চামড়াজাত পণ্য

আরও সাহস প্রয়োজন

অ্যাপেক্স কারখানায় কাজ করছেন একজন কর্মী। ছবি: খালেদ সরকার
অ্যাপেক্স কারখানায় কাজ করছেন একজন কর্মী। ছবি: খালেদ সরকার

১৯৯০ সাল। নতুন একটা স্বপ্ন-বাংলাদেশ থেকে নতুন একটি রপ্তানি পণ্য—চামড়ার জুতা। বাংলাদেশের কাঁচা চামড়ার মজুত, কাঁচা চামড়াকে পাকা চামড়ায় প্রক্রিয়াকরণের পরীক্ষিত সক্ষমতা, বিশ্বের অনেক বাজারে প্রবেশে বাংলাদেশের সুবিধাজনক অবস্থান এবং আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি: বাংলাদেশের কর্মঠ শ্রমিক ভাই ও বোনেরা। তাঁদের কর্মের প্রতি আগ্রহ, শ্রম ও নিষ্ঠা এবং ত্যাগ সত্যিই আমাদের দেশের প্রধান চালিকা শক্তি।
১৯৯০ সালে যখন আমরা প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ থেকে সম্পূর্ণ চামড়ার জুতা উৎপাদন করার প্রস্তুতি নিলাম মাত্র এক হাজার জোড়া দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন ছোট্ট একটি ফ্যাক্টরি থেকে, এটা ছিল সত্যি একটি সাহসী উদ্যোগ। তখন অতটা অনুধাবন করতে না পারলেও এখন চিন্তা করলে তাই মনে হয়। কারণ, নব্বইয়ের দশকে এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত সারা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তর জুতা উৎপাদনকারী দেশ, সেই ভারত থেকেও মাত্র জুতার ওপরের অংশ রপ্তানি হচ্ছিল। তারাও সেই সময়ে সম্পূর্ণ প্রস্তুত জুতা রপ্তানিতে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ জুতা উৎপাদনকারী দেশ চীন, মাত্র রপ্তানিমুখী জুতাশিল্পে তাদের প্রাধান্য বিস্তার করতে শুরু করেছে। ইউরোপ থেকে মাত্রই ইস্টার্ন ইউরোপ দেশগুলোতে উৎপাদন স্থানান্তর শুরু হয়েছে। ঠিক এই সময়ে বাংলাদেশ থেকে আমরা আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন জুতা উৎপাদন করে বিশ্বের সেরা বাজার ইউরোপ ও জাপানে প্রবেশ করতে পারব, বেশি চিন্তা করলে হয়তো প্রথমেই বেগ পেতে হতো। সাহস জোগানো হতো না। কিন্তু আমাদের চামড়াশিল্পে ঐতিহ্য ও সক্ষমতা, আমাদের প্রযুক্তি গ্রহণ করার আগ্রহ, আমাদের বিদেশি সহযোগীদের উৎসাহ এবং আমাদের উদীয়মান উদ্যোক্তাদের সাহস আমাদের এগিয়ে নিয়ে গেল। অন্যরা পারলে আমাদেরও পারতে হবে।
তারপর এল আরেক বিরাট চ্যালেঞ্জ—জাপানি বাজারের মান অর্জন করা। অনেক কষ্টে যখন জাপানে একটি বিশাল জুতা বিপণনকারীর সঙ্গে ব্যবসা শুরু করার সুযোগ এল এবং তারা আমাদের বিশ্বাস করে তাদের অর্ডার দিল, প্রশ্ন এল—সেই মান কি আমরা অর্জন করতে পারব? প্রথম অর্ডারেই ৯৭ ভাগ জুতা তারা গুণগতমানের কারণে বর্জন করল। এখনো মনে পড়ে সেই দিনগুলোর কথা। আমরা কিছু নিবেদিতপ্রাণ মানুষ ফ্যাক্টরিতে দিন-রাত কাটিয়েছি; আতিক, মুশতাক, বাবুল, মেরী, আমেনা এবং আমাদের প্রথম বস হামিদ ভাই। কিন্তু আমরা হাল ছাড়িনি। জাপানি কারিগরি সহযোগিতা নিলাম, তাদের কাছ থেকে শিখতে চাইলাম। জুতা মান-নিয়ন্ত্রণ টেবিলের ৪ ফুট ওপরে ছিল আমাদের আলো। শিখলাম নামাতে হবে টেবিলের ২ ফুট ওপরে। তাহলে জুতার ওপরের খুব সূক্ষ্ম দাগ আরও সহজে দেখা যাবে। সমস্যা থেকে লুকানো যাবে না, দেখার ক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে। কেইজেন—জাপানি মান ব্যবস্থাপনা শিখলাম। সাহস পেয়েছিলাম দলের প্রত্যেকের কাছ থেকে: আমরা পারব, পারতেই হবে।
তার কিছু বছর পর এল নতুন সমস্যা—জাপানের বাজারে মন্দা, আবার ইউরোপে ফিরতে হবে। কিন্তু কোনো ইউরোপিয়ান ক্রেতা বাংলাদেশের শুধু একটি ছোট ফ্যাক্টরি দেখে ঝুঁকি নিতে রাজি নয়। তার ওপরে বাংলাদেশ থেকে লিড টাইম বেশি, দামও খুব একটা কম নয়। তখন আমাদের পরিচালকমণ্ডলী এবং আমাদের বিনিয়োগকারী শেয়ারহোল্ডাররা আবারও সাহসের পরিচয় দেখালেন।
কোম্পানির আর্থিক অবস্থা খুব ভালো না হওয়া সত্ত্বেও আবারও বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিল: কোম্পানির মূলধন এবং উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হলো। কিছু প্রয়োজনীয় জুতার উপকরণ তৈরি করে লিড টাইম কমানো হলো এবং সার্বিকভাবে ইউরোপিয়ান ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার জন্য বিভিন্ন প্রচেষ্টা নেওয়া হলো, যদিও কোনো নিশ্চয়তা ছিল না যে এসব উদ্যোগ ফলপ্রসূ হবে। বাস্তবে তা করার পরও অনেক দিন লেগেছে সে আস্থা অর্জন করতে।
সব প্রচেষ্টা-পরিকল্পনা গ্রহণের পরও ক্রেতাদের আস্থা অর্জন করতে অনেক সময় লেগে গেল। দুর্লভ আস্থাকে পুঁজি করে, কিছু নতুন ঝুঁকি নেওয়ার সাহস করলাম। প্রথমদিকে ইউরোপিয়ান বাজারে প্রবেশ করতে আমরা একটি ইতালীয় কোম্পানির সহযোগিতা নিয়েছিলাম। বিদেশি ক্রেতারা তাদের সঙ্গে অনেক বছরের ব্যবসার কারণে একটি আস্থার জায়গা তৈরি করেছিল এবং সেটাকে কাজে লাগিয়ে আমরা তাদের সঙ্গে ব্যবসা শুরু করি। কিন্তু তাদের বিশ্বাস অটুট রাখার দায়িত্ব ছিল আমাদের। তাই প্রথম কয়েক বছর রপ্তানি হতো তাদেরই মাধ্যমে, অর্থাৎ জুতা আমাদের কারখানা থেকে আগে ইতালিতে তাদের কাছে রপ্তানি হতো, সেখানে আবার কিছু ফিনিশিং এবং মান নিয়ন্ত্রণের পরে সরবরাহ হতো ক্রেতাদের কাছে।এই করে আমাদের ঝুঁকি কম ছিল কিন্তু রপ্তানিমূল্য এবং মুনাফা দুটোই কম ছিল। এরপর আমরা মনস্থির করলাম যে আমরা ফ্যাক্টরি ডাইরেক্ট হব—তার মানে অ্যাপেক্সের কারখানা থেকে সরাসরি পরিপূর্ণ জুতা রপ্তানি ও সরবরাহ হবে বিদেশি বিপণনকারীর কাছে। থাকবে না মাঝখানে কোনো সংস্থা। আমাদের কাঁধে পুরো দায়িত্ব। মনে রাখতে হবে তখনো বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য রপ্তানিমুখী জুতার শিল্প গড়ে ওঠেনি। ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে রপ্তানিযোগ্য চামড়ার জুতা পাওয়া যায় তা মোটেও বিশ্বাস করে না। ঠিক এ অবস্থায় এত বড় সাহস—ফ্যাক্টরি ডাইরেক্ট? আমরা আমাদের প্রায় ১০০ বিদেশি ক্রেতার সঙ্গে আলোচনা শুরু করলাম, তাদের বোঝালাম কেন এই নতুন প্রচেষ্টা। আমাদের এই শতাধিক ক্রেতা সাহস দিল। আমরা মূল বিপণনকারীর সঙ্গে সরাসরি ব্যবসা শুরু করলাম, যা আমাদের প্রবৃদ্ধিকে আরও মজবুত ও গতিশীল করল।
২০১৩ সাল। আমরা দেখতে পাচ্ছি অন্যের ওপর নির্ভরশীল প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট প্রক্রিয়া আমাদের অগ্রযাত্রায় একটি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।ব্যবসা হচ্ছে ঠিকই কিন্তু আমরা পরাধীন। আবারও সাহসের প্রয়োজন। এবার শুরু হলো প্রজেক্ট ইনডিপেনডেন্স—স্বাধীনতা। আমাদের পণ্যের নকশা ও উন্নয়ন করার সক্ষমতা আমাদের নিজেরই তৈরি করতে হবে। যদিও জানতাম না যে আমরা এই প্রচেষ্টায় আদৌ সফল হতে পারব কি না এবং আমাদের ক্রেতারা এই পদক্ষেপ কীভাবে দেখবেন। যাহোক সফল হলাম কিন্তু আমাদের সর্ববৃহৎ ক্রেতা আমাদের সঙ্গে ব্যবসা বন্ধ করে দিল। বলল আমরা পারব না। আমরা তাদের বোঝানোর সব চেষ্টা করলাম। অর্ডার দিল না। তারা চলে গেল। আমাদের রপ্তানি সাময়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো সেই বাজারে, কিন্তু এক বছর পরে তারা আবার ফিরল, দেখল আমরা সত্যিই সক্ষম হয়েছি।
বাংলাদেশের প্রতিটি ব্যবসায়, প্রত্যেক উদ্যোক্তার আমাদের মতো এমন অজস্র সাহসের উদাহরণ রয়েছে। কোনো সময় উদ্যোক্তাদের সাহস, কোনো সময় আমাদের কর্মঠ জনগণের সাহস, কখনো বা বিনিয়োগকারীদের সাহস বা এমনকি ক্রেতাদের সাহস। অনেক সময় সাহস করে ভুল করেছি, লোকসানও হয়েছে। কিন্তু আজ এতটুকু উপলব্ধি করছি যে সাহস না করলে কিছুই করা সম্ভব নয়। তাই সব সময় মনে করি ড. এ পি জে আবদুল কালামের সেই কথাগুলো, ‘স্বপ্ন সেটা নয় যেটা মানুষ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখে; স্বপ্ন সেটাই যেটা পূরণের প্রত্যাশা মানুষকে ঘুমাতে দেয় না।’ সাহস করে অনেক রাত ঘুম হবে না এটা ঠিক, কিন্তু নতুন একটি দিনের সন্ধানও মিলতে পারে। বাংলাদেশের প্রতিটি ছোট, মাঝারি ও বড় উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীর সাহসকে আজ আমি সালাম জানাতে চাই।
নাসিম মঞ্জুর: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেড।