বৃহস্পতিবার। টেনশন বা উৎকণ্ঠাহীন এমন বৃহস্পতিবার এক দশক পর বোধ হয় এই প্রথম। কারণ, অনিবার্য ঘটনা ঘটে গেলে আর তো কোনো উৎকণ্ঠা থাকে না। বিষাদময় নির্ভার যেন।
‘উস্তাদ কখন পাঠাবেন?’
‘এই তো কিছুক্ষণ পর।’
তারপরই মেসেঞ্জারে মেসেজ—
‘আর ইউ রেডি? রাশিফল স্টার্ট।’
কাওসার আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে বৃহস্পতিবারের এমন বাতচিত ছিল নিয়মিত। গত কয়েক সপ্তাহ বাতচিতের ধরন আর ব্যক্তি বদলে গিয়েছিল। সজীব মিয়া ফোনে জিজ্ঞাসা করতেন, ‘ভাইয়া, আজ কি পাব?’
আমি জ্যোতিষী কল্লোল দাসকে ফোন করতাম, ‘আজ কি কাওসার ভাই লিখতে পারবেন?’ কল্লোল জানাতেন, ‘আমি স্যারের বাসায় যাচ্ছি। গিয়ে জানাব।’
একটু পর ফোন দিয়ে বলতেন, ‘না। আজ স্যার পারছেন না। কথা বলুন।’
কাওসার ফোন ধরে বলতেন, ‘পল্লব, আজ হবে না। চিন্তা করতে পারছি না। চিন্তা করতে না পারলে “আপনার রাশি” লেখা যায় না।’
ওদিকে শনিবার সকাল থেকেই প্রথম আলোর সাপ্তাহিক ক্রোড়পত্র ছুটির দিনের ফেসবুক পেজের ইনবক্স ভরে যেত পাঠকের প্রশ্নে প্রশ্নে। ‘আজ রাশিফল প্রকাশিত হয়নি?’ ‘আপনার রাশি কোথায়?’
গত ১ জানুয়ারি ‘ছুটির দিনে’তে কাওসার আহমেদ চৌধুরীর শেষ লেখা প্রকাশিত হয়। সেটা বিশেষ। ১২ রাশির জাতক-জাতিকাদের কেমন যাবে ২০২২, তা লিখেছেন।
কাওসার আহমেদ চৌধুরী নিজে ধনু রাশির জাতক। ধনু নিয়ে লিখেছিলেন, ‘প্রিয় ধনু, সারাটা জীবন আপনি সাহসের বন্দনা করে গেলেন। এই সাহস নিয়ে আপনি দুরূহ অতীতকে অতিক্রম করেছেন...আগামী দিনেও করবেন, এই আমার বিশ্বাস। যদি না পারেন, তাহলে আমাকে এসে কিছু তিরস্কার করে যাবেন। আপনার জন্য ২০২২ হতে যাচ্ছে একটি সুনির্বাচিত বছর। বছরটিতে আপনি পাবেন বেশি, হারাবেন কম। এর চেয়ে বেশি কিছু তো আর বলার থাকতে পারে না। তখন আপনি বলবেন, দেড়ে জ্যোতিষীর বেড়ে কাজ!’
