আনানকে ঘটনা জানাতে পারলেন না রোহিঙ্গারা

জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানকে কাছে পেয়েও সেনাদের নিষেধাজ্ঞা থাকায় ‘গণহত্যা’সহ বর্বরতার কথা জানাতে পারেননি মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিমরা। গত শনিবার দুপুরে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের খেয়ারিপাড়ায় তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা চারজন রোহিঙ্গাকেই ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ।

গতকাল রোববার ভোরে খেয়ারিপাড়া থেকে কক্সবাজারের টেকনাফে পালিয়ে আসা কয়েকজন রোহিঙ্গা প্রথম আলোকে এসব কথা জানান। খেয়ারিপাড়ার ৩০ জন রোহিঙ্গা এখন টেকনাফের লেদা অনিবন্ধিত শিবিরের ই ব্লকে আছে। এর মধ্যে ২৩ জন নারী ও শিশু।

গতকাল ভোরে আসা রোহিঙ্গা মো. মুছা (৫১) বলেন, শনিবার বেলা ১১টার দিকে কফি আনান হেলিকপ্টারে মংডু শহরে নামেন। নেমেই তিনি মগ সম্প্রদায়ের বিক্ষোভের মুখে পড়েন। দুপুর ১২টার দিকে ১৭টি গাড়িযোগে কফি আনানকে আনা হয় খেয়ারিপাড়ায়। খেয়ারিপাড়ার ধ্বংসস্তূপ দেখার পর তিনি স্থানীয় রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলতে চান। দোভাষীর মাধ্যমে তিনি চারজন রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলেন। আধা ঘণ্টা পর তিনি গাড়িতে মংডুতে ফিরে যান।

মুছা বলেন, ওই সময় তিনি এলাকায় ছিলেন। কফি আনান চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই চারজন রোহিঙ্গাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। বিকেলে খেয়ারিপাড়ায় এসে পুলিশ আবার দমন-পীড়ন শুরু করে। এতে কয়েক শ রোহিঙ্গা গ্রাম ছেড়ে টেকনাফ পালিয়ে আসে। তিনি সঙ্গে স্ত্রী জরিনা খাতুন (৩৮) ও এক ছেলে মো. উল্লাহকেও (১১) নিয়ে এসেছেন।

লেদা রোহিঙ্গা শিবির পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আমির হোসেন বলেন, শনিবার রাত ১০টা থেকে গতকাল ভোররাত তিনটা পর্যন্ত এই শিবিরে ঢুকেছে ৩৫২ জন রোহিঙ্গা। গত তিন সপ্তাহে এখানে আশ্রয় নিয়েছে আরও সাত হাজারের মতো রোহিঙ্গা।

এলাকাবাসী সূত্র বলেছে, গতকাল ভোররাতে সীমান্তের হোয়াইক্যং, উলুবনিয়া, উনচিপ্রাং, লেদা, মুছনিসহ বিভিন্ন স্থান দিয়ে অন্তত ৭০০ রোহিঙ্গা ঢুকেছে। অবশ্য টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়ক মেজর আবু রাসেল সিদ্দিকী বলেন, বিজিবি ও কোস্টগার্ডের কড়াকড়ির কারণে গতকাল রোহিঙ্গারা টেকনাফে ঢুকতে পারেনি।

গত ৯ অক্টোবর রাখাইনে তিনটি পুলিশ ফাঁড়িতে হামলার ঘটনায় ৯ পুলিশসহ ১৪ জন নিহত হওয়ার পর সেনা ও পুলিশ সেখানে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান শুরু করে। রোহিঙ্গাদের দাবি, গত দুই মাসের অভিযানে দুই শতাধিক রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। নিখোঁজ প্রায় ৩০০। মংডুর আশপাশের প্রায় ২০টি গ্রামের ৯০ শতাংশ ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে অনেক রোহিঙ্গা পালিয়ে এসেছে কক্সবাজারে।

বিদেশি সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, সহিংসতায় ৮৬ জন নিহত হওয়ার খবর স্বীকার করেছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ। তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, নিহতের সংখ্যা অনেক বেশি।

সব হারানো লায়লার আর্তনাদ: লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শিবিরে একটি ঝুপড়ি ঘরে কান্নাকাটি আর আহাজারি করছেন বৃদ্ধা লায়লা খাতুন (৬১)। তাঁর বাড়ি মংডু জেলার পেরাংপ্রু গ্রামে। দুপুরে ১৩ ফুট লম্বা ওই ঘরে বৃদ্ধার সঙ্গে আছে আরও ৪৩ জন রোহিঙ্গা নারী-শিশু। শনিবার ভোররাতে তিনি অন্য রোহিঙ্গাদের সঙ্গে পালিয়ে টেকনাফ আসেন। তিনি বললেন, ‘সব শেষ, কী নিয়ে বাঁচব।’

লায়লা খাতুন বলেন, শুক্রবার বিকেলে হঠাৎ কয়েক শ সেনা ও পুলিশ তাঁদের গ্রাম ঘিরে ফেলে রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়িতে গুলিবর্ষণ করে। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় ৪০টির বেশি ঘরবাড়িতে। রাতে প্রাণ বাঁচাতে কয়েক শ রোহিঙ্গা নাফ নদীর প্যারাবনে আশ্রয় নেয়। সেখানেও গুলি চালায় পুলিশ। এতে তাঁর স্বামী খায়রুল বশর (৭০) এবং তিন ছেলে কামাল হোসেন (২২), আবদুস শুক্কুর (১৮) ও লাল মিয়া (১৩) নিহত হয়। বাধ্য হয়ে ৫৪ জন রোহিঙ্গার সঙ্গে পালিয়ে আসেন।

ওই ঝুপড়ি ঘরে থাকা বলিবাজারের রোহিঙ্গা কুলসুমা বেগম বলেন, সেনা ও পুলিশের গুলিতে তাঁর বড় ভাই রফিকের মৃত্যু হয়েছে। হাতিপাড়ার হাসিনা আক্তার (২২) বলেন, শুক্রবার সন্ধ্যায় সেনা ও পুলিশ তাঁর স্বামী মো. ইসলামসহ ২২ জন রোহিঙ্গা পুরুষকে ধরে নিয়ে গেছে। এ সময় বাবাকে ধরে কান্নাকাটি করা দুই ছেলে হামিদ (৮) ও করিমকে (৬) পুলিশ ধরে আগুনে নিক্ষেপ করে। ঘটনাস্থলেই তাদের মৃত্যু হয়। আরেক ছেলে রশিদকে (৩) নিয়ে তিনি পালিয়ে এসেছেন।