ঝুঁকিপূর্ণ পেশা

আমি বেঁচে আছি

আড়াই মাস হাসপাতালে থাকার পর বাড়ি ফিরে যাওয়ার দিন। এখনো পুরো সুস্থ নন। হাসপাতালে তাঁকে ঘিরেই অনুষ্ঠান। তাঁর হাতেই ক্যামেরা। এটাই বোধ হয় একজন সংবাদচিত্রীর পরিচয়। ছবি: হাসান রাজা
আড়াই মাস হাসপাতালে থাকার পর বাড়ি ফিরে যাওয়ার দিন। এখনো পুরো সুস্থ নন। হাসপাতালে তাঁকে ঘিরেই অনুষ্ঠান। তাঁর হাতেই ক্যামেরা। এটাই বোধ হয় একজন সংবাদচিত্রীর পরিচয়। ছবি: হাসান রাজা

রাতে প্রধান চিত্রসাংবাদিক জিয়া ইসলামের ফোন। বললেন, গাজীপুরে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ছবি তুলতে যেতে হবে। সঙ্গে সম্পাদকের বিশেষ অ্যাসাইনমেন্ট—গাজীপুর হাইওয়েতে অব্যবস্থাপনা। সকালে বৃষ্টি উপেক্ষা করে মোটরসাইকেলে ছুটে চলি। স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারি, আওয়ামী লীগের সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী আজমত উল্লাহর বাসায় বিদ্রোহী প্রার্থী জাহাঙ্গীর আসছেন। প্রচণ্ড বৃষ্টি। আজমত উল্লাহ ও জাহাঙ্গীর একসঙ্গে প্রচারণা করছেন, সে ছবি তুললাম। তেমন কোনো অঘটন না ঘটায় আমরা সবাই অন্যদিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ঢাকা থেকে অ্যাসাইনমেন্টে আসা প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক শরিফুল হাসানের কাছে জানতে চাই, বিশেষ কিছু কি আর আছে? ও বলল, ‘ছবি ছাপা হবে না, ক্যান আসছ, সেলিম ভাই, চইলা যাও।’
চলে যাই সম্পাদকের অ্যাসাইনমেন্টে মনোযোগ দিতে। একে একে সব ছবি তুলে তখন শেষ একটি যানজটের ছবি তুলতে যাচ্ছি গাজীপুর চৌরাস্তার দিকে। স্ত্রী রাখী ফোন করে বলল, ‘আমার ভালো লাগছে না। আয়াতুল কুরসি পড়ে তাড়াতাড়ি ঢাকায় চলে এসো।’ তিন মাস আগে মা হারিয়েছে রাখী। সেই কষ্ট এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি ও। মোটরসাইকেল রেখে আয়াতুল কুরসি পড়ে একটি তিনতলা মার্কেটের সিঁড়ি বেয়ে ছাদে যাই। ক্যামেরা বের করি। দেখি, বৈদ্যুতিক তারের জন্য রাস্তার যানজটের ছবি হবে না। অন্য বিল্ডিংয়ে যেতে হবে। ঠিক সে সময় ঘটল আমার জীবনের চরম ভয়াবহ এক অভিজ্ঞতা! প্রচণ্ড কোনো ধাক্কায় জ্ঞান হারালাম আমি।
২.
গাজীপুর সদর হাসপাতালে নেওয়ার সময় আমার জ্ঞান ফিরে আসে। ঘিরে থাকা অচেনা মানুষজনকে বলি, ‘আমার কী হয়েছে, ভাই?’ আমাকে জানানো হয়, আমি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েছি। পরে জানতে পারি, ছাদে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে যখন পড়ে ছিলাম, তখন মার্কেটের নিচতলার ওষুধ ব্যবসায়ী তোফায়েল সাহেব আমাকে উদ্ধার করতে দৌড়ে আসেন। আমার জ্ঞান ছিল না। হাসপাতালে শরিফুল হাসান ও প্রথম আলোর গাজীপুর প্রতিনিধি মাসুদ রানাকে দেখে সাহস পাই।
আমাকে নিয়ে অপারেশন থিয়েটারে চিকিৎসকদের ব্যস্ততা। হাসান চিৎকার করছে, ‘ভাই, তাড়াতাড়ি করেন।’ আমাকে ব্যথানাশক ইনজেকশন দিয়ে তাড়াতাড়ি ঢাকা মেডিকেলে নেওয়ার পরামর্শ দিলেন চিকিৎসকেরা। হাসান ও মাসুদ ভাই আমাকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকার পথে রওনা হলেন। রাস্তার যানজট এড়ানোর জন্য গাজীপুর পুলিশ ও পরে ঢাকায় ট্রাফিক পুলিশ যথেষ্ট সহযোগিতা করে। পথে অনুভব করি, পায়ে বড় কোনো ক্ষতি হয়ে গেছে। আমার মাথার কাছে হাসান, অন্য পাশে মাসুদ ভাই, আমাকে উদ্ধারকারী অঘোর ও তোফায়েল সাহেবও ছিল। হাসানের কাছে জানতে চাই, বাঁচব তো? আর তখনই মনে পড়ে ছোট ছেলেটার কথা, বউয়ের মুখখানি। রাখীর মা নেই, ওরা কতই না অসহায় হয়ে পড়বে। সে সময় আমার জীবনটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ মনে হতে থাকল। জানতে চাইলাম, সামন্তদাকে (ডা. সামন্তলাল সেন) জানানো হয়েছে? ও বলল, ‘সব তৈরি আছে, তুমি কোনো চিন্তা কোরো না।’

