রাজধানীর গুলশানের ৭৯ নম্বর সড়কের হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার তিন বছর আজ। ২০১৬ সালের ১ জুলাই ইসলামিক স্টেট বা আইএস-সমর্থিত জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা কুপিয়ে ও গুলি করে নৃশংসভাবে হত্যা করেন ২২ জনকে। আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল সারা দেশের মানুষ। এখন পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। হামলার আড়াই বছরের মাথায় অভিযোগপত্র জমা হয়েছে। শুরু হয়েছে বিচার।
সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালে এখন পর্যন্ত ২৭ কার্যদিবসে ৬০ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। হত্যা ও জিম্মি দশার শুরুতে জঙ্গিদের মোকাবিলা করেছিলেন যে পুলিশ সদস্যরা কিংবা গোটা রাত হোলি আর্টিজান বেকারির যে কর্মীরা শৌচাগারে লুকিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন এবং জিম্মি দশায় পড়েছিলেন যে শারমিনা পারভিন কিংবা যাঁদের বাসায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র পরিচয়ে ঘাঁটি গেড়েছিলেন জঙ্গিরা, তাঁরা আদালতে সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন। তদন্তের বিভিন্ন পর্যায়ে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম থেকে পাওয়া তথ্যের বাইরেও আদালতের কার্যক্রমে নতুন নতুন তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
জানা গিয়েছিল, জিম্মি দশার শুরুতে হোলি আর্টিজান বেকারির বাইরে থাকা পুলিশ ও ভেতরে থাকা জঙ্গিদের মধ্যে গোলাগুলি হয়। নিহত হন পুলিশের দুই সদস্য বনানী থানার ওসি সালাউদ্দিন ও ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার রবিউল করিম।
তবে গত ১৮ জুন আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের কনস্টেবল মো. বাদশা আদালতকে জানান, ভোরের দিকে যখন কমান্ডোরা অভিযান শুরু করেন, তখন শেষবারের মতো জঙ্গিরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দিকে গুলি ছোড়ে। ২ জুলাই সকালের অভিযানের আগে জঙ্গিদের কেউ আহত হয়েছেন, এমন কোনো তথ্যও ছিল অজানা। গত ২১ মে ভাটারা থানার উপপরিদর্শক ফারুক হোসেন আদালতকে বলেন, রাতেই পুলিশের গুলিতে নিবরাস ইসলাম আহত হন। রেস্তোরাঁকর্মী দিদার হোসেন গত ২৭ মে আদালতকে বলেন, শৌচাগারে দমবন্ধ হয়ে মরে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল তাঁদের। ভোরের দিকে সন্ত্রাসীরা তাঁদের বের করে এনে দাঁড় করিয়ে দেন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লাশের সামনে।
হোলি আর্টিজান বেকারির শেফ সাইফুল চৌকিদার ও তাঁর সহযোগী শাওন যে বেকারির কর্মী ছিলেন, জঙ্গি নন, সে কথা সাক্ষ্য গ্রহণের চতুর্থ দিনেই আদালতকে জানান তাঁদের সহকর্মী মুন্না দেওয়ান। হত্যা ও জিম্মি দশার অবসানের পর সেনা সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছিল, একজন সন্দেহভাজনকে জীবিত গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ধারণা করা হয়েছিল, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন স্প্লিন্টারবিদ্ধ শাওনই হয়তো সেই ব্যক্তি। আর সাইফুল চৌকিদারের লাশ পড়ে ছিল জঙ্গিদের সঙ্গে। ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে পায়ে চোট পেয়েছিলেন, তবু সহকর্মী শাওনের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে গিয়েছিলেন মুন্না দেওয়ান।
জব্দ তালিকার অসংগতি প্রসঙ্গ
এই মামলায় রাকিবুল ইসলাম রিগ্যান, আসলাম হোসেন ওরফে রাশেদ ওরফে র্যাশ ও শরিফুল ইসলাম খালেদের পক্ষের আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ। তিনি বারবারই এই উপসংহারে পৌঁছাতে চেয়েছেন যে হোলি আর্টিজান বেকারির ভেতরে যে মৃত্যু, তা বাইরে থেকে পুলিশের ছোড়া গুলির কারণে। এর বাইরে তিনি কমপক্ষে তিনটি বিষয়ে অসংগতির কথা তুলে ধরেন আদালতে।