‘দেড়ে জ্যোতিষী’ নিজেই তো বেড়ে কাজ করলেন। শুধু ধনু নয়, সব রাশির জাতক-জাতিকাদের মধ্যে পাওয়ার থেকে হারানোর বেদনাই দিয়ে গেলেন। এই যে নিজেকে নিয়ে ‘দেড়ে জ্যোতিষী’ কিংবা মাঝেমধ্যে ‘দরিদ্র জইত্যেষী’ বলা—এ তো আর অন্য কারও পক্ষে সম্ভব নয়। মাঝেমধ্যে মুঠোফোনে তাঁর খুদে বার্তা—‘হাম্বা’, রিপ্লাইও দিতে হতো ‘হাম্বা’ বলে। আবার ‘কেইস্যা হুয়া-হুক্কাহুয়ামার্কা’ বার্তারও আদান-প্রদান চলত।
১৯৯৯ সাল থেকে তিনি প্রথম আলোর সঙ্গে রয়েছেন। ‘ছুটির দিনে’তে প্রতি শনিবার হাজির। সেই শুরু থেকেই তুমুল জনপ্রিয়। যাঁর রাশিফলে বিশ্বাসও নেই, তিনিও এর পাঠক। নিজের রাশির প্যারাটা তো পড়েনই, বাকি ১১টা রাশির কথাও পড়া যায় সাবলীলভাবে। কারণ, যাত্রা নাস্তি, বিদেশ যাত্রার যোগ, নতুন কর্মে শুভ হবে—এ-জাতীয় রাশিফল থেকে তিনি বের করে এনেছেন। আপনার রাশি তাই হয়ে উঠেছিল শনিবারের অবশ্য পাঠ্য এক বিষয়।
গান-কবিতার লাইন, রসবোধ, নিজের দীর্ঘজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে সাজানো হতো রাশিফলের অনুচ্ছেদগুলো। কেউ কেউ বলতেন, ‘আমার রাশিতে যা বলেছেন, তা তো মাথার ওপর দিয়ে গেল। বুঝিয়ে বলেন।’ আমি ফোন দিতাম কাওসার আহমেদ চৌধুরীকে, ‘ওস্তাদ, কী বুঝাইছেন অমুক রাশিতে।’ ব্যাখ্যা দিতেন। লেখা থেকেই শুধু নয়, সামনাসামনি ‘হাত’ দেখিয়েও অনেকে সমাধান পেতেন। কিন্তু কাওসার আহমেদ চৌধুরী আসলে হস্তরেখা দেখতেন না। তিনি যে কাজটি করতেন, তা হলো জন্মসংখ্যা, জীবনের বিভিন্ন তারিখ মিলিয়ে সংখ্যাতত্ত্বের প্রয়োগ। আর মূল কাজটা ছিল কাউন্সেলিং।
কাওসার আহমেদ চৌধুরী ‘ছুটির দিনে’ ছাড়া আর কোথাও লিখতেন না। নিজেই লিখেছেন এক লেখায়, “‘ছুটির দিনে” ছাড়া আমার আর কোনো শাখা নেই।’ কেমন করে প্রথম আলোতে এলেন, তা শোনা যাক তাঁর জবানিতে, ‘আমি যে কীভাবে প্রথম আলোতে লিখতে শুরু করলাম, তার পেছনে কিছু মজার ইতিহাস আছে। শুনতে চাইলে বলতে পারি। ধরে নিচ্ছি, আপনি শুনতে চান। তাহলে এবার বলি, ১৯৯৮ সালের ৪ নভেম্বর প্রথম আলো আত্মপ্রকাশ করল। ১৯৯৯-এর কোনো এক সময়ে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, অর্থাৎ আমাদের মতি ভাই আমাকে ডেকে পাঠালেন। “আপনি তো জ্যোতিষ চর্চা করেন; তাহলে আমাদের পত্রিকায় রাশিফল লিখতে শুরু করুন।” আমি একটু ভয় পেলাম। মতি ভাই বললেন, “কেন, আপত্তি আছে?” আমি আমতা-আমতা করে বললাম, “আপনি তো বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ, আপনি কেন এসব বিশ্বাস করেন?” তিনি বললেন, “এটা একটা বিশ্বজনীন আগ্রহের বস্তুতে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর সব দেশের পত্রপত্রিকায় নিয়মিত রাশিফল ছাপানো হয় পাঠকের মানসিক চাহিদা পূরণের জন্য।” তারপর তিনি একটু বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, “যা দেখতে পাচ্ছি, আপনি তো একজন একগুঁয়ে ধরনের লোক।” আমি নিচু কণ্ঠে বললাম, “আপনিও তো কম যান না।” মতি ভাই ফাইল থেকে চোখ তুললেন, “কী বললেন?” আমি বললাম, “না, কিছু না।” এই তো মোটামুটি আমার রাশিফল লেখা শুরু হয়ে গেল। আমি ভাবলাম, রাশিফল যখন লিখতেই হবে, তাহলে এখানে অঙ্কের কিছু যুক্তি আনা যাক। একটি কিশোরকে নিয়ে সারা রাত জেগে প্রতিটি রাশির ভর বের করলাম। অর্থাৎ গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান দিয়ে যে রাশি, তার সঙ্গে পিথাগোরাসের নিউমারোলজি মিশিয়ে নিলাম। এর সঙ্গে মিশ্রণ ঘটালাম আমার সিক্সথ সেন্স বা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের।’
২০১২ সালে বেশ কিছু সপ্তাহের একটা গ্যাপ তৈরি হলো কাওসার আহমেদ চৌধুরীর আপনার রাশি লেখায়। একদিন সুমী আপা (প্রথম আলোর ফিচার সম্পাদক সুমনা শারমীন) বললেন, ‘তোমার সঙ্গে তো কাওসার ভাইয়ের সম্পর্ক ভালো। ওনার বাসায় গিয়ে আবার রাশি শুরু করাও।’
তখন কাওসার আহমেদ চৌধুরী থাকেন শংকরের মহুয়া অ্যাপার্টমেন্টে। একা, সঙ্গে এক সহযোগী ছেলে। অনেকক্ষণ কথা হলো। তিনি জানালেন, স্নায়ুরোগের কারণে আঙুলে কলম ধরে লিখতে পারবেন না। তিনি বলবেন, একজন শ্রুতলিখন করে নেবেন। তখন আমাদের লক্ষ্য ছিল নতুন বছরের রাশিফল প্রকাশ। বললাম, এবারেরটা আপনি বলেন, আমি ল্যাপটপে লিখে নিচ্ছি। এভাবে লেখা হলো ‘কাওসার আহমেদ চৌধুরীর দৃষ্টিতে কেমন যাবে ২০১৩?’ ২০১২ সালের ২৯ ডিসেম্বর সেটি হলো ছুটির দিনের প্রচ্ছদ প্রতিবেদন। এরপর আমরা একজন প্রদায়ককে পাঠাতাম তাঁর বাসায়, বুধ বা বৃহস্পতিবার (অবশ্যই তাঁর দেওয়া সময়মতো)। দীর্ঘ সময়ের এ প্রক্রিয়ায় শ্রুতলেখকদের মধ্যে ছিলেন ফিচার বিভাগের সেই সময়ের প্রদায়ক হাবিবুল্লাহ সিদ্দিকী, রাফাত জামিল, এস এম নজিবুল্লাহ চৌধুরী, জাওয়াদ আলম, শাওন খান ও সর্বশেষ ফজলে রাব্বী।
পাঠক, খেয়াল করে দেখবেন, ‘আপনার রাশি বা ভাগ্য জানার উপায়’ বইতে লেখক কাওসার আহমেদ চৌধুরীর একই রকম ছবি ছাপা হচ্ছে। সবুজ চে টুপি পরা শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছেন স্টাইলিশ ভঙ্গিতে। বেশ কয়বার আমরা বলেছি, নতুন ছবি তুলিয়ে নিই বা আপনি দেন। কিন্তু তিনি রাজি হননি। বলতেন, ‘বাইরের দিকে তাকাও, বড় লেখক বা সাহিত্যিকেরা তাঁদের বই বা লেখার সঙ্গে একটা ছবিই ব্যবহার করেন। প্রতিকৃতি তো শুধু ছবি নয়, এটা লেখকের সিম্বল। সিম্বলটা যেন পাঠকের মাথায় গেঁথে যায়।’
২০২০ সালের মার্চে করোনাকাল শুরু হলে কাওসার আহমেদ চৌধুরী ও সুরাইয়া চৌধুরীর একমাত্র সন্তান প্রতীক, অর্থাৎ আহমেদ শাফি চৌধুরী বাসায় সুরক্ষার ব্যবস্থা করলেন। অর্থাৎ বাইরের কেউ বাসায় যেতে পারবেন না। অনেক দিন থেকেই প্রায় শয্যাশায়ী কাওসার আহমেদ চৌধুরী নানা রোগে আক্রান্ত। করোনার সময় তাঁর সুরক্ষা নিশ্চিত করাই প্রথম কর্তব্য।
