সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার ভাদগাঁওয়ে চেলার খালের ওপর নতুন সেতু নির্মিত হয়েছে। কিন্তু সেতু থেকে নামলে চোখে পড়ে শুধু চাষিদের আবাদ করার মাঠ। সেতুর সঙ্গে নেই কোনো সড়ক ও অন্যান্য অবকাঠামোর চিহ্ন। সম্প্রতি ভাদগাঁওয়ের আনুজানি গ্রামে
সুনামগঞ্জের ছাতক উপজেলার ভাদগাঁওয়ে চেলার খালের ওপর নতুন সেতু নির্মিত হয়েছে। কিন্তু সেতু থেকে নামলে চোখে পড়ে শুধু চাষিদের আবাদ করার মাঠ। সেতুর সঙ্গে নেই কোনো সড়ক ও অন্যান্য অবকাঠামোর চিহ্ন। সম্প্রতি ভাদগাঁওয়ের আনুজানি গ্রামে

সেতু নির্মাণ প্রকল্প

আন্দাজের মাশুল ২,৫৩১ কোটি টাকা

জনপ্রতিনিধিদের চাপে সমীক্ষা ছাড়া সেতু অনুমোদন, এখন পরিবর্তন করতে হচ্ছে সেতুর দৈর্ঘ্য, বাড়াতে হচ্ছে উচ্চতা।

প্রায় চার বছর আগে সমীক্ষা ছাড়াই অনুমোদন দেওয়া ৯৪টি সেতুর কাজ করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। সে সময় একেকটি সেতুর দৈর্ঘ্য ঠিক করা হয়েছিল অনুমানের ওপর ভর করে। আর খরচ ধরা হয়েছিল ধারণার ওপর ভিত্তি করে। এখন আর কোনো কিছুই মিলছে না। নদীর অবস্থানগত কারণে কোনো কোনো সেতুর উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে, উচ্চতা বাড়াতে গেলে সেতুর দৈর্ঘ্য বাড়ছে এবং তাতে খরচও বাড়ছে।

আগামী বছরের জুনের মধ্যে এসব সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার কথা ছিল। অনুমান ও ধারণা না মেলায় এখন সেতুগুলোর কাঠামো পরিবর্তন করতে হচ্ছে। ফলে ৩ হাজার ৯২৬ কোটি টাকার প্রকল্পটির বর্তমান ব্যয় বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৬ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ বাড়তি খরচ হবে ২ হাজার ৫৩১ কোটি টাকা। এতে আগামী ২০২৪ সালের মধ্যেও কাজ শেষ করা যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।

এলজিইডি সূত্র জানায়, জনপ্রতিনিধিদের দেওয়া তালিকার ওপর ভিত্তি করে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে দেশের ৪০ জেলার ৯৪টি উপজেলায় মোট ১৩০টি সেতু নির্মাণের একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। ৩ হাজার ৯২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘পল্লি সড়কে গুরুত্বপূর্ণ সেতু নির্মাণ’ নামের প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন সময় সমীক্ষা করা ছিল মাত্র ৩৬টি সেতুর। বাকি ৯৪টি সেতুর কোনো ধরনের সমীক্ষা ছাড়াই প্রকল্পটির অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল।

১০০ মিটারের বেশি দৈর্ঘ্যের সেতু নির্মাণ করার আগে কী কী করা বাধ্যতামূলক, তার সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া আছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে। নির্দেশনা অনুযায়ী, সেতু নির্মাণের আগে অবশ্যই জলবিদ্যুৎ পরিস্থিতি, পানির সংস্থান, পরিবেশগত অবস্থা, নৌ চলাচল ও আর্থসামাজিক অবস্থা জানার জন্য একটি বিস্তারিত সমীক্ষা করতে হবে। সেই সমীক্ষায় নদীর বৈশিষ্ট্য, নদীর তলদেশ ও পানির প্রবাহ বিবেচনায় রাখতে হবে। সমীক্ষা প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে তবেই সেতুর নকশা ঠিক করে তারপর খরচ নির্ধারণ করতে হবে।

জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক মনজুরুল আলম সিদ্দিকী তাঁর দপ্তরে প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রায় সব সেতুর বিস্তারিত সমীক্ষা শেষ করে আমরা যখন মাঠে গেলাম, তখন দেখছি কোনো কোনো সেতুর দৈর্ঘ্য বাড়াতে হবে। কোথাও উচ্চতা বাড়াতে হবে। সংযোগ সড়কও বাড়াতে হবে। জমি অধিগ্রহণ বাড়াতে হবে। এরই মধ্যে পণ্য বা উপকরণের দরের (রেট শিডিউল) পরিবর্তন হয়েছে। জমি অধিগ্রহণের ব্যয়ও তিন গুণ হয়েছে। এসব কারণে প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে, সঙ্গে মেয়াদও বাড়ছে।’

এই প্রকল্পে মনজুরুল আলম দেড় বছর ধরে দায়িত্বে আছেন। তাই আগে কী হয়েছে, সেসব বিষয় তাঁর অজানা বলেও তিনি জানান। মনজুরুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পটি অনুমোদনের সময় ১৩০টি সেতুর মধ্যে সমীক্ষা করা ছিল ৩৬টির। ১০০ মিটারের বেশি দৈর্ঘ্যের সেতু আছে ৫৮টি। যেগুলোর সমীক্ষা প্রায় শেষ পর্যায়ে। বাকি ৩৬টি সেতুর দৈর্ঘ্য ১০০ মিটারের নিচে হওয়ায় সেসব সেতুর সমীক্ষা বাধ্যতামূলক নয়।

তবে ১০০ মিটারের নিচে সেতু হলেই সমীক্ষা করা দরকার নেই বলে প্রকল্প পরিচালক যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার সঙ্গে একমত নন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানি এবং বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এ কে এম সাইফুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ১০০ মিটারের নিচে সেতুগুলোর সমীক্ষা করার বাধ্যবাধকতা না থাকলেও যাঁরা এই সেতুগুলো নির্মাণ করবেন, তাঁদের নিজ দায়িত্বে সমীক্ষা করা জরুরি। কারণ, অনেক জায়গায় আগাম বন্যা হয়। ওই এলাকার পানির প্রবাহ জানা না থাকলে নানা ধরনের সমস্যা তৈরি হয়। সমীক্ষা না করলে অনেক সময় দেখা যায়, পানির তোড়ে সেতু ভেঙে যায়। নানা কারণে নদীর পাড় স্থানান্তর হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণেও অনেক কিছু পরিবর্তন হচ্ছে। তাই ৫০ মিটারের ঊর্ধ্বে সেতু নির্মাণের আগে অবশ্যই সমীক্ষা করা উচিত।

সেতুগুলোর কী অবস্থা

তালিকায় থাকা ১৩০টি সেতুর মধ্যে পরিকল্পনা কমিশন নয়টি সেতু পর্যালোচনা করে দেখেছে যে খরচ ও দৈর্ঘ্যের জটিলতার কারণে সেতু নির্মাণে দরপত্রই আহ্বান করা যায়নি। সেতুগুলো হলো: ১. ফরিদপুর জেলা সদরে পদ্মার শাখা নদীর ওপর ১ হাজার ২০ মিটার দীর্ঘ সেতু, ২. কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম উপজেলায় মেঘনা নদীর ওপর ১ হাজার ২০ মিটার সেতু, ৩. কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলায় ঘোড়া উতরা নদীর ওপর ১ হাজার ২০ মিটার সেতু, ৪. ঢাকার সাভারে তুরাগ নদের ওপর ৬৫০ মিটার সেতু, ৫. জামালপুর সদরে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর ৬০০ মিটার সেতু, ৬. সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জে কুশিয়ারা নদীর ওপর ৯৬০ মিটার সেতু, ৭. বরিশালের গৌরনদীতে আড়িয়াল খাঁ নদে ৬০০ মিটারের সেতু, ৮. বরিশালের বাকেরগঞ্জে খায়েরবাদ নদের ওপর ৭৫০ মিটার সেতু এবং ৯. ঝালকাঠির নলছিটিতে খায়রাবাদ নদের ওপর ৭৩০ মিটার সেতু। মূল প্রকল্পে এই নয়টি সেতু নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪৮০ কোটি টাকা। আর এখন নির্মাণ খরচ বাড়িয়ে ১ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা করা হচ্ছে।

