সৌদি আরবের রিয়াদের (ক্রিমিনাল কোর্ট ৬) আদালতে আবিরন বেগম হত্যা মামলার আনুষ্ঠানিক শুনানি শুরু হয়েছে। ১৬ ডিসেম্বর প্রথম শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে।
মানবাধিকারকর্মী এবং নারী অভিবাসন নিয়ে কর্মরত ব্যক্তিরা বলছেন, সৌদি আরবে নির্যাতন বা হত্যার শিকার হওয়ার পর রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে আনুষ্ঠানিকভাবে বিচার শুরু হওয়ার নজির কম।
খুলনার আবিরন বেগম সরকারিভাবে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে সৌদি আরবের রিয়াদে গিয়েছিলেন ২০১৭ সালে। দুই বছর তিন মাস পরে গত বছর আবিরন লাশ হয়ে দেশে ফেরেন। লাশের সঙ্গে থাকা আবিরনের মৃত্যুসনদে মৃত্যুর কারণের জায়গায় লেখা ছিল মার্ডার (হত্যা)।
আবিরনের পরিবারের পক্ষ থেকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিয়ে রিয়াদে দূতাবাসের প্রথম সচিব মো. সফিকুল ইসলাম ও অনুবাদক সুহেল আহমেদ আদালতে শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন। প্রথম দিনের শুনানি শেষে আবিরন হত্যা মামলায় আটক তিন সৌদি নাগরিক হলেন আবিরনের গৃহকর্তা বাসেম সালেম, তাঁর স্ত্রী আয়েশা আল জিজানি এবং এই দম্পতির ছেলে ওয়ালিদ বাসেম সালেমের জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করেছেন। ১৭ ডিসেম্বর রিয়াদের বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সেলর (শ্রম) মো. মেহেদী হাসানের সই করা এক চিঠিতে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
দূতাবাসের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, আবিরনের মৃত্যুতে আদালত দুঃখ প্রকাশ করেছেন। হত্যার প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন করে সৌদি শরিয়া আইন অনুযায়ী যথাযথভাবে বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন হবে বলেও আদালত উল্লেখ করেছেন। মামলার তিন অভিযুক্ত আসামি জেলখানা থেকে ভার্চ্যুয়ালি অংশ নেন। এ সময় তাঁদের আইনজীবীও উপস্থিত ছিলেন। শুনানিতে অভিযুক্ত আসামিরা তাঁদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। অভিযোগপত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট ও ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা এবং হত্যায় সহযোগিতা করার কথা উল্লেখ আছে।
প্রথম দিনের শুনানি শেষে আদালত আবিরনের ওয়ারিশদের পাঠানো পাওয়ার অব অ্যাটর্নিতে কিছু অতিরিক্ত ক্ষমতা সংযোজন করে আবার পাঠানোরও নির্দেশ দিয়েছেন।
সন্তান না হওয়ায় ২০ বছর আগে স্বামী তাড়িয়ে দিলে আবিরন বাবার বাড়ি ফেরত এসেছিলেন। বিদেশ গিয়েছিলেন বোনদের পড়াশোনা ও পরিবারের খরচ জোগাতে। ছয় বোনের মধ্যে আবিরন ছিলেন মেজ।
গত বছরের ২৪ অক্টোবর ভোরে কফিনে মুড়ে আবিরনের লাশ দেশে আসে। ওই দিনই প্রথম আলো অনলাইনে ‘কফিনে ফিরল আবিরনের স্বপ্নও’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত প্রতিবেদনটি জাতীয় মানবাধিকার কমিশন স্বতঃপ্রণোদিত (সুয়োমোটো) হয়ে আমলে নিয়ে এক সদস্যবিশিষ্ট একটি তথ্যানুসন্ধান কমিটি গঠন করে এবং কমিশনের অবৈতনিক সদস্য নমিতা হালদারকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। বছরটির ২৫ নভেম্বর খুলনার পাইকগাছা উপজেলার রামনগর গ্রামে আবিরনের বাবা আনছার সরদারের (বর্তমান বয়স ৭৫) বাড়ি সরেজমিন পরিদর্শন করে নমিতা হালদার মানবাধিকার কমিশনের কাছে একই বছরের ১৫ ডিসেম্বর প্রতিবেদন জমা দেন।
নমিতা হালদার তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশে রিয়াদ দূতাবাসের মাধ্যমে আবিরনের জন্য ক্ষতিপূরণ আদায়, অভিযুক্ত নির্যাতনকারীদের আদালতের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশ করেছিলেন।
নমিতা হালদার এর আগে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। শনিবার প্রথম আলোকে বললেন, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে গৃহশ্রমিক হিসেবে কাজ করতে যাওয়া নারী শ্রমিকদের নির্যাতন বা নির্যাতন করে মেরে ফেলার ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত, পরিবারের পক্ষ থেকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিয়ে সৌদি আরবে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু করা হয়েছে এ ধরনের নজির কম। তাই আবিরন ন্যায়বিচার পাবেন, সে প্রত্যাশা করা যায়।
মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৪০ বছরের বেশি বয়সী আবিরনকে পিটিয়ে, গরম পানিতে ঝলসে অর্থাৎ বিভিন্ন নির্যাতন করে সৌদি আরবে খুন করা হয়। সাত মাস সেখানকার এক মর্গে ছিল আবিরনের লাশ।
আবিরনের বোন রেশমা খাতুনও প্রথম আলোকে বলেছেন, আবিরন যে বাসায় কাজ করতেন, সেখানে মোট আটজন পুরুষ থাকতেন। তাঁরা আবিরনকে যৌন নির্যাতনও করতেন। খাবার খেতে না দেওয়া, গ্রিলে মাথা ঠুকে দেওয়াসহ নানান নির্যাতন তো ছিলই। আবিরন দুই বছরের বেশি সময় কাজ করলেও তাঁর পরিবার মাত্র ১৬ হাজার টাকা পেয়েছে। দালাল চক্রসহ অন্যরা আবিরনের বেতনের টাকা আত্মসাৎ করেছে।
ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বললেন, আবিরনের হত্যা মামলায় শুনানি শুরু হয়েছে। সৌদি আরবে একটি ঘটনাতেও বা প্রতীকীভাবে একটি মামলাতেও যদি অভিযুক্তদের শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হয়, তখন অন্য মালিকেরা কিছুটা হলেও সচেতন হতে বাধ্য হবেন।
আবিরনের পরিবার লাশ পরিবহন, সৎকারসহ সরকারের কাছ থেকে এ পর্যন্ত মোট ৩ লাখ ৩৫ হাজার টাকা পেয়েছে।