আজ ১৪ অক্টোবর আন্তর্জাতিক মান দিবস। সারা পৃথিবীর মতো আমাদের দেশেও পালিত হচ্ছে দিবসটি। এমন দিনে কিছু প্রশ্ন এসেই যায়, তা হলো আমাদের দেশে পণ্য বা সেবার সুনির্দিষ্ট মান নিয়ন্ত্রণের পরিস্থিতি আদতে কেমন? প্রত্যাশিত মানের পণ্য বা সেবা না পেলে ভোক্তারা কী করতে পারেন?
ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন (আইএসও), ইন্টারন্যাশনাল ইলেকট্রোটেকনিক্যাল কমিশন (আইইসি) ও ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশনস ইউনিয়নের (আইটিইউ) আয়োজনে এ বছরের বিশ্ব মান দিবস পালিত হচ্ছে। চলতি বছরের এ দিবসের মূল প্রতিপাদ্য হলো ‘আন্তর্জাতিক মান ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লব’।
বাংলাদেশে কোনো পণ্য, সেবা বা প্রক্রিয়ার মান নির্ধারণ করে থাকে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। এই প্রতিষ্ঠানটির কাজ হলো, পণ্যসামগ্রীর মান প্রণয়ন, প্রণীত মানের ভিত্তিতে পণ্যের গুণাগুণ পরীক্ষা, বাধ্যতামূলক মান সনদের আওতাভুক্ত পণ্যগুলো পরীক্ষার পর সনদ দেওয়া ও ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম সার্টিফিকেট দেওয়া। এ ছাড়া ম্যাট্রিক পদ্ধতির প্রচলন, বাস্তবায়নসহ ওজন ও পরিমাপের সঠিকতা তদারক করে বিএসটিআই। অন্যদিকে মানসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার ফোকাল পয়েন্ট হিসেবে বাংলাদেশে প্রতিনিধিত্ব করে সংস্থাটি।
দেশের মান নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়া কী ও কেন
বিএসটিআই বলছে, বর্তমানে দেশে বাধ্যতামূলক মান সনদের আওতাভুক্ত পণ্য রয়েছে ১৯৪টি। গত এক বছরে বাধ্যতামূলক মান সনদের আওতাভুক্ত পণ্য বেড়েছে ৪১টি। এ ছাড়া বিএসটিআই প্রণীত মানের সংখ্যা প্রায় চার হাজার। বিএসটিআই যেমন আইএসও মান অনুসরণ করে, তেমনি কোডেক্স নীতিমালাও অনুসরণ করে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশনের (এফএও) দেওয়া নীতিমালা হলো কোডেক্স। এটি হলো মূলত খাদ্যপণ্য–সংশ্লিষ্ট। কোডেক্স হলো এমন একটি নীতিমালা, যা জানায় কোন পণ্যের মান কী ধরনের হওয়া উচিত। বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রে এই নীতিমালা মেনে চলা হয়। এর বাইরে বাংলাদেশ মানও (দেশি মান) নির্ধারণ করে থাকে বিএসটিআই।
বিএসটিআইয়ের পরিচালক (সিএম) এস এম ইসহাক আলী প্রথম আলোকে বলেন, আইএসও পুরো পৃথিবীর প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে একটি মান নির্ধারণ করে। অন্যদিকে বিএসটিআই আবহাওয়া, ক্রেতাসহ এ দেশের অনেক বিষয় বিচার–বিশ্লেষণ করতে হয়। তাই সব পণ্যের আইএসও মান মেনে চলা যায় না। আবার যেসব পণ্যের রপ্তানি বেশি হয়, সেগুলোর ক্ষেত্রে আইএসও মান মেনে চলতে হয়। তবে এটি ভাবার কারণ নেই যে দেশীয় পণ্যে আইএসও মান অনুসরণ করা হয় না। দেশীয় অনেক পণ্যেও আইএসও মান অনুসরণ করা হয়। বাধ্যতামূলক মান সনদের আওতাভুক্ত অনেক পণ্যের ক্ষেত্রেই আইএসও মান অনুসরণ করা হয়ে থাকে।
মান প্রণয়ন কমিটি নামে বিএসটিআইয়ের একটি পৃথক কমিটি আছে। এই প্রতিষ্ঠান প্রণীত চার হাজার মানের অনেকগুলোই আন্তর্জাতিক মানের আলোকে প্রণীত হয়েছে। মান প্রণয়ন কমিটি ঢের বিচার–বিশ্লেষণের পর এসব আন্তর্জাতিক মানকে বাংলাদেশি মান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। যদি পণ্যের গায়ে লেখা থাকে ‘বিডিএস আইএসও’, তবে বুঝতে হবে আইএসও প্রণীত মানকে সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশি মান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে যদি লেখা থাকে ‘বিডিএস সিএসি’, তবে বুঝতে হবে ডব্লিউএইচও ও এফএও প্রণীত আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুসরণ করা হয়েছে। আর দেশি মানের ক্ষেত্রে লেখা থাকবে শুধু ‘বিডিএস’।
দেশে মান নিয়ন্ত্রণের পরিস্থিতি কেমন