একসময় কারওয়ান বাজার পার হতে হতে অফিসটা অনুভব করি। প্রায় দুই ঘণ্টা পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছালাম।

৩.

ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটের প্রধান সামন্তলাল সেনকে ফুল দিয়ে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন জাহিদুল করিম। যেন বলছেন, ‘আপনাদের জন্যই বাড়ি ফিরে যেতে পারছি’

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের আশপাশ লোকে লোকারণ্য। আমাকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ঢুকতেই পরিচিত সব মুখ দৌড়ে আসে। বন্ধু বিরাজকে বলি, ‘রাখীকে (স্ত্রী) আসতে দিস না, ও সহ্য করতে পারবে না।’ অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে পুড়ে যাওয়া সব চামড়া কেটে ফেলা হলো, মাথায় সেলাই পড়ল। জানা গেল, শরীরের ১৭ শতাংশ পুড়ে গেছে। আমি আশঙ্কামুক্ত। আরও পরীক্ষার পর আশ্বস্ত হলাম, শরীরের ভেতরের অংশে ক্ষতি হয়নি। ডা. সামন্তলাল সেনের তত্ত্বাবধানে আমাকে সব চিকিৎসা শেষে নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি করা হলো।
২৬ জুন থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে থেকেছি। প্রথম আলোর ফটোগ্রাফি বিভাগের সহকর্মীরা প্রায় প্রতিদিন পালা করে হাসপাতালে এসেছেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ওষুধপথ্য কেনা—সবকিছুই করেছেন তাঁরা অ্যাসাইনমেন্টের ফাঁকে ফাঁকে।
আমার সন্তানের বয়স তখন সাত মাস। স্ত্রী রাখী প্রতিদিন ভোর ছয়টায় চলে আসত। দুপুরে শুধু বাড়ি যেত সন্তানকে স্তন্যপান করাতে। আবার সন্ধ্যা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত থাকত আমার পাশে। ভাগনিজামাই আবদুল্লাহ আল মাহমুদ প্রতি রাতেই থেকেছে আমার কাছে। হাসপাতালের বয়-নার্স থেকে শুরু করে চিকিৎসকদের একান্ত পরিচর্যায় আমি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠছি। এই সময় আমার কোনো ইনফেকশনের ভয়ে আমার সহকর্মী ও স্বজনেরা অনেকেই চিকিৎসকদের অনুরোধে হাসপাতালে আসা থেকে বিরত থেকেছেন। ঢাকা মেডিকেল সম্পর্কে অনেকের ভিন্ন ধারণা থাকলেও আমি দেখেছি মাত্র কয়েকজন চিকিৎসক-নার্স-বয় মিলে শত শত মানুষের চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন অক্লান্তভাবে। তাঁদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।

দুর্ঘটনার পর শঙ্কিত হয়েছিলাম এই ভেবে যে, সারাজীবনের মতোই বুঝি পঙ্গু হয়ে গেলাম। কিন্তু পেশাদারি জায়গা থেকে সরে যাইনি। এটা তো আমার নতুন জীবন। এই নতুন জীবনের স্বাদ পুরোপুরি পেতে চাই। আবার প্রথম আলোর ফটোগ্রাফি বিভাগে নিজের চেয়ারটায় বসব, কম্পিউটারে ছবি সম্পাদনা করব, অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে ছুটব দূরে কোথাও।

স্বপ্নের কাজগুলো তো করতে হবে। স্বপ্ন নিয়েই তো বাঁচে মানুষ।

জাহিদুল করিম: জ্যেষ্ঠ ফটো সাংবাদিক