জরাজীর্ণ পুরোনো ভবনগুলোর সংস্কার ও সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়ে পানাম নগরের আদিরূপ ফিরিয়ে দিতে কাজ শুরু করেছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। সম্প্রতি প্রাচীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁয়ে
জরাজীর্ণ পুরোনো ভবনগুলোর সংস্কার ও সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়ে পানাম নগরের আদিরূপ ফিরিয়ে দিতে কাজ শুরু করেছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। সম্প্রতি প্রাচীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁয়ে

ঐতিহ্য

আদিরূপে ফিরছে পানাম নগর

পানাম নগরের ১৩ নম্বর ভবনটিতে ভাঙচুর চলছে। দ্বিতীয় তলার প্লাস্টার ছেনি–হাতুড়ি দিয়ে তুলে ফেলা হচ্ছে। সোনালি অতীতের এমন নিদর্শনের বুকে হাতুড়ি–ছেনি চালানোর শব্দ যে কারোরই বুকে আঘাত দিতে পারে। সে জন্য আগেই জানিয়ে রাখা দরকার, প্রাচীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁয়ের পানাম নগরকে আদিরূপে ফেরাতে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সে কাজই এখন চলছে জোরেশোরে।

১৭ শতকের প্রথম দশকে সুবা বাংলার রাজধানী ঢাকায় স্থাপিত হওয়ার পর সোনারগাঁয়ের প্রশাসনিক গুরুত্ব কমতে থাকে। কিন্তু সোনারগাঁয়ে ঐতিহাসিক গুরুত্ব যে হারিয়ে যায়নি, তা স্পষ্ট হয় ১৯ শতকের শুরু থেকে। ওই সময় হিন্দু বণিকদের একটি অংশ পানাম অঞ্চলে তাঁদের আবাসিক ভবন নির্মাণ করেন। প্রায় ৫ মিটার প্রশস্ত ও ৬০০ মিটার দীর্ঘ একটি সড়কের দুই পাশে সুরম্য স্থাপনা নিয়ে পানাম নগর গড়ে উঠেছিল। সড়কের দুই পাশে মুখোমুখি দ্বিতল ও তৃতীয় তলাবিশিষ্ট ৫২টি ভবন রয়েছে।

সরকার ২০০৩ সালে পানাম নগরকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে গেজেটভুক্ত করে। ২০১৫ সালে ৬ অক্টোবর থেকে পানাম নগর পরিদর্শন করতে হলে পর্যটকদের টিকিট কেটে প্রবেশ করতে হচ্ছে। প্রায় দেড় হাজার বছরের প্রাচীন শহর সোনারগাঁ ছিল বাংলার অন্যতম রাজধানী।

এসব বাড়ির স্থাপত্যে ইউরোপীয় শিল্পরীতির সঙ্গে মুঘল আমলের শিল্পরীতির মিশ্রণ রয়েছে। বাড়িগুলোর ইটের সঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে ঢালাই লোহার তৈরি ব্র্যাকেট ভেন্টিলেটর ও জানালার গ্রিল। মেঝেতে রয়েছে লাল, সাদা, কালো মোজাইকের কারুকাজ। অধিকাংশ  বাড়িতে খিলান, ছাদে ও মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে নীল ও সাদা মোজাইকের কাজ। প্রতিটি বাড়িতেই আছে কূপ।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, পানাম নগরের ভবনগুলো জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। তাই সংস্কার করে আদিরূপ ফিরিয়ে আনার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গত বছরের ১৩ আগস্ট ওই সংস্কার নিয়ে গবেষণা ও বিশেষজ্ঞ মতামত দিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক ও স্থপতিদের নিয়ে ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। গত ২১ ডিসেম্বর পানাম নগরের ১৩ নম্বর ভবনটি গবেষণামূলক পাইলটিং কাজের উদ্বোধন করেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। এখন পুরোদমে চলছে সংস্কারকাজ।