কাওসার আহমেদ চৌধুরীকে মহুয়া অ্যাপার্টমেন্ট থেকে অনেক আগেই ধানমন্ডির ৯/এ সড়কে নিজের বাসায় এনে রেখেছেন প্রতীক। ছেলে, পুত্রবধূ আর নাতনির সান্নিধ্যে তিনিও আছেন আনন্দে। ‘আপনার রাশি কীভাবে হবে?’ বললাম, আপনি ফোনে বলবেন, কেউ শুনে লিখে দেবে। একদিন বললেন, ‘প্রতীক ট্যাব কিনে দিয়েছে। মেসেঞ্জারে লিখে তোমাকে পাঠাব।’ বাহ্, দারুণ তো! শুরু হলো মেসেঞ্জারে আপনার রাশি। প্রথম দিকে রোমান হরফে বাংলা। কিছুদিনের মধ্যেই ইউনিকোডের বাংলায়। একটা একটা করে ১২টা রাশি আসে মেসেঞ্জারে। এরপর একদিন দেখলাম, খুব দ্রুত লেখা হচ্ছে একেকটার রাশি। জানলাম, তাঁর ভক্ত এক জ্যোতিষবিদ কল্লোল দাস তাঁকে সহযোগিতা করছেন। মানে কাওসার আহমেদ চৌধুরী বলেন, কল্লোল দাস তা শ্রুতলিখন করেন।
শ্রুতলিখন আর মেসেঞ্জার যুগের আগে লেখা শুরুর সময় থেকে কাওসার আহমেদ চৌধুরী ‘ছুটির দিনে’র জন্য নিজেই আপনার রাশি লিখে পাঠাতেন। সে এক দেখার মতো লেখা। ফুলস্কেপ কাগজে নানা রঙ্গের সিগনেচার পেন দিয়ে লেখা। মাঝখানে নানা রকম অলংকরণ, যেন এক শিল্পকর্ম।
কাওসার আহমেদ চৌধুরী ঢাকা আর্ট কলেজে (এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ) ভর্তি হয়েছিলেন। কয়েক বছর পড়াশোনা করে ডিগ্রি না নিয়েই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ইস্তফা দিয়েছেন। কখনো লেখা নিয়ে তিনি নিজেই প্রথম আলোর ফিচার বিভাগে চলে আসতেন। আবার কখনো অফিসে এসে লিখে দিতেন।
কাওসার আহমেদ চৌধুরী যখন অফিসে আসতেন, সে দৃশ্য ছিল দেখার মতো। চোখে রোদচশমা, মাথায় হ্যাট বা টুপি, ব্লেজার, স্টাইলিশ শার্ট পরা দীর্ঘাঙ্গী সুপুরুষ। ঢুকতেন ঝড়ের মতো। তাঁর পকেটে থাকত নানা রকমের সিগারেট, চুরুট, পাইপ। একটা ব্র্যান্ড ছিল, সেটার প্রতিটি সিগারেট ছিল খাপে ভরা, স্ট্রবেরির গন্ধ সেটা। বছর তিন-চার আগের কথা—আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে ভর্তি তিনি। একদিন দেখতে গেলাম। কথা প্রসঙ্গে এল সিগারেটের কথা। তিনি বললেন, ‘দেখো, আমার নানা মারা গেছেন ৮৬ বছর বয়সে, মৃত্যুর আগের দিনও গড়গড়া টেনেছেন।’
নিজেই বলতেন, ‘কাওসার আহমেদ চৌধুরীকে হ্যান্ডল করা সহজ নয়।’ সেটা তাঁর আশপাশে থাকা, ঘনিষ্ঠজনেরা ভালোই বোঝেন। আর এমন বহুমাত্রিক সৃজনশীল মানুষ এমনটা হতেই পারেন। তারপরও এ কথা বলতে হয়, ঝোড়ো চরিত্রের এই মানুষ হাজার হাজার মানুষের মনকে শান্ত করেছেন। জীবনে আশার আলো দেখিয়েছেন। অনেকেই এখন বলছেন, শনিবারের আপনার রাশি পড়ে দুঃসময়ে শান্তি পাওয়া গেছে।
আড্ডার মধ্যমণি হয়ে থাকতেন বন্ধুবৎসল কাওসার আহমেদ। প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের প্রতি ছিল তাঁর অসীম ভালোবাসা। মতি ভাই অসুস্থ হলে সব সময় তাঁর খোঁজ রাখতেন। গত বছরের মে মাসে একদিন খুদে বার্তায় লিখলেন, ‘মতি ভাইয়ের জন্য খুব উদ্বিগ্ন আছি। জানাবে, যখন সময় পাও...।’
ঈদের ছুটিতে বাড়িতে যাচ্ছি, যাত্রাপথে দু-তিনটা খুদে বার্তা। আপনার রাশিফলে কাছের অনেক প্রিয় মানুষের কথা প্রায়ই আসত। ছেলে প্রতীক, নাতনি তৃয়া, পুত্রবধূ লিজা, বড় ভাই ননী চৌধুরীসহ স্বজনদের কথা। আসত তাঁর দুই ‘ভাগ্য জানার উপায়’ আর ‘ঘুম কিনে খাই’-এর কথা। সাংবাদিক জুলফিকার আলী মানিক, এরশাদুল হক টিংকুর কথা থাকত মাঝেমধ্যে। এই দুজন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর কাছেই ছিলেন। তবে বেশি আসত তাঁর সেবকের কথা। এই সেবক হলেন ফুলবাড়িয়ার (ময়মনসিংহ) ছেলে আল আমিন। ২০১৫ সাল থেকে কাওসার ভাইয়ের সঙ্গী ছিলেন তিনি। আল আমিনকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কাওসার ভাইয়ের কোন জিনিসটা বেশি ভালো লাগত?’ ‘স্যার আমার সঙ্গে নানা গল্প করতেন। তাঁর ছোটবেলার কথা, ভাইবোনের কথা, গান লেখার কথা—এসব ভালো লাগত বেশি।’ এই সেবকের সামনেই কাওসার আহমেদ চৌধুরী শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। ২২ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টা ৪০ মিনিটে ধানমন্ডি ক্লিনিকে যখন শেষবারের মতো নিশ্বাস ফেলেন, তখন তাঁর বিছানার এক কোণে বসে ছিলেন আল আমিন।
এ মাসের শুরুতে কল্লোল একদিন ফোনে বললেন, ‘স্যার তো কাউকে চিনছেন না। আপনাকে ভিডিও কল করি। দেখেন।’ ভিডিও কলে কাওসার ভাই চিনতে পারলেন না। অন্য একটি নাম বললেন। পরে জানা গেল, তখন তিনি ইলেক্ট্রোলাইডের ভারসাম্যহীনতায় ভুগছিলেন। তাই স্মৃতিভ্রম। ছেলে প্রতীক বছরখানেক হলো পরিবারসহ অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী। ডিসেম্বরেও এসেছিলেন ঢাকায়। বাবার অসুস্থতার কথা শুনে ৭ ফেব্রুয়ারি চলে আসেন ঢাকায়। কদিন পর আসেন তাঁর স্ত্রী ও মেয়ে। প্রতীক এসে বাবাকে ভর্তি করান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১০ ফেব্রুয়ারি করোনা পরীক্ষায় কাওসার আহমেদ চৌধুরী পজিটিভ হলেন। এরপর তাঁকে ভর্তি করা হলো ধানমন্ডি ক্লিনিকে। এ সময়ে প্রতি মুহূর্তেই চলত লড়াই। প্রতীক জানাতেন, একেকটা অঙ্গ ধীরে ধীরে অকেজো হয়ে যাচ্ছে। ‘আব্বার কষ্ট চোখে দেখা যায় না।’
ক্রিটিক্যাল কেয়ারের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলতেন, ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। নলগুলো খুলে নিলে ২ থেকে ১২ ঘণ্টা বাঁচবেন। সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে পরিবারকে।
প্রতীক বলতেন, ‘কীভাবে এ সিদ্ধান্ত দিই? আব্বা অনেক কষ্ট পাচ্ছেন। কিন্তু আব্বার তো চেতনা আছে। স্পষ্ট না শোনা গেলেও মাঝেমধ্যে নাম ধরেন ডাকেন। পরিচিত কেউ পাশে গেলে হাত ধরে থাকার চেষ্টা করেন। এমন অবস্থায় সব সাপোর্ট তো খুলে দিতে বলতে পারি না।’ দিনরাত বাবার পাশে থেকে ব্যথা যাতে কম পান, সে দোয়াই করে গেছেন তিনি।
