লাইসেন্স দেওয়ার এক বছরের বেশি সময় পর তরঙ্গ (ফ্রিকোয়েন্সি) বরাদ্দ ও নিরাপত্তা ছাড় পেয়েছে ১০টি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল। তবে লাইসেন্স পেলেও তরঙ্গ বরাদ্দ পায়নি অন৵ পাঁচটি চ্যানেল।
তথ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে থাকা তথ্য অনুযায়ী, নতুন ১০টিসহ দেশে এখন বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সংখ্যা ৪১। এর মধ্যে লাইসেন্স পেলেও পাঁচটি আপাতত চালু করতে পারছে না। নতুন ১০টিসহ এক ডজন চ্যানেল সম্প্রচারের জন্য কাজ শুরু করেছে বা করবে। ওয়েবসাইটে সম্প্রচার সাময়িক স্থগিত রাখার কথা উল্লেখ আছে দিগন্ত ও ইসলামিক টেলিভিশনের। আর চালু আছে ২২টি বেসরকারি চ্যানেল।
২০১৩ সালের শেষ দিকে এক দফায় দুটি, আরেক দফায় ১৩টিসহ মোট ১৫টি চ্যানেল লাইসেন্স পায়। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) সূত্র জানিয়েছে, লাইসেন্স দেওয়ার পর তথ্য মন্ত্রণালয় নিরাপত্তা ছাড়ের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও তরঙ্গ বরাদ্দের জন্য বিটিআরসির কাছে পাঠায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তিনটি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে এসব চ্যানেলের উদ্যোক্তাদের বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে প্রতিবেদন দিতে বলে। ওই সূত্রমতে, গোয়েন্দা প্রতিবেদন ও সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের সিদ্ধান্তে পাঁচটি চ্যানেলকে তরঙ্গ বরাদ্দ দেওয়া হয়নি।
তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু প্রথম আলোকে বলেন, এগুলোকে কেন ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি, এ মুহূর্তে তিনি তা বলতে পারছেন না।
তরঙ্গ বরাদ্দ পেল যেসব চ্যানেল: ঢাকা বাংলা টেলিভিশনের (ডি বাংলা) ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী। তাঁর সঙ্গে আছেন কয়েকজন প্রবাসী ব্যবসায়ী। নিউ ভিশন টিভির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ আলমগীর। তিনি বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক। চ্যানেলটির সুপারিশকারী সাংসদ সুকুমার রঞ্জন ঘোষ। রেনেসাঁ টিভির চেয়ারম্যান পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। এটি শুধু শিশুদের জন্য বিশেষ চ্যানেল।
রংধনু টিভির মালিকানায় আছেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ও সাংসদ এইচ এম ইব্রাহিম। যাদু টিভির চেয়ারম্যান এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও মোহাম্মদী গ্রুপের চেয়ারম্যান আনিসুল হক। আমার গান টিভির চেয়ারম্যান তরুণ দে। এর সঙ্গে জড়িত আছেন সাংস্কৃতিক জগতের কয়েকজন ব্যক্তি। চ্যানেল টোয়েন্টিওয়ানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন। এর সঙ্গে জাসদের কয়েকজন নেতা জড়িত আছেন। এটিভি চ্যানেলের মালিক চলচ্চিত্র প্রযোজক, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা ও বনানীর চেয়ারম্যানবাড়ির আব্বাস উল্লাহ সিকদার।
নিউজ টোয়েন্টিফোরের মালিক ইস্টওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ (বসুন্ধরা গ্রুপ)। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান। বাংলা টিভি হবে প্রবাসীদের চ্যানেল। এর মালিক আবদুস সামাদ।
নতুন লাইসেন্স পাওয়া এসব চ্যানেল কর্তৃপক্ষের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁদের বেশির ভাগই অর্থসংকটে আছেন। বিনিয়োগকারী খুঁজছেন অনেকেই। কেউ বা বিনিয়োগকারী ঠিক করে তরঙ্গ বরাদ্দের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