১৩ নম্বর ভবনের স্থাপত্যিক আদিরূপ ফিরিয়ে আনার বিষয়ে ছয়টি সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। সুপারিশের মধ্যে রয়েছে মূল ভবনের পশ্চিম দিকে পরবর্তী সময়ে নির্মিত ভবনের মেঝে এবং ভিত্তির ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে ফেলা, প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় পরবর্তীকালে সংযোজিত দরজা ও জানালার চৌকাঠগুলো অপসারণ করাসহ আরও কিছু বিষয়।
সুফি মোস্তাফিজুর রহমান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ঢাকা আঞ্চলিক কার্যালয়ের পরিচালক রাখী রায় বলেন, পাইলটিং কাজের অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে ডিজিটাল ড্রইং ডকুমেন্টেশন, লোড বেয়ারিং ক্যাপাসিটি টেস্ট, এরিয়াল সার্ভে ও লেভেল খননের কাজ করা হয়েছে। দক্ষ কারিগরেরা গবেষকদের পরামর্শ নিয়ে কাজটি চালিয়ে যাচ্ছেন।

গত সোমবার দুপুরে পানাম নগরের ১৩ নম্বর ভবনে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের দ্বিতীয় তলায় কারিগরেরা জরাজীর্ণ প্লাস্টার হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে ফেলে দিচ্ছেন। ভবনের আদি নকশা ও কারুকাজ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখা হচ্ছে। সংস্কারকাজ দেখতেও ভিড় জমিয়েছেন দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে আগত দর্শনার্থীরা।

এ কাজের গবেষণা সহায়তা কমিটির অন্যতম সদস্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ১৩ নম্বর ভবনের স্থাপত্যিক আদিরূপ ফিরিয়ে আনার বিষয়ে তাঁরা ছয়টি সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন দিয়েছেন। সুপারিশের মধ্যে রয়েছে মূল ভবনের পশ্চিম দিকে পরবর্তী সময়ে নির্মিত ভবনের মেঝে এবং ভিত্তির ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে ফেলা, প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় পরবর্তীকালে সংযোজিত দরজা ও জানালার চৌকাঠগুলো অপসারণ করাসহ আরও কিছু বিষয়।

এসব বাড়ির স্থাপত্যে ইউরোপীয় শিল্পরীতির সঙ্গে মুঘল আমলের শিল্পরীতির মিশ্রণ রয়েছে। বাড়িগুলোর ইটের সঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে ঢালাই লোহার তৈরি ব্র্যাকেট ভেন্টিলেটর ও জানালার গ্রিল। মেঝেতে রয়েছে লাল, সাদা, কালো মোজাইকের কারুকাজ। অধিকাংশ বাড়িতে খিলান, ছাদে ও মধ্যবর্তী স্থানে রয়েছে নীল ও সাদা মোজাইকের কাজ। প্রতিটি বাড়িতেই আছে কূপ।

সরকার ২০০৩ সালে পানাম নগরকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে গেজেটভুক্ত করে। ২০১৫ সালে ৬ অক্টোবর থেকে পানাম নগর পরিদর্শন করতে হলে পর্যটকদের টিকিট কেটে প্রবেশ করতে হচ্ছে। প্রায় দেড় হাজার বছরের প্রাচীন শহর সোনারগাঁ ছিল বাংলার অন্যতম রাজধানী। মুসলিম শাসকদের অধীনে পূর্ববঙ্গের একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল সোনারগাঁ। প্রাচীন সুবর্ণ গ্রাম থেকে সোনারগাঁ নামের উদ্ভব। ১৩ শতকের স্থানীয় হিন্দু রাজা দনুজ মাধব দশরথদেব সুবর্ণ গ্রামকে তাঁর শাসনকেন্দ্রে পরিণত করেন। বঙ্গ অঞ্চল মুসলিম শাসনে আসার পর থেকে ১৬১০ সালে ঢাকা সুবা বাংলার রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত সোনারগাঁ ছিল স্বাধীন সুলতানি বাংলার অন্যতম রাজধানী ও প্রশাসনকেন্দ্র।