আমরা টের পাই না, কিন্তু পৃথিবী যে দিনরাত নিজ অক্ষরেখার চারপাশে ঘুরছে, সেই ঘূর্ণন গতির কিছু কম-বেশি হয়। অবশ্য এ পরিবর্তনের হার খুব সামান্য। মহাকাশবিজ্ঞানীরা বলেন, এই পরিবর্তন নিয়ে আমাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
আমরা জানি, পৃথিবী একবার নিজের চারদিকে ঘুরে আসতে ২৪ ঘণ্টা বা ৮৬ হাজার ৪০০ সেকেন্ড সময় লাগে। তবে এ সময় সব সময় একই থাকে না। এ বিষয়ে বিবিসি সায়েন্স ফোকাস ম্যাগাজিনে ড. অ্যালেস্টেয়ার গান একটি নিবন্ধ লিখেছেন। অ্যালেস্টেয়ার ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টারের জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান বিভাগের একজন রেডিও অ্যাস্ট্রোনমার বা বেতার জ্যোতির্বিদ।
অ্যালেস্টেয়ার বলেন, পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি খুব ধীরে ধীরে কমছে। ফলে বাড়ছে দিনের দৈর্ঘ্য। তবে এ পরিবর্তন এতই সামান্য যে সহজে বোঝা যায় না। এই ধরুন, ঘূর্ণন গতি ১০০ বছরে প্রায় ১ দশমিক ৮ মিলি সেকেন্ড হারে কমছে। লক্ষ করুন, সেকেন্ড নয় কিন্তু, মিলি সেকেন্ড। ১ মিলি সেকেন্ড হলো ১ সেকেন্ডের ১ হাজার ভাগের ১ ভাগ মাত্র। তার মানে, কমলেও খুব, খুব, খুবই সামান্য এটা।
সেই অনুপাতে ১০০ বছরে দিনের দৈর্ঘ্য খুব সামান্য হারে বাড়ছে। ৬০ কোটি বছর আগে পৃথিবীর দিনের দৈর্ঘ্য ছিল মাত্র ২১ ঘণ্টা। অর্থাৎ তখন ২৪ ঘণ্টায় নয়, ২১ ঘণ্টায় ১ দিন ছিল। এরপর ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে দিনের দৈর্ঘ্য ২৪ ঘণ্টা হয়েছে। এখন থেকে কোটিখানেক বছর পর আরও কয়েক ঘণ্টা হয়তো বাড়বে। এ পর্যন্ত সবাই এটাই জানতাম এবং এখনো সেটাই জানি। তবে ২০২০ সালে বিজ্ঞানীরা জানালেন, পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি সামান্য হারে বাড়ছে, কমছে না। কেন, সে বিষয়ে পরে আসছি।
ঘূর্ণন গতি কমার প্রধান কারণ হলো চাঁদের আকর্ষণে জোয়ার-ভাটা। সেই সঙ্গে সূর্যের আকর্ষণ। পৃথিবীর চারদিকে চাঁদ ঘুরছে। আবার সূর্যের চারদিকে পৃথিবী ঘুরছে। আর সূর্য, পৃথিবী, চাঁদ—প্রত্যেকেই নিজ অক্ষরেখার চারপাশে নির্দিষ্ট গতিতে ঘুরছে। এর সমন্বিত প্রতিক্রিয়ায় প্রভাব পড়ছে পৃথিবীর ঘূর্ণন গতির ওপর। তবে আরও কিছু উপাদান কাজ করছে এ ক্ষেত্রে। যেমন পৃথিবীর ভেতরের বিভিন্ন খনিজ পদার্থের অবস্থান। পৃথিবীর অভ্যন্তরে টেকটনিক প্লেটের নড়াচড়া। গ্লেসিয়ারের অবস্থান। জলবায়ু, মহাসাগর ও পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাব ইত্যাদি। এসব উপাদানের সামগ্রিক প্রভাবে পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি সামন্য হারে কমছে।
বিজ্ঞানীরা ২০২০ সালে হঠাৎ লক্ষ করলেন, ঘূর্ণন গতি সামান্য হারে বাড়ছে। গত ৫০ বছরের মধ্যে কখনো ঘূর্ণন গতির বৃদ্ধি তাঁরা লক্ষ করেননি। কেন বাড়ছে, সে বিষয়ে গবেষণা চলছে। বিজ্ঞানীরা এখনো এর কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারেননি। তবে কোনো কোনো বিজ্ঞানী বলছেন, এর একটি কারণ হতে পারে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বৃদ্ধি। বায়ুমণ্ডলের গড় তাপমাত্রা এখনো বাড়ছে। জলবায়ুবিজ্ঞানীরা বলছেন, ২০৫০ সালের মধ্যে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি যদি দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখা না যায়, তাহলে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিপর্যয় অপরিবর্তনীয় হয়ে উঠবে। অর্থাৎ বিপর্যয়ের ধারা রোধ করে অনুকূল পরিবেশ ফিরিয়ে আনা কঠিনতর হবে। ফলে পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা ক্রমাগত হুমকির মুখে পড়তে থাকবে। তাপমাত্রা দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধির এই হিসাব করা হয় শিল্পবিপ্লবের পূর্বের গড় তাপমাত্রার তুলনায়। কিন্তু এখনই গড় তাপমাত্রা এ সীমা ছাড়িয়ে গেছে। তাই এখন আমাদের উষ্ণায়ন প্রক্রিয়ায় নেতিবাচক বৃদ্ধির ব্যবস্থা করতে হবে। অর্থাৎ গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার কমিয়ে আনতে হবে।
গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে উত্তর ও দক্ষিণ মেরু অঞ্চলে বরফ গলে যাচ্ছে। ফলে বিশেষভাবে উত্তর মেরু অঞ্চলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বেড়ে গেছে। বিজ্ঞানীদের অনেকে মনে করেন, এসব কারণেই হয়তো সামান্য বেড়ে গেছে পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি। তবে তাঁদের ধারণা, এটা সাময়িক। ভারসাম্য ফিরে আসার পর হয়তো পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি আবার আগের ধারায় কমতে থাকবে।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, আমাদের দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। পৃথিবীর ঘূর্ণন গতি সামান্য কম বা বেশি হলে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে খুব বেশি প্রভাব পড়বে না। তবে জিপিএস, উপগ্রহের কার্যক্রমে সময় নির্ধারণ, স্মার্টফোন, ইন্টারনেট যোগাযোগ প্রভৃতি আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে যেহেতু নিখুঁত সময় নিশ্চিত করতে হয়, তাই ওসব ক্ষেত্রে কিছু অসুবিধা হতে পারে। কিন্তু সেটাও সমাধানযোগ্য। কারণ, আমরা হিসাব করে বের করতে পারি, কত সময় পরপর কত মিলি সেকেন্ড যোগ বা বিয়োগ করতে হবে। তাই আমাদের তেমন কোনো সমস্যা হবে না।
আব্দুল কাইয়ুম, প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও বিজ্ঞানচিন্তার সম্পাদক
quayum.abdul@prothomalo.com