তথ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানায়, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও যোগ্য জনবল দিয়ে এই ১০টি চ্যানেল চালু করতে কমবেশি এক হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। ১০টি চ্যানেলের মধ্যে ১০০ কোটি টাকা খরচ করার মতো সামর্থ্য আছে তিন-চারজনের।
জানতে চাইলে ইকবাল সোবহান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সবাই চেষ্টা করবে যার যার চ্যানেল গড়ে তোলার জন্য। তিনি তাঁর চ্যানেল পেশাদারত্বের সঙ্গে পরিচালনা করবেন।
তথ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, এমন লোকদের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে, যাঁদের অনেকের টিভি চ্যানেল স্থাপন ও পরিচালনার সক্ষমতা নেই। বেশি দামে শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে তাই তাঁরা অর্থ উপার্জনের পথ বেছে নিয়েছেন। আগের চ্যানেলগুলোর বেশির ভাগের ক্ষেত্রেও মালিকানা পরিবর্তন ও শেয়ার হস্তান্তর হয়েছে।
তরঙ্গ বরাদ্দ পাননি যাঁরা: গ্রিন টিভির মালিক নিশাদ দস্তগীর লাইসেন্স পেলেও তরঙ্গ বরাদ্দ পাননি। তিনি জ্বালানি খাতে ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এবং লন্ডনভিত্তিক সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সম্পৃক্ত। চ্যানেলটির সুপারিশকারী হলেন সাবেক পরিবেশ ও বনমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। ছাড়পত্র পাননি ক্যামব্রিয়ান টেলিভিশনের মালিক এম এ বাশারও। বিএসবি-ক্যামব্রিয়ানের এই কর্ণধারের রাজনৈতিক পরিচয়সহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ড এবং সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন মূল্যায়ন করে সরকার তাঁকে তরঙ্গ বরাদ্দ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বাংলাদেশ টেলিভিশনের উপমহাপরিচালক (অনুষ্ঠান) বাহারউদ্দিন খেলনের চ্যানেল ৫২ তরঙ্গ বরাদ্দ পায়নি। বিতর্কিত ব্যবসায়ী মুসা বিন শমসেরকে কীর্তিমান বাঙালি হিসেবে বিটিভিতে তুলে ধরা এবং তদন্তে বাহারউদ্দিনের সম্পৃক্ততা প্রমাণ হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে তাঁকে তরঙ্গ বরাদ্দ দেওয়া হয়নি বলে তথ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে। তিনি দ্বিতীয় দফায় স্ত্রীর নামে আবেদন করেছিলেন।
তিতাস টিভির সঙ্গে আছেন সাংবাদিক সেলিম ওমরাও খান, ধানাদ ইসলাম প্রমুখ। এর সুপারিশকারী মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সাবেক প্রতিমন্ত্রী এ বি তাজুল ইসলাম। এই চ্যানেলটিও ছাড়পত্র পায়নি। ছাড়পত্র না পাওয়ার তালিকায় আরও আছে উৎসব টিভি। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূর মোহাম্মদ। চ্যানেলটির সুপারিশকারী সাংসদ মমতাজ বেগম।
চালু থাকা চ্যানেলগুলো: বর্তমান সরকারের গত আমলে ২০০৯ সালের অক্টোবরে ১০টি চ্যানেলকে লাইসেন্স দেওয়া হয়। এগুলো হচ্ছে ৭১ টিভি, চ্যানেল নাইন, সময় টিভি, বিজয় টিভি, গাজী টিভি (জিটিভি), ইনডিপেনডেন্ট টিভি, মাছরাঙা টিভি, এটিএন নিউজ, মাই টিভি ও মোহনা টিভি। এ ছাড়া ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে চ্যানেল টোয়েন্টিফোর এবং এপ্রিলে এসএ টিভির লাইসেন্স দেওয়া হয়।
২০১১ সালের জুনে এশিয়ান টিভি, অক্টোবরে গানবাংলা টিভি এবং ডিসেম্বরে দীপ্তবাংলা টিভির লাইসেন্স দেওয়া হয়। তিন বছর ধরে দীপ্তবাংলা টিভি চালু করার চেষ্টা চলছে এবং এর মালিকানায় রয়েছে কাজী ফার্মস।
২০০৫ ও ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকার ১০টি টিভি চ্যানেলের লাইসেন্স দিয়েছিল। এগুলো হচ্ছে বৈশাখী, আরটিভি, বাংলাভিশন, ইসলামিক টিভি, দেশ টিভি, দিগন্ত টিভি, সিএসবি, চ্যানেল ওয়ান, এসএ টিভি, যমুনা টিভি। এগুলোর মধ্যে ইসলামিক, দিগন্ত, সিএসবি ও চ্যানেল ওয়ানের সম্প্রচার স্থায়ী বা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।