করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনবাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: dp@prothomalo.com
চার মাসের বেশি পার হলো। মেয়েরা একেবারেই ঘরবন্দী। ওরা বলছে, আমি আর তাদের বাবা নানা কাজে বের হচ্ছি, কিন্তু ওরা একবারও বের হতে পারছে না। ঘরে থেকে ওরা হাঁপিয়ে উঠেছে। ওদের বোঝাচ্ছি, এই বৈশ্বিক মহামারিতে সুস্থভাবে ঘরে থাকাটাই বেশি জরুরি। আবার এটাও বুঝতেছি, মানসিক সুস্থতার জন্য খোলা হাওয়ায় শ্বাস নেওয়াও জরুরি। কী যে করব, বুঝে উঠতে পারছি না।
করোনার মধ্যে ঘরবন্দী হয়ে দুই ঈদ পার করলাম। ঈদের আমেজ আনার জন্য ঘরদোর পরিষ্কার আর একটু বিশেষ রান্নাবান্না করা ছাড়া তেমন কিছুই করার নেই। নেই অতিথি আপ্যায়ন, নেই আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে ঘুরতে যাওয়া। করোনা কেড়ে নিয়েছে বাঙালির চিরচেনা ঈদ।
ছোটবেলার ঈদের কথা মনে পড়ে। চার–পাঁচ দিন আগে থেকেই শুরু হতো ঈদের আনন্দ। আমাদের বাড়িতে একটি বড় মেহেদিগাছ ছিল। পাড়ার অনেকেই মেহেদিপাতা নিতে আসত। কে কোন নকশায় মেহেদি লাগাবে, তার আলোচনা চলত। ঈদের নতুন জামা দেখানো যাবে না। ইস্তিরি করা জামা খুললে ভাঁজ নষ্ট হয়ে যাবে, এই অজুহাত দেখিয়ে নতুন জামার চমক দেখাতে ঈদের দিনের অপেক্ষায় থাকতাম।
আমাদের বাড়ির কাছেই ছিল ঈদগাহ ময়দান। চাঁদরাতে সে ময়দান সাজানোর দৃশ্য দেখতে যেতাম। ঈদের মূল উৎসব সেখান থেকেই শুরু। আমরা ছয় ভাই আর তিন বোনের বড়সড় পরিবার। ঢাকায় চাকরি বা পড়াশোনা করা ভাইয়েরা ঈদে বাড়িতে আসত। ছেলেমেয়ে ও নাতি–নাতনিদের একত্রে পেয়ে আব্বা-আম্মার মুখ উজ্জ্বল হতো।
ঈদের সকালে আব্বাসহ ভাইয়েরা পাজামা-পাঞ্জাবি পরে ঈদগাহ ময়দানে যেতেন। তাঁরা ফেরার আগেই সবার ছোট আমরা দুই বোন গোসল সেরে ঈদের জামা পরে ফিটফাট। তাঁরা এলেই বড় বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে একসঙ্গে মায়ের হাতের খিচুড়ি আর মাংস খাওয়া হতো।
তারপর পাড়ার বন্ধুদের বাড়িতে ঘোরাঘুরি। দুপুরে আবার একসঙ্গে মায়ের হাতের পোলাও, কোরমা আর রেজালা। এর মধ্যেই চলে মায়ের অতিথি আপ্যায়ন। বিকেলে রিকশায় করে বন্ধুদের বাড়িতে যাওয়ার অনুমতি ছিল। বন্ধুদের সঙ্গে যেতাম ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ, ওয়াপদা বা ডাকবাংলোয়।
ঢাকার ঈদে সে আনন্দ কোথায়? আমার ২৩ বছরের বিবাহিত জীবনের খুব বেশি হলে চার–পাঁচটা ঈদ ঢাকায় করেছি, তা–ও বিশেষ কোনো কারণে যেতে না পারায়। মেয়েরাও ঈদে দাদুবাড়ি বা নানুবাড়িতে যেতে মুখিয়ে থাকে। বাসের টিকিট কাটা হলেই ঈদের আনন্দের শুরু।
ঈদের সময় ফেরিঘাটে গাড়ির লম্বা লাইন। জ্যামে চার–পাঁচ ঘণ্টাও বসে থাকতে হয়। সময়মতো গাড়িও আসে না। সব মিলিয়ে ঈদের যাত্রা খুবই বিড়ম্বনার। মেয়েদের খুবই কষ্ট হয়। ওদের জিজ্ঞেস করতাম, আর যাবে দাদুবাড়ি? মলিন মুখে হেসে ওরা মাথা নাড়াত। যত কষ্টই হোক, দাদুবাড়ি তারা যাবেই।
আমার শ্বশুরবাড়ির দিকেও ওরা পাঁচ ভাই আর তিন বোন। বড় পরিবারে ঈদের আনন্দ উপচে পড়ে। মেয়েরা নানুবাড়ি বা দাদুবাড়িতে কাজিনদের সঙ্গে চাঁদরাতে বাজি ফোটাতে মেতে উঠত। এরপর মেহেদি লাগানোর পালা। ঈদের দিন তো সালামি নিয়ে বিরাট হইচই।
কোরবানি ঈদের সময় বর্ষা মৌসুম। আমার বাড়তি পাওনা বাড়ির উঠানে বৃষ্টিতে ভেজা আর পুকুরে সাঁতরানো। শৈশবের মতো পুকুরে সাঁতার কাটা এখনো খুব আনন্দের।
কবে যে আবার গ্রামে যাব? সামনে অনিশ্চিত জীবন, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। কিন্তু আগামী ঈদ নিশ্চয়ই হবে করোনামুক্ত আনন্দমুখর পরিবেশে। অন্তত সে প্রত্যাশা করতে দোষ কী!