গুলশান থানায় মামলা করেছিলেন থানার উপপরিদর্শক রিপন কুমার দাস। এই মামলার প্রথম সাক্ষীও তিনি। অভিযোগপত্রে জব্দ তালিকায় তাঁর ভুলের কথা জানান মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হুমায়ুন কবীর। ভুলগুলো হলো, জব্দ তালিকায় পাঁচটি নাইন এমএম পিস্তল জব্দ করার কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে দুটি পিস্তল ৭ দশমিক ৬২ ক্যালিবারের, বাকি দুটি ৯ এমএম ক্যালিবারের এবং একটি পিস্তলের হ্যামার নেই। তা ছাড়া ২৮টি গুলির মধ্যে দুটির পেছনে চিহ্ন আছে। একে-২২ বোরের মেশিনগান লেখা হয়েছে, হবে একে-২২ বোরের রাইফেল। একে ২২ বোর মেশিনগানের তাজা গুলির কথা বলা হয়েছে। আসামিপক্ষের আইনজীবীর যুক্তি হলো, জব্দ তালিকা সংশোধনের কোনো সুযোগ নেই।
>হোলি আর্টিজানে হামলার ৩ বছর
জঙ্গি হামলা: ২০১৬ সালের ১ জুলাই
অভিযোগপত্র জমা: ২০১৮ সালের ২৩ জুলাই
বিচার শুরু: ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর
২৭ কার্যদিবসে ৬০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ
মামলায় মোট সাক্ষী ২১১ জন
আদালতের কার্যক্রমে নতুন তথ্য বেরিয়ে এসেছে
তা ছাড়া সন্ত্রাসবিরোধী আইনের তদন্ত কর্মকর্তাকে সাক্ষীর কাছ থেকে লিখিতভাবে সাক্ষ্য নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত যাঁরা সাক্ষ্য দিয়েছেন, তাঁদের দু-একজন ছাড়া কেউই হাতে লিখে ঘটনার বর্ণনা দেননি। তাঁর চোখে ত্রুটি আছে আরও। যেমন এই আইনে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দির কোনো সুযোগ নেই। এটি ২২ ও ২৩ ধারায় নেওয়ার কথা। কিন্তু বেশির ভাগ জবানবন্দির ওপর লেখা রয়েছে ১৬৪ ধারায় দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের প্রধান মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, হোলি আর্টিজানের তদন্ত ছিল জটিল। তদন্ত অনেকটা মালা গাঁথার মতো। একটি সূত্রর সঙ্গে অপর একটি সূত্র গেঁথে গেঁথে উপসংহারে পৌঁছাতে হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো একটি ঘটনা ঘটার পর আসামি গ্রেপ্তার হন। সেখান থেকে বড় একটা দিশা পাওয়া যায়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মূল আসামিদের সবাই নিহত হন। তারপর বেশ কয়েকজন আসামি গ্রেপ্তার হন। তাঁদের দেওয়া সাক্ষ্য, তাঁদের কাছ থেকে পাওয়া নথিপত্র বিশ্লেষণ করে অভিযোগপত্রটি চূড়ান্ত হয়। তিনি বলেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে অভিযোগপত্র নিয়ে আমি পুরো সন্তুষ্ট নই। মূল আসামিদের জীবিত ধরতে পারলে ভালো হতো।’
গত বছরের ২৩ জুলাই পুলিশ আদালতে হোলি আর্টিজান হামলার অভিযোগপত্র জমা দেয়। এ ঘটনায় ২১ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে, যাঁদের মধ্যে পাঁচজন ওই দিন ঘটনাস্থলেই নিহত হন। আটজন পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন অভিযানে নিহত হন। এ ছাড়া ওই ঘটনায় ৭৫টি আলামত পাওয়া গেছে। এ মামলায় মোট সাক্ষী ২১১ জন। এর মধ্যে ১৪৯ জন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। এর বাইরে বিভিন্ন সংস্থার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, ফরেনসিক টেস্ট যাঁরা করেছেন, তাঁদের সাক্ষ্য নেওয়া হয়।
জঙ্গি হামলার এই বিচারিক প্রক্রিয়ার দিকে নজর আছে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের।
আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, সব বিধিবিধান মেনে দ্রুততম সময়ের মধ্যে হোলি বেকারিতে জঙ্গি হামলার বিচার শুরু হয়েছে। এই মামলা সরকার অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতি ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার ঘোষণা দিয়েছেন। সেদিক থেকে এই মামলা সরকারের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।