দেশের সংস্কৃতিচর্চা কোন পথে

‘আমাদের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর দায়ও কম নয়’

স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হয়ে এসে বাংলাদেশের সংস্কৃতির হাল–হকিকত এখন কেমন? বাঙালির বর্ষবরণের ক্ষণে তা বুঝে নিতে প্রথম আলো মুখোমুখি হয়েছে নাট্যসংগঠক, নাট্যপরিচালক ও অভিনেতা মামুনুর রশীদের। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আলতাফ শাহনেওয়াজ

নাট্যসংগঠক, নাট্যপরিচালক ও অভিনেতা মামুনুর রশীদ
প্রথম আলো
প্রশ্ন

১. ১৯৫০–৬০–এর দশকে এ দেশের সংস্কৃতিচর্চা অভূতপূর্ব কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। অতিমারির সময়টুকু বাদ দিলে দেশে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পরিমাণ অনেক বেড়েছে। কিন্তু অনেকে বলছেন, এই চর্চা থেকে দেশের বৃহত্তর মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে আপনার অভিমত কী?

মামুনুর রশীদ : মুক্তিযুদ্ধের আগে বাংলাদেশে সংস্কৃতির সঙ্গে রাজনীতির একটা নিবিড় যোগসূত্র ছিল। সংস্কৃতি ও রাজনীতি একত্রে হাত ধরাধরি করে হেঁটেছিল বলেই উনসত্তরের গণ–অভ্যুত্থান বা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা যে এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনের পতন ঘটালাম, সেখানেও সংস্কৃতি আর রাজনীতি পরস্পরের সঙ্গী ছিল। মূলত এর পর থেকেই আমাদের সংস্কৃতিচর্চার রূপটি ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে। পরিস্থিতি এখন আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। সংস্কৃতিচর্চার সঙ্গে জনগণের বিচ্ছিন্নতা ব্যাপকভাবে বেড়েছে।

সাধারণত এমনিতেই আমরা বাঙালি না মুসলমান, এই সংশয়ের মধ্যে থাকি। ১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর ধর্মভিত্তিক রাজনীতি রাষ্ট্রীয়ভাবে উৎসাহিত হওয়ায় এ সংশয় আরও বেড়েছে। এখন এটা ভয়াবহ। এমনকি বর্তমান সরকারও নিজেদের স্বার্থে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে ব্যবহার করেছে। এখন তো ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে ওয়াজ মাহফিল হতে দেখা যায়। পক্ষান্তরে বর্ষা উৎসব, বসন্ত উৎসব—এসব আয়োজন কমেছে। এ–ও বলা দরকার যে সংস্কৃতি থেকে জনগণের শেকড় ছিন্ন হওয়ার পেছনে আমাদের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর দায়ও কম নয়। ধর্মান্ধ গোষ্ঠীগুলো বরাবরই সক্রিয়, কিন্তু বাঙালি সংস্কৃতির প্রসারে সংগঠনগুলো কী করছে?

পয়লা বৈশাখ আমাদের লোকায়ত উৎসব। সে উৎসবে কৃষির সঙ্গে যুক্ত মানুষের জীবনযাপনের উপকরণ পাওয়া যেত। করপোরেট আর এজেন্সিগুলো এখন বর্ষবরণের উৎসবকে দখল করেছে। একে একে আমাদের সব উৎসবকেই তারা দখল করেছে। আদতে আমাদের সংস্কৃতি এখন ক্ষমতাবানদের হাতে চলে গেছে। ফলে প্রাণের যোগ গেছে কমে, প্রায় সবই এখন আনুষ্ঠানিক। তাই সংস্কৃতির সঙ্গে জনতার বন্ধনও ক্রমেই আলগা হয়ে গেছে।

প্রশ্ন

২. স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মবর্ষ উপলক্ষে সরকারি–বেসরকারি নানা স্তরে দুই বছর ব্যাপক সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখান থেকে কতটা ফসল আমরা ঘরে তুলতে পারলাম?

মামুনুর রশীদ : সত্যিকার অর্থে, অধিকাংশ উৎসবই সাধারণভাবে সর্বস্তরে হয়নি। স্বীকার করি, করোনা পরিস্থিতি একটি বড় বাস্তবতা ছিল। তারপরও বলব, সরকার একটি কমিটির মাধ্যমে সব নিয়ন্ত্রণে রেখে উৎসবগুলো করেছে। নিয়ন্ত্রিত সংস্কৃতিচর্চার প্রভাব জনগণের কাছে কমই পৌঁছায়। মুক্তিযুদ্ধ আর বঙ্গবন্ধু, দুটি বিষয়ের ভিত্তিই গণচেতনা। কিন্তু এই বিষয় দুটি উদ্‌যাপনের মধ্যে গণ–অংশগ্রহণ কোথায়?

বঙ্গবন্ধুর মতো এত বড় একজন নেতার মূল্যায়ন অত্যন্ত সুচিন্তিতভাবে হওয়া দরকার ছিল। তা হলো কোথায়? এলোমেলোভাবে নানাজনের অসংখ্য বই প্রকাশিত হলো। এর বদলে যদি বঙ্গবন্ধুর লেখা বইগুলোই বিভিন্ন স্তরে পড়ানোর জন্য পৌঁছানো যেত, তা আরও বেশি কার্যকর হতো। উত্তর–প্রজন্ম বাঙালির শ্রেষ্ঠ নেতাকে জীবনের ভেতর থেকে আত্মস্থ করতে পারত।

রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে কলকাতার নাট্যদলগুলোকে স্টুডিও থিয়েটার হল করে দেওয়া হয়েছিল। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে আমরা যদি এমন কিছু করতে পারতাম, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতো বলে আমার বিশ্বাস। এবার খরচ হয়েছে প্রচুর, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর মর্ম গণমানুষের কাছে আমরা পৌঁছে দিতে পারিনি।

প্রশ্ন

৩. মুক্তিযুদ্ধের সময় যে ধরনের সমাজ ও মূল্যবোধের স্বপ্ন আমরা দেখেছি, তা বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদের সংস্কৃতিকে এখন কীভাবে অর্থবহ করে তুলতে পারি? আমাদের কী করা উচিত?

বাঙালি সংস্কৃতির অন্তর্নিহিত উপাদানগুলোকে বিকশিত করার উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য ধর্মান্ধতাকেন্দ্রিক বাধাগুলো অতিক্রম করতে হবে। প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে কেবল ভোটের কারণে ধর্মকে ব্যবহারের মনোবৃত্তি বাদ দিতে হবে।

সর্বোপরি সংস্কৃতিকে দেখতে হবে গণমানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে। আর এর জন্য যে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন, তা জনতার মধ্য থেকেই আসতে হবে। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ওপর থেকে কোনো কিছু চাপিয়ে দিলে তা অকার্যকর হতে বাধ্য।