তুলেছে। লতিফুর রহমান সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, মানুষ সত্য জানতে চায়। নিরপেক্ষতা সত্যই তাদের প্রত্যাশা। প্রথম আলোকে অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সংবাদ পরিবেশন করতে হবে। এরপর সংগীত দিয়েই অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে। শুরুতে সলিল চৌধুরীর লেখা ও সুরে ‘ও আলোর পথের যাত্রী, এ যে রাত্রি এখানে থেমো না’ গানটি গেয়ে শোনান কণ্ঠশিল্পী কোনাল। প্রথম আলোর বিরামহীন যাত্রায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন সম্পাদক মতিউর রহমান। তিনি শোনান ১৯ বছরের অগ্রযাত্রার কথা। বলতে গিয়ে তিনি ফিরে যান অতীতে। বললেন, সিএ ভবনের একটি ফ্লোর নিয়ে ১০৫ কর্মীর সহযোগিতায় প্রথম আলোর যাত্রা শুরু হয়েছিল। আজ ৯৪৩ জন কর্মী। প্রতিদিন ছাপা পত্রিকা পড়ছেন ৫৩ লাখ পাঠক। অনলাইন মিলিয়ে ৬৫ লাখ মানুষ প্রতিদিন পড়ে প্রথম আলো।

বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সম্পাদক ও প্রকাশক মতিউর রহমান। ছবি: প্রথম আলো

সাফল্যের একেকটি তথ্য তুলে ধরেন মতিউর রহমান। বিশ্বের ২০০টি দেশে প্রথম আলো পড়া হয়। আজ বিশ্বের এক নম্বর বাংলা ওয়েব পোর্টাল প্রথম আলো, এক নম্বর বাংলা সংবাদ পোর্টালও এটি। ফেসবুকে ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ প্রথম আলোর ভিজিটর। টুইটারে ১০ লাখ ফলো করেন প্রথম আলোকে।

প্রথম আলোর সম্পাদক বলেন, ‘শুরুর সেই দিনগুলোতে ভয় ছিল, ছিল আশাবাদও। ভয় ছিল, নিজেরা ভালো করতে পারব কি না, তা নিয়ে। আর আশাবাদ ছিল, মিলিত শক্তিতে নিশ্চয়ই সাফল্য আসবে। মাত্র সাড়ে তিন বছরে প্রথম আলো দেশের সেরা দৈনিক হয়েছে। এ সময়ে আয়-ব্যয় সমানও হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, আগামী বছর ২০ বছর পূর্ণ করবে প্রথম আলো। সেই বিশেষ সময়ে প্রথম আলো তার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখবে।

এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রথম আলোর স্লোগান ‘সাহস’, যে সাহস প্রথম আলো ধারণ করে এসেছে সব সময়। প্রথম আলোর সম্পাদক তাঁর বক্তৃতায় স্মরণ করেন আরেক সাহসী তরুণকে। তিনি ফারাজ আইয়াজ হোসেন। ২০১৬ সালে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার সময় অসম সাহসিকতা দেখান তিনি। বিপদে বন্ধুদের ছেড়ে না যাওয়ার প্রত্যয়ে তিনি ছিলেন অবিচল। ঘাতকের নির্মমতা ফারাজের প্রাণ কেড়ে নেয়। কিন্তু তিনি স্থাপন করেন অনন্য উদাহরণ। মতিউর রহমান বলেন, ‘ফারাজ অবিনশ্বর কীর্তি স্থাপন করেছে। আমাদের অনুপ্রেরণা দেয় তার আত্মত্যাগ।’

প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যাঁর ঝলমলে উপস্থিতি সবার কাম্য থাকে, এবারও ছিলেন ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনাম। তিনি বলেন, প্রথম আলো দেশের এক নম্বর পত্রিকা। কারণ, এর সাংবাদিকতার মান উচ্চ স্তরের।

মাহ্‌ফুজ আনাম বলেন, সাংবাদিকতা ও ব্যবসা এ দুটো শব্দকে পরস্পরবিরোধী বলে মনে করার একটি প্রবণতা আছে। কিন্তু প্রথম আলো প্রমাণ করেছে, নৈতিকতা দিয়ে সংবাদপত্রের সম্প্রসারণ ও ব্যবসার সম্প্রসারণ যুগপৎভাবে করা সম্ভব। তিনি বলেন, বাংলাদেশে স্বাধীন সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ খুব চ্যালেঞ্জের। এ যাত্রায় প্রথম আলোর কর্মীদের সতর্ক থাকতে হবে।