বর্তমানে বাংলাদেশে বাধ্যতামূলক মান সনদের আওতাভুক্ত আছে মাত্র ১৯৪টি পণ্য। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এর আওতা আরও বাড়ানো প্রয়োজন। শুধু মান সনদ দিলেই হবে না, সেই সঙ্গে ওই মান সনদ সঠিকভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে কি না, তার নজরদারিও বাড়াতে হবে। তা না হলে মান নিয়ন্ত্রণ পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।
বিএসটিআইয়ের কার্যপরিধি বিস্তৃত করার ওপর জোর দিয়েছেন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) প্রেসিডেন্ট গোলাম রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মান নিয়ন্ত্রণের মূল কাজটিই হলো, ভোক্তারা যেন প্রতারিত না হন, প্রবঞ্চিত না হন এবং সঠিক জিনিসটি ক্রয় করতে পারেন। প্রয়োজনীয় পণ্যের প্রকৃত সংখ্যা তো অনেক। বাধ্যতামূলক মান সনদের আওতায় থাকা পণ্যের ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে দেখা যায়, বিএসটিআই থেকে মান ঠিক করে নিলেও উৎপাদনের সময় তা ঠিকমতো অনুসরণ করা হয় না। তাই নজরদারি আরও কঠোর করতে হবে।
বিএসটিআইয়ের পরিচালক (সিএম) এস এম ইসহাক আলী বলছেন, বাধ্যতামূলক মান সনদের আওতাভুক্ত যেসব পণ্যের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে পরবর্তী নজরদারি ব্যবস্থা চালু আছে। বাজার ও কারখানাভিত্তিক নজরদারি ব্যবস্থাও চালু আছে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রমও চলে। সে ক্ষেত্রে কেউ ব্যর্থ হলে তার বিরুদ্ধে কারণ দর্শানো নোটিশ দেওয়া থেকে শুরু করে লাইসেন্স বাতিলসহ বিভিন্ন আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
ভোক্তারা কী করতে পারেন
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সঠিক মান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে পণ্য ক্রয়ের জন্য ভোক্তাদের সচেতন করে তুলতে হবে। প্রয়োজনে মান নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাছ থেকে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জেনে নিতে পারেন ভোক্তারা। আর প্রতারিত হলে ভোক্তা অধিকার আইনে করা যেতে পারে অভিযোগ।
বিএসটিআইয়ের পরিচালক (সিএম) এস এম ইসহাক আলী বলেন, ‘কোনো পণ্য বিএসটিআইয়ের সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত কি না, তা নিশ্চিত হয়েই ভোক্তাদের কেনা উচিত। শুধু বিএসটিআই লোগো দেখলেই হবে না, সে ব্যাপারে ভোক্তাদের নিশ্চিতও হতে হবে। বিএসটিআইয়ের ওয়েবসাইটে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য আছে, সেটি দেখে নেওয়া যেতে পারে। সন্দেহ হলে প্রয়োজনে আমাদের ফোন করেও জেনে নেওয়া যায়।’
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ও ভোক্তা অভিযোগ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাসুম আরেফিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কাছে অভিযোগ করা হলে, আমরা সঙ্গে সঙ্গেই উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করা ছাড়া মানের বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয় না। বাজার অভিযানে গিয়ে মান নিয়ন্ত্রণের সুযোগ কম। কিন্তু লিখিত অভিযোগ করা হলে সে ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’
ক্যাব প্রেসিডেন্ট গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, শুধু আইন করলেই হবে না, তার সঠিক বাস্তবায়নও নিশ্চিত করতে হবে। ভোক্তাদের সচেতন করে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষকেও শক্তিশালী করতে হবে। ভোক্তাদের সার্বিক উপকারের দিকে নজর দিতে হবে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সক্ষমতাও বাড়ানো প্রয়োজন।
আন্তর্জাতিক মান কী
কোনো পণ্য বা সেবার আন্তর্জাতিক মান কী হবে, তা নির্ধারণ করে ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন (আইএসও)। সংস্থাটি এখন পর্যন্ত মোট ২২ হাজার ৩৫৫টি আন্তর্জাতিক মান প্রকাশ করেছে। শুধু পণ্য বা সেবা নয়, কোনো একটি বস্তু ও প্রক্রিয়ার সঠিক পন্থা বা পদ্ধতির আন্তর্জাতিক মানও নির্ধারণ করে আইএসও।
