অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার হয়ে কলেজশিক্ষার্থী সানজিদা এখন ঢাকায় বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি। ২ ডিসেম্বর তাঁর এইচএসসি পরীক্ষা।
দিন দশেক পরই (২ ডিসেম্বর) এইচএসসি পরীক্ষা। পড়াশোনায় কোনো ঘাটতি রাখতে চাননি সানজিদা খাতুন (১৮)। রাজশাহী সিটি কলেজের এই শিক্ষার্থী এক শিক্ষকের কাছে পড়তে যেতেন শহরে। গত রোববার সন্ধ্যার দিকে ফেরার সময় বাড়ি থেকে প্রায় ২০ গজ দূরত্বে অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার হয়ে তিনি এখন হাসপাতালে ভর্তি।
সানজিদার বাড়ি নাটোর সদর উপজেলার লালমনিপুর গ্রামে। তিনি জানান, হঠাৎ মাহিম হোসেন (২১) নামের এক তরুণ তাঁর মুখে অ্যাসিড ছুড়ে পালান। তরুণটি তাঁকে উত্ত্যক্ত করতেন।
অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনাটি সানজিদার শিক্ষকদের জানানো হয়েছে। কিন্তু তিনি এখন পরীক্ষা কীভাবে দেবেন, তা নিয়েই বেশি দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। আইন বিষয়ে পড়ার আগ্রহের কথা জানিয়ে সানজিদা প্রথম আলোকে বলেন, ‘সামনের মাসে আমার পরীক্ষা। আমি কীভাবে পরীক্ষা দেব?’
অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনার পর নাটোর ও রাজশাহীর হাসপাতালে নেওয়া হয় সানজিদাকে। সেখান থেকে গতকাল সোমবার ভোরে তাঁকে রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। গতকাল দুপুরে হাসপাতালটিতে গিয়ে সানজিদার খোঁজ করতেই কর্তব্যরত নার্সরা জানালেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চোখের চিকিৎসক দেখাতে নেওয়া হয়েছে তাঁকে। কারণ, তাঁর চোখও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেলা দুইটার দিকে সানজিদাকে আবার বার্ন ইনস্টিটিউটে আনা হয়।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন প্রথম আলোকে বলেন, অ্যাসিডের কারণে সানজিদার কপালের নিচ থেকে মুখমণ্ডল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পোড়ার হার শরীরের ৩ শতাংশ। তাঁর অস্ত্রোপচার লাগবে। কয়েক দিন তাঁকে পর্যবেক্ষণ করে অস্ত্রোপচারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। তিনি আরও বলেন, দীর্ঘদিন অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনা বন্ধ ছিল। ইদানীং দু-একটা ঘটনা দেখা যাচ্ছে। এই রোগীদের শারীরিক যন্ত্রণার চেয়ে মানসিক যন্ত্রণা অনেক বেশি হয়ে থাকে।
অ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনায় মাহিম হোসেনকে গ্রেপ্তার করেছে নাটোর পুলিশ। গতকাল সকালে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একটি দল তাঁকে নাটোরের দত্তপাড়া এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে। এর আগে তাঁর বিরুদ্ধে সদর থানায় মামলা করেন অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার ওই শিক্ষার্থীর বাবা নুরুল ইসলাম। বিকেলে আদালত তাঁকে জেলা কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
সানজিদার মা পারুল খাতুন প্রথম আলোকে জানান, তাঁর এক ছেলে এক মেয়ে। বড় সন্তান সানজিদা ছোট থেকেই পড়াশোনায় ভালো। এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন। মেয়েকে রাজশাহী সিটি কলেজে ভর্তি করান। করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সানজিদা বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা করছিলেন।
সেদিনের ঘটনা প্রসঙ্গে পারুল খাতুন বলেন, ‘ও নাটোর শহরে পড়তি যায়। সেখান থেকে ফিরতি ফিরতি এক ঘণ্টা লাগে। সেদিন অ্যাসিড ছুড়ে মারার সঙ্গে সঙ্গে ও মা মা বলে ডাকতিছিল। কিন্তু আমি বাড়ি থেকে বুঝতে পারিনি। কিছুদিন আগে একবার বলিছিল, একটি ছাওয়াল ওকে বিরক্ত করে। তখন বলিছি, ও রকম ছাওয়ালপাওয়ালের সাথে কথা কইয়ো না।’
পরিবার জানায়, চার মাস আগে সানজিদার বিয়ের আলোচনা শুরু হয়েছিল। পড়াশোনায় ভালো হওয়ার পরও মেয়েকে এই বয়সেই বিয়ে কেন দিতে চান, এ প্রশ্নে তাঁর মা পারুল বলেন, ‘কী করিব। গ্রামে থাকি। মানুষ খুব জ্বালায়।’ তিনি অ্যাসিড নিক্ষেপকারীর কঠোর শাস্তি দাবি করেন।
এদিকে নাটোরের পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহা বলেন, অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার ওই শিক্ষার্থীর বর্ণনা ধরেই পুলিশ মাহিম হোসেনকে গ্রেপ্তার করেছে। তিনি এলাকার একজন চিহ্নিত বখাটে। মাস তিনেক আগে পারিবারিকভাবে সানজিদার বিয়ে ঠিক হয়। মাহিমের হস্তক্ষেপে ওই বিয়ে ভেঙে যায়। এ নিয়ে বিরোধের জের ধরেই মাহিম সানজিদাকে অ্যাসিড নিক্ষেপ করে।
সানজিদার ঘটনায় উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এক বিবৃতিতে বলেছে, নারী ও কন্যাশিশুরা অব্যাহতভাবে ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, অ্যাসিড-সন্ত্রাস, যৌন নিপীড়নসহ নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। সানজিদার ওপর হামলাকারীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং সানজিদার সুচিকিৎসা ও পরিবারের নিরাপত্তার দাবি জানানো হয় বিবৃতিতে।
সানজিদার ওপরে অ্যাসিড নিক্ষেপের প্রতিবাদ ও অভিযুক্তের বিচারের দাবিতে আজ মঙ্গলবার প্রথম আলো ট্রাস্টের পক্ষ থেকে নাটোর সদরে প্রেসক্লাবের সামনে সকাল ১০টায় মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়েছে। এতে সহায়তা করবেন প্রথম আলো বন্ধুসভার সদস্যরা।