মিডিয়া ওয়াল্ডের চেয়ারম্যান ও মিডিয়া স্টারের পরিচালক রোকেয়া আফজাল রহমান বলেন, প্রথম আলো তার লক্ষ্য ঠিক রাখার জন্যই আজ সাফল্য পেয়েছে। উৎকর্ষের এই জায়গায় আসতে পেরেছে।

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে অতিথি ও কর্মীরা। ছবি: প্রথম আলো

প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক পুরো অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। তিনি বলেন, ‘মানুষের অদম্য সাহস সব সময় আমাদের সেরা অর্জনের পেছনে থেকেছে। ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯০-এর গণ-আন্দোলন। এর সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রিকেটের উজ্জ্বল তারকা মাশরাফির সাহসী উচ্চারণ “ধরে দিবানি”। এ সবই আমাদের সাহস জুগিয়েছে।’

এমন আরেক সাহসের উদাহরণ তৈরি করেছে ময়মনসিংহের নান্দাইলের সাত স্কুলছাত্রী। বাল্যবিবাহ ঠেকিয়ে দিয়ে কিশোরীদের সেই মিলিত সাহসিকতার ভিডিও চিত্র সবাইকে মুগ্ধ করে অনুষ্ঠানের শুরুতেই।

আজকের অনুষ্ঠানে প্রথম আলো প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মিডিয়া স্টার লিমিটেডের পরিচালক সাইফুর রহমান, আতিকুর রহমান, আরশাদ ওয়ালিউর রহমান, সিমিন হোসেন, তাঁর ছেলে জারেফ আয়াত হোসেন, ট্রান্সকমের নির্বাহী পরিচালক কামরুল হাসান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

সারা বছর যেসব কর্মী অক্লান্ত পরিশ্রম করে প্রথম আলোর যাত্রাকে এগিয়ে নেন, এবারও সেসব কর্মীকে কাজের স্বীকৃতি দেওয়া হয় অনুষ্ঠানের শেষে। সেসব কর্মীর নাম ঘোষণা করেন প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ।

বক্তব্য দেন ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনাম। ছবি: প্রথম আলো

যাঁরা এ বছর পুরস্কৃত হন, তাঁরা হলেন সেরা নবীন কর্মী: প্রশাসনের নির্বাহী শামসুন নাহার, সাংবাদিকতা বিভাগের সানাউল্লাহ সাকিব। সেরা প্রতিবেদন: ঢাকায় শেখ সাবিহা আলম। ঢাকার বাইরে মাগুরা প্রতিনিধি কবির হোসেন। সেরা প্রতিবেদক: কূটনৈতিক প্রতিবেদক রাহীদ এজাজ (ঢাকায়), ঢাকার বাইরে খলিল রহমান (সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি)। সেরা সহসম্পাদক: (বার্তা) হারুনুর রশীদ, সহসম্পাদক বিশাল বাংলা এবং রাশেদুল আলম রাসেল, জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, অনলাইন। সেরা ফটো সাংবাদিক: আনিস মাহমুদ, আলোকচিত্রী, সিলেট। সেরা দল: চট্টগ্রাম অফিস। সর্বোচ্চ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকারী: শামসুল আরেফিন, জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞাপন নির্বাহী, বিজ্ঞাপন বিভাগ। বদলের সহযোগী: ঢাকা সার্কুলেশন সেলস। অন্যান্য সহযোগী: আবদুল মুন্নাফ, জ্যেষ্ঠ অফিস সহকারী, প্রশাসন বিভাগ।
বিশেষ স্বীকৃতি: ক্রীড়া বিভাগের মো. মাসুদ আলম, বিশেষ প্রতিনিধি (ক্রীড়া); মোর্শেদ নোমান, (জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, অনলাইন); রয়া মুনতাসীর, সহসম্পাদক ফিচার বিভাগ; অমর কান্ত সাহা (কলকাতা প্রতিনিধি); গিয়াস উদ্দিন (টেকনাফ প্রতিনিধি); বিকাশ চন্দ্র দাস, জ্যেষ্ঠ সম্পাদনা সহকারী; মামুনুর রহমান খান, সিনিয়র এন্টারপ্রাইজ অ্যাপ্লিকেশন অফিসার, প্রবীর কুমার পাল, জ্যেষ্ঠ টেলিফোন অপারেটর। সেরা বন্ধুসভা: চট্টগ্রাম বন্ধুসভা। সেরা কর্মী: সোহরাব হাসান, যুগ্ম সম্পাদক, সম্পাদকীয় বিভাগ ও মোমেনূর রশীদ সিদ্দিকী, সহকারী মহাব্যবস্থাপক (প্রধান, মার্কেটিং ও বিজনেস ডেভেলপমেন্ট)।