চট্টগ্রামের ব্যাটারি গলির বাসা থেকে বের হওয়ার কিছুক্ষণ পরই নিখোঁজ হন সাংবাদিক গোলাম সারোয়ার। তিন দিন পর ২০২০ সালের ১ নভেম্বর সীতাকুণ্ডের একটা খালের পাশের ঝোপের ভেতরে তাঁকে পড়ে থাকতে দেখা যায়। প্রায় সংজ্ঞাহীন অবস্থায় স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় তাঁকে উদ্ধার করে পুলিশ।
গোলাম সারোয়ার উদ্ধার হওয়ার পরপরই একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। ভিডিওতে অনেক মানুষের কথার মধ্যে দুজনের কথা পরিষ্কার শোনা যায়। তাঁদের একজনের চেহারা ভিডিওতে স্পষ্ট নয়। তিনি ফোনে কাউকে বলছিলেন, ‘ও (সারোয়ার) তো স্যার সেন্সলেসের মতো।...ব্রিজের নিচে পাইছি তাঁকে।’ তাঁর কথা ছাপিয়ে শোনা যায়, গোলাম সারোয়ারের অনুনয়। কাছে যে-ই এগিয়ে আসছিলেন, তাঁর হাত ধরে তিনি বলছিলেন, ‘প্লিজ, প্লিজ, আমি আর নিউজ করব না।’
উদ্ধার হওয়ার পর কিছুটা সুস্থ হয়ে স্ত্রী ও সাংবাদিক নেতাদের সঙ্গে নিয়ে সারোয়ার কোতোয়ালি থানায় যান। তিনি অজ্ঞাতনামা ছয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপহরণের মামলা করেন।
সম্প্রতি কোতোয়ালি থানার পুলিশ সারোয়ারের মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ধর্মেন্দু দাশ গতকাল রোববার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সারোয়ার অপহৃত হয়েছিলেন, এমন কোনো তথ্য-প্রমাণ তদন্তে পাওয়া যায়নি। সারোয়ারও অপহৃত হওয়ার বিষয়টি প্রমাণ করতে পারেননি। এ কারণে মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছি।’
পুলিশের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করা হবে কি না, এ বিষয়ে আগামীকাল ২৮ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের অতিরিক্ত মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে শুনানি হওয়ার কথা আছে।
মামলায় পুলিশের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সারোয়ার বলেন, ‘আমাকে কি তাহলে কেউ অপহরণ করেনি?’
সারোয়ারের করা মামলায় পুলিশ যখন চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে, তখন চট্টগ্রামের আদালতে আনিসুজ্জামান চৌধুরী ১০০ কোটি টাকার মানহানির মামলা করেছেন। চট্টগ্রাম প্রতিদিনের সম্পাদক, সারোয়ারসহ তিনজনের বিরুদ্ধে এই মামলা করা হয়েছে। ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ভাই আনিসুজ্জামান চৌধুরী।
সারোয়ার আজকের সূর্যোদয় পত্রিকার স্টাফ রিপোর্টার। তিনি সিটি নিউজ বিডি ডটকমের নির্বাহী সম্পাদক ও প্রকাশক। এই পত্রিকায় ‘চট্টগ্রামে ব্যবসায়ীর জমিতে ভূমিমন্ত্রীর ভাইয়ের কুদৃষ্টি’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। এ প্রতিবেদনের কারণেই বিপদে পড়েছেন বলে মনে করছেন সারোয়ার।
গত বছরের ৪ নভেম্বর চট্টগ্রাম প্রতিদিন পত্রিকায় চট্টগ্রামে সাংবাদিক নিখোঁজের নেপথ্যেসংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
গত বছরের ৯ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের আদালতে আনিসুজ্জামান চৌধুরী ১০০ কোটি টাকার একটি মানহানির মামলা করেন। মামলায় চট্টগ্রাম প্রতিদিনের সম্পাদক হোসেন তৌফিক ইফতেখার, পরামর্শক সম্পাদক ও প্রকাশক অয়ন শর্মা ও সাংবাদিক গোলাম সারোয়ারকে আসামি করা হয়। মামলাটি পিবিআই তদন্ত করে তিন আসামির বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দেয়।
ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ভাই আনিসুজ্জামান চৌধুরী। আনিসুজ্জামান চৌধুরীর একান্ত সচিব মো. বোরহান উদ্দিন চৌধুরী জেলা প্রশাসক বরাবর একটি আবেদন করেছেন। এতে সারোয়ারের সাংবাদিকতার সনদ যেন বাতিল করা হয়, সে আবেদন জানানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের জানুয়ারিতে সারোয়ারকে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করেন সহকারী কমিশনার।
সারোয়ারের মামলার এজাহারে যা আছে
কোতোয়ালি থানায় করা মামলায় সারোয়ার উল্লেখ করেছেন, ২০২০ সালের ২৮ অক্টোবর রাতে তিনি কাজ শেষে তাঁর ব্যাটারি গলির বাসায় ফেরেন। ভাত খেয়ে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে তাঁর গ্রামের বাড়িতে যাওয়া জন্য বের হন। রাত ১১টা ৫৫ মিনিটের দিকে চট্টেশ্বরী সড়কের গুলশান ক্লাবের নিচে খোকনের মোটরসাইকেলের গ্যারেজে যান তিনি। কর্ণফুলী নতুন ব্রিজ এলাকায় যাওয়ার জন্য মোটরসাইকেলে চেপে রওনা দেন। কিছু দূর যেতে না যেতেই কাজীর দেউড়ি ভিআইপি টাওয়ারের এফএনএফ ইলেকট্রনিকসের সামনের রাস্তার ওপর মোটরসাইকেলটি থেমে যায়। অজ্ঞাতনামা একজন লোক এ সময় তাঁর সিটের পেছনে উঠে নাকেমুখে চেতনানাশক দেন।
সারোয়ার বলেন, তিনি কতক্ষণ সংজ্ঞাহীন ছিলেন, তা জানেন না। জ্ঞান ফেরার পর অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের শব্দ শুনতে পান। অজ্ঞাতস্থানে তাঁকে গাছজাতীয় কোনো কিছু দিয়ে পায়ে এলোপাতাড়ি মারা হয়। এ ছাড়া বেল্ট দিয়ে বুকে ও পিঠে পেটানো হয়। ঘুষি মারা হয়। মারধরের সময় অপহরণকারীরা বলতে থাকে, ‘আর নিউজ করবি কি না বল?’