ছেলে প্রতীক মহুয়া অ্যাপার্টমেন্টে ফ্ল্যাট ভাড়া করে দিয়েছিলেন কাওসার আহমেদ চৌধুরীকে। কারণ, প্রতীক ও তাঁর মায়ের বাসা কাছেই। দেখাশোনার জন্য আছেন আল আমিন। একদিন কাওসার আহমেদ চৌধুরীকে বললাম, খাবার রান্না করে কে? প্রতীকদের বাসার দিকে আঙুল তুললেন। ‘প্রতীকের মা পাঠায়।’ কথা হয়? ‘ফোনে।’ তবে দেখা-সাক্ষাৎ হয় না। বেশ কিছু বছর আগে কাওসার আহমেদ চৌধুরীর পরিবারে উঠেছিল ঝড়। ঝড়ের ফলাফল স্ত্রী সুরাইয়া চৌধুরীর সঙ্গে বিচ্ছেদ। কিন্তু পরস্পরের প্রতি টান ছিল, যা শেষ দিন পর্যন্ত বোঝা গেছে। প্রতীক বছর চারেক আগে নিজের বাসায় নিয়ে আসেন বাবাকে। তাঁরা থাকতেন দোতলায় আর মা পাঁচতলায়। পাঁচতলা থেকে খাবার আসত দোতলায়। কিন্তু দেখা হতো না। গত বছর, যখন ছেলের পরিবার প্রবাসে। কাওসার আহমেদ চৌধুরী বললেন, ‘তোমাদের “বর্ণিল খাবারদাবার”
ম্যাগাজিনের একটা কপি প্রতীকের মায়ের জন্য পাঠাও। নাম লিখে দেবে।’ সেটি পাঠানোর পর জানালেন, প্রতীকের মা খুব খুশি হয়েছে। কয়েকটা রেসিপি রান্নাও করেছে।
এ রকম সময়ে দেখেছি, আপনার রাশির দৈর্ঘ্য বেড়ে যেত। আবার হয়তো ছোট, যা বোঝার তা বুঝে যেতাম। লেখকের মন খারাপ। মঙ্গলবার মধ্যরাতের দিকে ফ্রিজিং গাড়িসহ আমরা কাওসার আহমেদ চৌধুরীর বাসায় পৌঁছালাম, তখন কথা হলো সুরাইয়া চৌধুরীর সঙ্গে। দোতলায় যে ঘরে তিনি বসে ছিলেন, সেখানে কয়েক বছর আগে গানের জলসা বসিয়েছিলেন কাওসার আহমেদ চৌধুরী। সেটি মনে পড়ল। সুরাইয়া চৌধুরী বললেন, অমন গানের আয়োজন আবার করতে চেয়েছিল কিছুদিন আগে। অনেক মানুষ আসবে, তাই আর করা হয়নি।
মঙ্গলবার বিকেলেও সুরাইয়া চৌধুরী গিয়েছিলেন ক্লিনিকে। পাশে বসে ছিলেন। বললেন, ‘তখনো চেতনা ছিল। প্রতীক ওর বাবার জন্য যা করেছে, তা সর্বোচ্চ।’ আল আমিন জানালেন, খালাম্মাকে দেখে স্যারের চোখে খুশি দেখা যেত। আসলে এই দুজনের সীমান্তেই তো ছিল দুজনের বসন্ত।
সনদপত্র না নিয়েই চারুকলার পাঠ চুকিয়েছিলেন কাওসার আহমেদ চৌধুরী। তিনি অংশ নিয়েছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে। ছিলেন মুজিব নগর সরকারের গোয়েন্দা। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্র নেননি তিনি। তাই তো বুধবার আজিমপুর কবরস্থানে দাফনের সময় ছিল না কোনো গার্ড অব অনার। বিউগলের করুণ সুর।
নিউমারোলজি, অর্থাৎ সংখ্যাতত্ত্বের জ্যোতিষ চর্চা করতেন তিনি। তাঁর চিরবিদায়ের দিনটির তারিখ দেখা যাক—২২.০২. ২০২২। এ তারিখ প্যালিনড্রোম সংখ্যা। মানে হলো বাঁ ও ডান দুই থেকে পড়লে একই সংখ্যা থাকে। আবার তাঁর জন্মতারিখ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৪৪। ১৬ ডিসেম্বর পরবর্তীকালে বাংলাদেশের বিজয় দিবস।
গান, কবিতা, রাশিফল—সবটাতেই বিজয়ীর বেশে কাওসার আহমেদ চৌধুরী বিদায় নিলেন। তাঁর গানে লিখেছেন, ‘মিনতি করি আমাকে হাসি মুখে বিদায় জানাও...।’
তো ‘উস্তাদ’, বিদায়। সীমান্তের ওই পাড়ে আপনার বসন্তে ভালো থাকুন।
২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২