আবাসিকের ঐতিহ্য হারাচ্ছে ধানমন্ডি

.

আবাসিক এলাকা বলে পরিচিত ধানমন্ডির ৪৮ ভাগ ভবনেই রয়েছে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। পুরোপুরি আবাসিক হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে মাত্র ৫২ ভাগ ভবন। ইংরেজি সাপ্তাহিক প্রোব নিউজ ম্যাগাজিন-এর এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। চলতি বছরের মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে এই জরিপ চালানো হয়।
ধানমন্ডির দক্ষিণে ১ নম্বর সড়ক, উত্তরে ২৭ নম্বর (পুরোনো) সড়ক, পূর্বে গ্রিন রোড ও মিরপুর রোড এবং পশ্চিমে সাতমসজিদ সড়ক ও পুরোনো ১৯ নম্বর সড়কের মধ্যবর্তী এলাকা ছিল জরিপ এলাকা। গবেষক দল এ এলাকার প্রতিটি সড়কের প্রতি বাড়ি ও ভবনে গিয়ে বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে তথ্য সংগ্রহ করে। তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করতে তারা প্রতি বাড়িতে দুবার করে যায়।
১৯৫২ সালে আবাসিক এলাকা হিসেবে ধানমন্ডি গড়ে ওঠে। এই এলাকায় ১ নম্বর সড়ক থেকে ২৭ (পুরোনো) নম্বর পর্যন্ত মোট ৩১টি সড়ক আছে। এই ৩১টি সড়কে মোট ১ হাজার ৫৯২টি ভবন আছে। এর মধ্যে নির্মাণাধীন ভবনই আছে ১২০টি। জরিপে দেখা যায়, ১ হাজার ৫৯২টি ভবনের মধ্যে আবাসিক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে ৮২৩টি। আবাসিক কাম বাণিজ্যিক ৫৩২টি এবং শুধু বাণিজ্যিক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে ২৩৭টি ভবন। অর্থাৎ মোট ভবনের শতকরা ৫২ ভাগ আবাসিক আর আবাসিক কাম বাণিজ্যিক এবং বাণিজ্যিক মিলে শতকরা ৪৮ ভাগ ভবন বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।
খাবার দোকান: জরিপে দেখা গেছে, ধানমন্ডি এলাকায় খাবার ও খাবারজাত প্রতিষ্ঠান রয়েছে ২৭৩টি। এর মধ্যে রেস্টুরেন্ট ১২২টি, ফাস্টফুড ৮৪টি, মিষ্টির দোকান ৩১টি, বেকারি ২৫টি এবং বিরিয়ানির দোকান রয়েছে ১১টি।
জরিপে প্রাপ্ত তথ্যমতে ধানমন্ডিতে শপিং মল ও ছোট পরিসরের মার্কেটের সংখ্যা মোট ২২টি। শপিং মল, মার্কেট এবং বিভিন্ন সড়কে অবস্থিত মোট দোকানের সংখ্যা ১ হাজার ৩৬১টি। এ ছাড়া আছে বিউটি পারলার ৩২টি, ব্যাংকের শাখা ৬২টি।
ধানমন্ডির বাণিজ্যিক রূপান্তর নিয়ে ক্ষোভ আছে বাসিন্দাদের মধ্যে। ধানমন্ডির বাসিন্দা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ধানমন্ডি এলাকা এখন বাণিজ্যিক এলাকা হয়ে গেছে, এটা বোঝার জন্য জরিপের প্রয়োজন নেই। সকালে স্কুলগুলোয় আর রাতে মার্কেট, খাবারের দোকানে আসা গাড়িগুলো রাখা হয় রাস্তায়। যানজট লেগেই থাকে। আর খেলাধুলা, সকাল-সন্ধ্যায় একটু হাঁটা তো অসম্ভব।’
আবাসিক এলাকায় গড়ে ওঠা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বিষয়ে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পরিচালক (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ) গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, আবাসিক এলাকায় গড়ে ওঠা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। আবাসিক অনুমতি নিয়ে বাণিজ্যিক কাজ চালাচ্ছে যারা, তাদের বিরুদ্ধে রাজউক পদক্ষেপ নেবে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান: ধানমন্ডি এলাকায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট সহযোগী প্রতিষ্ঠান রয়েছে মোট ১৩৩টি। এর মধ্যে স্কুল ৪৮টি, কলেজ ১৪টি, মেডিকেল কলেজ ৪টি, ডেন্টাল কলেজ ২টি, বিশ্ববিদ্যালয় ১৬টি, কোচিং সেন্টার ২০টি, ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ৮টি, স্টুডেন্ট কনসালটেশন সেন্টার ১৭টি এবং ড্রাইভিং ট্রেনিং সেন্টার রয়েছে ৪টি। জরিপের তথ্যানুযায়ী ধানমন্ডি এলাকায় প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে মোট ৯৯টি। এর মধ্যে হাসপাতাল ৩৫টি, ক্লিনিক ২২টি, ডেন্টাল ক্লিনিক ২৮টি এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে ১৪টি।
জরিপে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী ধানমন্ডিতে বর্তমানে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা মোট ১১ হাজার ৪২০টি (প্রতি পরিবারের সদস্যসংখ্যা গড়ে পাঁচজন ধরা হলে বর্তমানে ধানমন্ডিতে বসবাসরত জনসংখ্যা আনুমানিক ৫৭ হাজার ১০০ জন)। পরিবার, অফিস ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান মিলে ভবনগুলোয় ব্যবহৃত গাড়ির সংখ্যা ১১ হাজার ৩৭টি।
ধানমন্ডিতে খেলার মাঠ রয়েছে ৫টি। এর মধ্যে ২টি বড় ও ৩টি ছোট। মাঠ জরিপের সময় স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকে বলেছেন, আগে স্থানীয় বাসিন্দাদের অনেকেই শরীরচর্চা ও খেলাধুলা করতে সকাল-বিকেল এসব মাঠে আসতেন। প্রবেশাধিকার সীমিত হওয়ায় তাঁরা এখন মাঠে না গিয়ে ধানমন্ডি লেকে যান। ফলে লেকপাড়ের হাঁটাপথে আগের তুলনায় ভিড় বেড়েছে।
ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান ও নগর পরিকল্পনাবিদ নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান আর্থসামাজিক অবস্থায় শতভাগ আবাসিক এলাকা সম্ভব নয়। কিন্তু ধানমন্ডি এলাকা অনেক বেশি বাণিজ্যিক হয়ে গেছে। কর্তৃপক্ষের জ্ঞাতসারেই এটি হয়েছে। সরকার চাইলে আইন পরিবর্তন করে পরিকল্পিতভাবে আবাসিক-বাণিজ্যিক মিলিয়ে ধানমন্ডি গড়ে তুলতে পারে।