জীবিত রাখা হবে, না খুন করা হবে, সে আলাপও ফোনে করতে শোনেন সারোয়ার। তবে অন্যপ্রান্ত থেকে খুন না করার করার নির্দেশ আসে। সাংবাদিকদের ভয় দেখানোর জন্য তাঁকে অপহরণ করা হয়েছে বলে জানানো হয়। এ সময় চোখ ও পা বাঁধা অবস্থায় তিনি অপহরণকারীদের কথা ছাড়া ট্রেনের শব্দ শুনতে পেয়েছেন।
‘বাদী মোটা, অপহৃত হলে ফুটেজে দেখা যেত’
পুলিশ বলেছে, গুলশান ক্লাবের নিচে মোটরসাইকেল গ্যারেজের সামনে, কাজীর দেউড়ি ও ভিআইপি টাওয়ারের এফএনএফ ইলেকট্রনিকসের সামনের মোট চারটি ক্যামেরার ফুটেজ দেখেছে তারা। ফুটেজ দেখার সময় তাঁদের সঙ্গে সারোয়ারের নিকটাত্মীয় আবিদ বিন হারুন ছিলেন। তাঁরা কেউ ফুটেজে সারোয়ারকে দেখতে পাননি।
চূড়ান্ত প্রতিবেদনে পুলিশের মন্তব্য, বাদী মোটা। তাঁর পরনে ছিল কালো গেঞ্জি। মোটরসাইকেলচালকের হেলমেট ছিল। বাদী অপহরণের শিকার হলে ফুটেজে দেখা যেত। এফএনএফ ইলেকট্রনিকসের সামনে ভিআইপি টাওয়ারের কাছে দুজন নিরাপত্তাকর্মী ছিলেন। ব্যাংকের বুথেও ছিলেন একজন নিরাপত্তাকর্মী। তাঁরা কেউ বাদীকে দেখেননি। বাদী সুঠামদেহী হওয়ায় তাঁকে চেতনানাশক দেওয়ার চেষ্টা হলে ধস্তাধস্তি হওয়ার কথা। এমন কিছু হওয়ার তথ্য তাঁরা পাননি।
অজ্ঞাতস্থানে থাকার সময় কথোপকথনে সংবাদ লেখার কারণে বাদীকে অপহরণ করা হয়েছে বলে যে দাবি সারোয়ার করেছেন, তার কোনো প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া যায়নি। চিকিৎসক বাদীর কাঁধ ও পায়ে ভোঁতা অস্ত্রের সামান্য আঘাতের চিহ্ন পেয়েছেন। এই আঘাতও সামান্য। সারোয়ারের অভিযোগের সঙ্গে তা মেলে না।
সারোয়ার উদ্ধারের পর তাঁর মুখে দাড়ি ছিল না। তিন দিন অজ্ঞাতবাসে থাকলে তাঁর দাড়ি ওঠার কথা। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এমন যুক্তিও দেখিয়েছে পুলিশ।
অনেক প্রশ্নের উত্তর অজানা
সারোয়ারের অভিযোগ, তাঁকে অপহরণ করা হয়েছিল মোটরসাইকেল থেকে। সেই মোটরসাইকেলটি কোথায়, সেটি খুঁজে বের করার কোনো চেষ্টা পুলিশ করেছিল কি না, চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তার উল্লেখ নেই।
পুলিশের দাবি, তারা সারোয়ারের নিকটাত্মীয় আবিদ বিন হারুনকে সঙ্গে নিয়ে ভিডিও ফুটেজ দেখেছে। গতকাল রাতে আবিদ বিন হারুন প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাটারি গলির মুখে একটি সিসি ক্যামেরা আছে। ওই ক্যামেরায় সারোয়ারকে বাসায় ঢুকতে ও বের হতে দেখা গেছে। এর বাইরে আরও যে ফুটেজ পুলিশ দেখেছে বলে দাবি করছে, সেগুলো তাঁকে দেখানো হয়নি।
রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে যে স্থান থেকে সারোয়ার অপহরণের শিকার হন বলে উল্লেখ করেছেন, সে জায়গাটি ছিল অন্ধকার। অন্ধকারের কারণে ফুটেজ না-ও পাওয়া যেতে পারে বলে মনে করেন তিনি। তা ছাড়া বাড়িতে যাওয়ার জন্য ২৮ অক্টোবর তিনি দাড়ি কামিয়ে ছিলেন।
সারোয়ার বলেন, ‘আমাকে উদ্ধারের পর ভিডিও ফুটেজে আমার মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি ছিল। কিন্তু পুলিশ এখন দেখতে পাচ্ছে না। ডাক্তার বলেছেন, ভোঁতা অস্ত্রের আঘাত আছে। কিন্তু পুলিশ এখন আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না।’