বিদ্যুৎ পরিস্থিতি

আপাতত লোডশেডিং থেকে মুক্তি নেই

  • বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে দু–এক দিনের মধ্যে সরকারের উচ্চপর্যায়ে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।

  • ঈদের ছুটি এবং বৃষ্টি শুরু হলে বিদ্যুতের চাহিদা কমার আশায় বিদ্যুৎ বিভাগ।

কয়েক দিন ধরে দিনে কয়েকবার লোডশেডিং হচ্ছে খুলনা শহরের বিভিন্ন এলাকায়। গতকাল সকাল নয়টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা পর্যন্ত প্রায় এক ঘণ্টা করে চারবার বিদ্যুৎ ছিল না শহরের বাস্তুহারা এলাকায়। বিদ্যুৎ না থাকায় মোমবাতি জ্বালিয়ে পড়ছে দুই শিশু। রাত নয়টায় শহরের বাস্তুহারা এলাকায়

দেশের উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে নর্দান ইলেকট্র্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) লিমিটেড। রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৬ জেলার মানুষকে বিদ্যুৎসেবা দেওয়ার দায়িত্ব তাদের। উত্তরের জেলাগুলোয় গত কয়েক দিনে বিদ্যুতের লোডশেডিং তীব্র আকার ধারণ করেছে। রাজশাহীর শহরের কিছু এলাকায় ঘণ্টায় ঘণ্টায় বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে।

নেসকোর রাজশাহী অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী আবদুর রশিদ গত মঙ্গলবার দুপুরে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত রোববার দুপুর ১২টা থেকে আমি চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ পাচ্ছি না । তাই দিতে পারছি না। আসলে আমি অসহায়।’

নেসকোর এই প্রকৌশলী জানান, গত সোমবার দুপুর ১২টায় চাহিদা ছিল ৪৬৫ মেগাওয়াট। পাওয়া গেছে ৩৪৬ মেগাওয়াট।

বিদ্যুতের লোডশেডিং থেকে শিগগিরই মানুষের মুক্তি হচ্ছে না—এমন আভাস দিয়েছেন নেসকোর কর্মকর্তারা। এমনকি এই পরিস্থিতি কত দিন চলবে, সেটি তাঁরাও জানেন না।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণকারী কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে, সরবরাহ–সংকট থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাস দেওয়া যাচ্ছে না। বিশ্ববাজারে দাম চড়া, তাই খোলাবাজার (স্পট মার্কেট) থেকে আপাতত তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কিনছে না সরকার।

দেশে যে পরিমাণ গ্যাস সরবরাহ করা হয়, তার একটি বড় অংশ ব্যবহার করা হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনে। শিল্পকারখানায়ও বিপুল পরিমাণ গ্যাস লাগে। লাইনে গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় শিল্পকারখানায়ও উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।

রাজশাহী শহরের বিসিক এলাকার এজি প্লাস্টিক কারখানার স্বত্বাধিকারী আব্দুল গণি জানান, গত রোববার থেকে টানা ৪৫ মিনিট থেকে এক ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না তাঁরা । এতে তাঁর কারখানায় উৎপাদন–বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, তাঁর কারখানায় প্রতিদিন এক লাখ প্লাস্টিক বোতল তৈরি হয়। লোডশেডিংয়ের কারণে ৩৬ হাজারের বেশি বোতল উৎপাদন করা যায়নি।

লোডশেডিংয়ের ক্ষেত্রে এলাকাভিত্তিক সময় নির্ধারণ করে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

রাজশাহীর মতো একই পরিস্থিতি এখন প্রায় দেশজুড়েই। দেশে গত সোমবার দিনে ১২ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১০ হাজার ৮৩১ মেগাওয়াট। সোমবার সন্ধ্যায় সর্বোচ্চ চাহিদার সময় (৬টা থেকে ১১টা) সর্বোচ্চ ১৪ হাজার মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে উৎপাদিত হয়েছে ১২ হাজার ২৩৬ মেগাওয়াট। ঘাটতি ছিল প্রায় দুই হাজার মেগাওয়াট। এ কারণে হচ্ছে লোডশেডিং।

লোডশেডিংয়ের সময় নির্ধারণ হচ্ছে

এমন পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ ব্যবহারে সবাইকে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি লোডশেডিংয়ের ক্ষেত্রে এলাকাভিত্তিক সময় নির্ধারণ করে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বাসস জানিয়েছে, গতকাল সকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টের (পিজিআর) প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এখন আন্তর্জাতিক বাজারে বিদ্যুৎ উৎপাদনের উপকরণগুলোর দাম অত্যধিক বৃদ্ধি পেয়েছে । অনেক দেশে এখন বিদ্যুতের জন্য হাহাকার। সরকার আর ভর্তুকি দিয়ে কুলাতে পারছে না।

সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত জ্বালানির ব্যবহার কমাতে এলাকাভিত্তিক নির্দিষ্ট সময়ের লোডশেডিং করে বিদ্যুতের ব্যবহার কিছুটা কমানো যায় কি না, সে চিন্তাও করছেন তিনি । তবে সে ক্ষেত্রে আকস্মিক নয়, মানুষকে প্রস্তুত থাকার সময়টা দিয়েই তা করা যেতে পারে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘এখন আমরা একটা সুনির্দিষ্ট সময় যদি ধরে দিই যে একেক এলাকাভিত্তিক কিছুক্ষণের জন্য সেখানে বিদ্যুতের কিছুটা লোডশেডিং হবে, হঠাৎ যাবে হঠাৎ আসবে না, মানুষ প্রস্তুতি নিতে পারবে। সেভাবেই আমাদের কিছু কিছু পদক্ষেপ এখন থেকেই যদি আমরা নিই, তাহলে আগামী দিনে যে আরও সমস্যা দেখা দিতে পারে, সে পরিস্থিতি থেকে আমরা নিজেদের রক্ষা করতে পারব।’

বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দু–এক দিনের মধ্যে সরকারের উচ্চপর্যায়ে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।

চাহিদা কমার আশায় বিদ্যুৎ বিভাগ

এদিকে গত সোমবার সারা দেশে ১ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছে বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছে ঢাকায়। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পিডিবির চাহিদার হিসাবে গোঁজামিল থাকতে পারে। প্রকৃত চাহিদা আরও বেশি হওয়ার কথা। এ কারণেই দেশজুড়ে ব্যাপক লোডশেডিং দিতে হচ্ছে।

তবে পিডিবির হিসাবের সঙ্গে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) হিসাবের বড় তফাত রয়েছে। আরইবির কারিগরি প্রতিবেদন বলছে, গত সোমবার (৪ জুলাই) ২ হাজার ১৬৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতি হয়েছে তাদের। সর্বোচ্চ ৮ হাজার ৩৬৪ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে তারা সরবরাহ পেয়েছে ৬ হাজার ১৯৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। উল্লেখ্য, গত বছরের ৪ জুলাই আরইবির বিদ্যুৎ–ঘাটতি ছিল মাত্র ২৫ মেগাওয়াট।

দেশে বিদ্যুতের প্রায় ৫৫ শতাংশ সরবরাহ করে আরইবি।

রাজধানীর মিরপুর, গুলশান, বনানী, উত্তরাসহ একটি অংশের বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ডেসকো। গত সোমবারের মতো গতকালও তারা চাহিদার চেয়ে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম পেয়েছে। এতে প্রতিটি ফিডারের (একটি নির্দিষ্ট এলাকায়) আওতাধীন এলাকায় গড়ে আধা ঘণ্টা করে লোডশেডিং করতে হচ্ছে তাদের।

মোহাম্মদপুর থেকে শুরু করে পুরান ঢাকা ও আশপাশের বিস্তৃত এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে ডিপিডিসি। তাদের চাহিদাও বেশি। দিনে ঘাটতি হচ্ছে আগের মতোই ৩০০ মেগাওয়াট। প্রতিটি ফিডারের আওতায় এক ঘণ্টা করে লোডশেডিং হচ্ছে।

লোডশেডিংয়ের কারণে সংকটে পড়েছে হিমাগারগুলো। এ বিষয়ে রংপুর চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মোস্তফা সোহরাব চৌধুরী বলেন, লোডশেডিংয়ের কারণে জেনারেটর দিয়ে হিমাগার চালানো হচ্ছে। এতে হিমাগারের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। ফলে মজুতকৃত পণ্যের মান নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

পেট্রোবাংলা ও পিডিবির দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের কোনো আভাস মেলেনি। অন্য খাত থেকে কমিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের সরবরাহ কিছুটা বাড়ানোর চেষ্টা করছে পেট্রোবাংলা। দুই দিন পর ঈদের ছুটি শুরু হলে চাহিদা কমতে পারে, এমন আশায় আছে তারা। আর বর্ষাকালের বৃষ্টিও বিদ্যুতের চাহিদা কমাতে পারে।

বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় আপাতত গ্যাস আমদানি আর না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।

বিদ্যুৎ বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, বিভিন্ন দেশের পরিস্থিতির দিকে নজর রাখা হচ্ছে। বিশেষ করে, উন্নত দেশগুলোয়ও লোডশেডিং হচ্ছে এখন।

পিডিবি এখন পর্যন্ত দিনে সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছিল গত ১৬ এপ্রিল। এর পর থেকে উৎপাদন প্রায় টানা কমছে। গ্যাস–সংকট, কয়লার স্বল্পতার পাশাপাশি কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রায় ৬ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদনক্ষমতা কাজে লাগানো যাচ্ছে না।

কোরবানির ঈদের আগে বিদ্যুৎ–সংকট দূর হবে না বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ–সচিব মো. হাবিবুর রহমান। তবে তাঁর আশা, ঈদের পর থেকে লোডশেডিং কমে আসবে। তখন দোকানপাট, শপিং মল আবারও রাত আটটার মধ্যে বন্ধ করে দেওয়া হবে। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের জন্য এ রকম আরও কিছু চিন্তাভাবনা হচ্ছে।