বাস্তব অগ্রগতি সামান্য

প্রায় চার বছরে প্রকল্পটির বাস্তব অগ্রগতি মাত্র ১৭ শতাংশ, আর আর্থিক অগ্রগতি ১৩ শতাংশ। ১৩০টির মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র ৯টি সেতুর কাজ শেষ হয়েছে। এই ৯ সেতু হচ্ছে: ১. লক্ষ্মীপুর জেলা সদরে রহমত আলী খালের ওপর ৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের সেতু, ২. সুনামগঞ্জের ছাতকে চেলা নদীর ওপর সেতু, ৩. নওগাঁ জেলার শ্রী নদীর ওপর ৪০ মিটার সেতু, ৪. রাজবাড়ীর কুমার নদের ওপর ৬০ মিটার সেতু, ৫. টাঙ্গাইল জেলা সদরের ধলেশ্বরী শাখা নদীর ওপর ৮১ মিটার সেতু, ৬. দিনাজপুরের ছোট যমুনা নদীর ওপরে ৯৬ মিটার সেতু, ৭. জামালপুর জেলায় যমুনা শাখা নদীর ওপর ৯৬ মিটার সেতু, ৮. গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার কুশলা খালের ওপর ২৪ মিটার সেতু এবং ৯. পটুয়াখালী জেলার তেগাছিয়া খালের ওপর ৪১ মিটার দীর্ঘ সেতু।

এ ছাড়া ৭৪টি সেতুর নির্মাণকাজ চলছে ঢিমেতালে। ১৫টি সেতুর দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। ৬টি সেতুর নকশা চূড়ান্ত হয়েছে মাত্র। ২৪টি সেতুর সমীক্ষার কাজ মাত্র শেষ হয়েছে। আর বাকি ২টি সেতুর সমীক্ষা এখনো শেষই হয়নি।

পল্লি সড়কে গুরুত্বপূর্ণ ১৩০টি সেতু নির্মাণসংক্রান্ত প্রকল্পটি নিয়ে গত ২৯ জুলাই অনলাইনে এক আন্তমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী আবদুর রশীদ খান নিজেই স্বীকার করে বলেন, ২০১৭ সালে একেকটি সেতু নির্মাণে যে খরচ ধরা হয়েছিল, নকশা শেষ হওয়ার পর অধিকাংশ সেতুর ব্যয় বেড়ে গেছে। ভূমি অধিগ্রহণ খাতেও খরচ বেড়ে গেছে।

একই সভায় প্রকল্প পরিচালক মনজুরুল আলম সিদ্দিকী জানান, মূল প্রকল্পে অনেকগুলো সেতুর সমীক্ষা করা ছিল না। পরবর্তী সময়ে এসব সমীক্ষা করে দেখা গেছে, অনেক সেতুর উচ্চতা বাড়াতে হবে। উচ্চতা বাড়াতে গেলে সেতুর দৈর্ঘ্য বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে ভূমি অধিগ্রহণের পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, এলজিইডিতে দক্ষ জনবল না থাকায় পরামর্শকের খরচ বেড়ে গেছে। এ ধরনের জাতীয় সেতু নির্মাণে যে ধরনের অভিজ্ঞ জনবলের দরকার, তা এলজিইডিতে নেই।

এদিকে পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, এর মধ্যেই আবার এলজিইডি শতাধিক সেতু নির্মাণের আরেকটি প্রকল্প অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছিল। কিন্তু কমিশন থেকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, সব সেতুর বিস্তারিত সমীক্ষা না করে প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া যাবে না।

জানতে চাইলে প্রকল্প বিশেষজ্ঞ, সাবেক সচিব ফওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দেশে সেতুকে শুধু সেতু হিসেবেই দেখা হয়। কিন্তু একটি সেতুর সঙ্গে নদীর পানির প্রবাহ, বন্যা ও পানি ব্যবস্থাপনা, পরিবেশগত বিষয়ও জড়িত। এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়, যেকোনো ধরনের সমীক্ষা ছাড়াই সেতুগুলো অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। তিনি আরও বলেন, একটি সেতুর ওপরে শুধু গাড়িই চলাচল করবে না, সেতুর নিচ দিয়ে নৌকা চলবে, জাহাজ চলবে, নদীর পানি সেচ হিসেবে ব্যবহৃত হবে। তাই সেতুকে সেতু হিসেবে না দেখে সেতুর কাজ শুরুর আগে অবশ্যই বিস্তারিত সমীক্ষাসহ পরিবেশগত বিষয়ও দেখা উচিত। তারপরই সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে আমাদের দেশে রাজনৈতিক বিবেচনায় জনপ্রতিনিধিদের বাড়ির সামনে চলাচলের জন্যও সেতু নির্মাণ করা হয়।’