৭০ শিশুর ‘সাজা’

আদালতে হাজিরা দিতে হবে না, করতে হবে ভালো কাজ

আদালত
প্রতীকী ছবি

বিভিন্ন অপরাধে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মামলায় জড়ানো হয়েছিল ৭০ শিশুকে। তাদের বেশির ভাগই শিক্ষার্থী। এ জন্য আদালতে নিয়মিত হাজিরা দিতে হতো তাদের। এতে শিক্ষাসহ স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হচ্ছিল শিশুদের। এই অনিশ্চয়তা থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে আদালত দ্রুত মামলাগুলো নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেন।

৫০টি মামলায় এক বছর করে ‘সাজা’ হয় ৭০ শিশুর। তবে তাদের কারাগারে যেতে হয়নি। সংশোধনের ছয়টি শর্তে বাড়িতে মা-বাবার জিম্মায় থেকে এই ‘সাজা ভোগ’ করবে তারা। এই শিশুদের বয়স ১২ থেকে ১৮ বছর। ‘দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স ১৯৬০’ অনুযায়ী সুনামগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনাল এবং শিশু আদালতের বিচারক মো. জাকির হোসেন আজ বুধবার এক দিনে ৫০টি মামলার রায় দেন।

রায়ের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সুনামগঞ্জে শিশু আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) হাসান মাহবুব। তিনি জানান, ওই সময়কালের মধ্যে শিশুদের ছয়টি শর্ত পালন করতে হবে। শর্ত পালনের বিষয়টি তত্ত্বাবধান করবেন জেলা প্রবেশন কর্মকর্তা। রায় ঘোষণার পর আদালতের কর্মীরা প্রতিটি শিশুর হাতে ফুল এবং একটি ডায়েরি তুলে দেন।

আদালতের বিচারক মো. জাকির হোসেন রায়ে প্রবেশনকালীন যেসব শর্ত পালনের কথা উল্লেখ করছেন সেগুলো হলো—এক, প্রতিদিন দুটি ভালো কাজ করা এবং আদালত থেকে দেওয়া ডায়েরিতে তা লিখে রাখা এবং বছর শেষে সেই ডায়েরি আদালতে জমা দেওয়া। দুই, মা–বাবাসহ গুরুজনদের আদেশ-নির্দেশ মেনে চলা এবং মা–বাবার সেবা–যত্ন করা ও কাজকর্মে তাঁদের সাহায্য করা। তিন, নিয়মিত ধর্মগ্রন্থ পাঠ করা এবং ধর্মকর্ম পালন করা। চার, অসৎ সঙ্গ ত্যাগ করা। পাঁচ, মাদক থেকে দূরে থাকা। ছয়, ভবিষ্যতে কোনো অপরাধের সঙ্গে নিজেকে না জড়ানো।

আদালত

এই শিশুদের প্রবেশনে দেওয়ার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আদালত রায়ে উল্লেখ করেছেন, পারিবারিক বন্ধনে থেকে কোমলমতি এই শিশুদের সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রবেশন কর্মকর্তা ও শিশুদের অভিভাবকদের নিবিড় তত্ত্বাবধানে রেখে ভবিষ্যতে যাতে তারা অপরাধে না জড়ায়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। জীবনের শুরুতেই যাতে শাস্তির কালিমা তাদের স্পর্শ না করে, সে জন্য শাস্তি না দেওয়া। সংশোধনাগারে অন্যান্য যারা বিভিন্ন অপরাধে আটক আছে, তাদের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখা। পরিবারের সংস্পর্শে রেখে শিশুদের স্বাভাবিক মানসিক বিকাশের ব্যবস্থা করা। সংশোধানগারের ওপর চাপ কমানো। সর্বোপরি শিশুর সার্বিক কল্যাণ সাধন করা। সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতেই তাদের প্রতি আদালতের এসব নির্দেশনা।
জেলার দিরাই উপজেলার রাজনাও গ্রামের ইউসুফ আলী (৪০) তাঁর চার ভাতিজাকে নিয়ে এসেছিলেন আদালতে। চারজনই শিক্ষার্থী। এক বছর আগে গ্রামের দুই পক্ষের মারামারি হয়। ওই মামলায় তাদের আসামি করা হয়েছিল। মামলার রায় ঘোষণার পর ইউসুফ আলী বলেন, ‘এক বছরের সাজা শুনে তো মনে হয়েছিল ছেলেগুলো জেলে যাবে। কিন্তু পরে শুনি তারা বাড়িতেই আমাদের সঙ্গে থাকবে। বাড়িতে থেকেই কিছু নিয়ম-কানুন মেনে সাজা ভোগ করবে। এভাবে রায় হতে পারে, এটা ভাবতেই পারিনি। এতে আমরা খুশি। তারা যাতে আর কোনো অপরাধে না জড়ায়, সেটা সব সময় খেয়াল রাখব।’

এই রায়ে সমাজে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে জানান আইনজীবী ও সুনামগঞ্জ সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সভাপতি আইনুল ইসলাম। তিনি বলেন, শিশুরা পরিবার থেকেই নিজেকে গড়ার শিক্ষা পায়। আদালত তাদের সংশোধনের সুযোগ দিয়েছেন। সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে ফেরার পথ দেখিয়েছেন। এই রায় একটা দৃষ্টান্ত।
জেলা প্রবেশন কর্মকর্তা শাহ মো. শফিউর রহমান জানান, প্রবেশনকালীন এই শিশুরা শর্তগুলো যথাযথভাবে পালন করছে কি না, সেটির তত্ত্বাবধান করা তাঁর দায়িত্ব। পাশাপাশি অভিভাকদেরও দায়িত্ব রয়েছে এসব শর্ত পালনে তাদের সহযোগিতা করা, পাশে থাকা। তিন মাস পরপর আদালতে এ বিষয়ে তাঁকে প্রতিবেদন দিতে হয়। প্রবেশনের মেয়াদ শেষ হলে আদালত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন।

‘দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স ১৯৬০’ আইনের ৪ ধারায় বিধান অনুযায়ী, পূর্বে দণ্ডিত হয়নি—এমন কোনো অপরাধী অনধিক দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় অপরাধের জন্য দণ্ডিত হলে আদালত অপরাধীর বয়স, স্বভাব-চরিত্র, প্রাক্‌-পরিচয় অথবা শারীরিক বা মানসিক অবস্থা এবং অপরাধের ধরন অথবা অপরাধ সংঘটনে শাস্তি লাঘবকারী পরিস্থিতি বিবেচনাপূর্বক যদি মনে করেন যে দণ্ড প্রদান অসমীচীন এবং প্রবেশনের আদেশ প্রদান করা যথাযথ নয়, তাহলে আদালত কারণ লিপিবদ্ধ করে সতর্ক করত অপরাধীকে অব্যাহতি দিতে পারেন অথবা উপযুক্ত মনে করলে আদেশে বিবৃত সময় হতে অনধিক এক বছর সময়ের জন্য কোনো অপরাধ না করার এবং সদাচারণে থাকার শর্তে জামিনদারসহ বা জামিনদার ছাড়া মুচলেকা প্রদানে বিমুক্ত হওয়ার আদেশ দিতে পারেন।