আইএসও একটি বেসরকারি আন্তর্জাতিক সংস্থা। এর প্রধান কেন্দ্র সুইজারল্যান্ডের জেনেভায়। আইএসওর সদস্য হিসেবে রয়েছে মোট ১৬২টি জাতীয় মান সংস্থা। বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) এমনই একটি সদস্য।
কীভাবে মান নির্ধারণ করে আইএসও
একটি মানসম্মত সুর তৈরির জন্য যেমন অনেক শিল্পী একসঙ্গে কাজ করেন, ঠিক সেভাবেই আন্তর্জাতিক মান নির্ধারণের কাজটি করে আইএসও। সংস্থাটির ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, মান তৈরির জন্য ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করা হয়। সুনির্দিষ্ট বাজার চাহিদার ভিত্তিতে তৈরি একটি খসড়া মান নিয়ে তার উন্নয়নে কাজ করে টেকনিক্যাল কমিটি। প্রয়োজনীয় আলাপ–আলোচনার পর মানের একটি চূড়ান্ত সংস্করণ নির্ধারণ করা হয়। পরে তা প্রস্তাব আকারে উত্থাপিত হয়। এরপর আইএসও সদস্যদের ভোটের ভিত্তিতে তা অনুমোদিত হয়। এভাবেই নির্ধারিত হয় একটি আইএসও মান।
তবে যদি সদস্যদের ভোটাভুটিতে কোনো মান সম্পর্কে মতৈক্যে পৌঁছানো না যায়, তবে তা পর্যালোচনার জন্য পাঠানো হয়। পরে আবার তা ভোটে পাঠানো হয়। একটি নির্দিষ্ট মানের উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রায় তিন বছর সময় লাগে। প্রথম প্রস্তাব থেকে চূড়ান্ত প্রকাশনা পর্যন্ত যেতে এই সময় প্রয়োজন হয়।
একটি মান উন্নয়নের ক্ষেত্রে আইএসও বেশ কিছু বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করে থাকে। সাধারণত বাজার চাহিদার ওপর ভিত্তি করেই কোনো একটি বস্তু, পণ্য, সেবা বা প্রক্রিয়ার আন্তর্জাতিক মান নির্ধারণের কাজ হাতে নেয় আইএসও। সাধারণত শিল্পখাত সংশ্লিষ্ট একটি গোষ্ঠী তার দেশে থাকা আইএসওর জাতীয় সদস্যের সঙ্গে প্রথমে যোগাযোগ করে। পরে সেই সদস্য যোগাযোগ করে আইএসওর সঙ্গে।
আইএসও মান সব সময়ই বৈশ্বিক বিশেষজ্ঞ মতামতের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয়। তবে শুধু বিশেষজ্ঞই নয়, আইএসওর কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকে ভোক্তা অ্যাসোসিয়েশন, বেসরকারি সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট সরকারব্যবস্থা। এভাবে সব পক্ষের মতামতের ভিত্তিতেই আন্তর্জাতিক মান নির্ধারণের কাজটি করে আইএসও।
আইএসও মানের সুবিধা কী
আন্তর্জাতিক মান নির্ধারণের কারণ হলো, ভোক্তারা যেন একটি পণ্য বা সেবা ক্রয়ের ক্ষেত্রে সেটি যে নিরাপদ ও বিশ্বাসযোগ্য, তা বুঝতে পারেন। অর্থাৎ একটি পণ্য যে ভালো মানের এবং সেটির ওপর যেন আস্থা রাখা যায়, তা নিশ্চিত করতেই আন্তর্জাতিক মান নির্ধারণ করে আইএসও। আন্তর্জাতিক এই সংস্থা প্রথম পর্যায়ে শুধু পরিমাপ এবং ওজনের বিষয়গুলো নিয়েই কাজ শুরু করেছিল। এরপর ধীরে ধীরে বিভিন্ন পণ্য ও সেবার নানামুখী মান নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি আইএসওর আওতাধীন হয়। বর্তমানে পায়ের জুতা থেকে শুরু করে ওয়াই–ফাই নেটওয়ার্কের মান নিয়েও কাজ করছে আইএসও।
বিভিন্ন দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও সরকার আইএসও মানের ওপর ভিত্তি করে আরও উন্নত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করার সুযোগ পেয়ে থাকে। এভাবে বিভিন্ন দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো আইএসওর মাধ্যমে বৈশ্বিক বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে সমন্বয় করে থাকে এবং সংযুক্ত হয়। আইএসও বলছে, সব ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করার মাধ্যমে একদিকে যেমন অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া সম্ভব, অন্যদিকে পৃথিবী ও মানুষের স্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায়।