ভারতের আদানি গ্রুপের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনতে বাংলাদেশকে ২৫ বছরে ৭০ হাজার কোটি টাকা বাড়তি ব্যয় করতে হবে। দেশীয় উৎপাদকদের চেয়ে আদানির বিদ্যুতের দাম বেশি, এ কারণেই বাড়তি খরচ হবে বাংলাদেশের।
ভারতের বৃহৎ ওই শিল্পগোষ্ঠীর কাছ থেকে ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেনার জন্য চুক্তি করেছে বাংলাদেশ। জ্বালানিবিষয়ক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ইনস্টিটিউট অব এনার্জি ইকোনমিকস অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল অ্যানালাইসিসের (আইফা) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আদানির কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত এ বিদ্যুতের প্রতি ইউনিটের দর পড়বে ৮ টাকা ৭১ পয়সা।
অন্যদিকে দেশীয় প্রতিষ্ঠান এস আলমের কেন্দ্রের বিদ্যুতের দর পড়বে ইউনিটপ্রতি ৬ টাকা ৫২ পয়সা। বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের যৌথ উদ্যোগে স্থাপিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ইউনিটপ্রতি ৭ টাকা ৭১ পয়সা দরে বিদ্যুৎ কেনা হবে।
আর ভারতের কর্ণাটকে সম্প্রতি নির্মিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ৪ টাকা ৮০ পয়সা খরচ পড়ছে। এস আলমের বিদ্যুতের দর ও আদানির বিদ্যুতের দর তুলনা করলে বাড়তি ৭০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের হিসাব পাওয়া যায়।
আইফার ‘আদানি গোড্ডা পাওয়ার প্ল্যান্ট: টু এক্সপেনসিভ, টু লেট, টু রিস্কি ফর বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদন চলতি মাসে প্রকাশ করা হয়। আইফা বলছে, আদানির বিদ্যুতের বাড়তি দামের কারণেই বাংলাদেশকে বাড়তি ব্যয় করতে হবে। এই দর বেশি পড়ছে দেশি কয়লার বদলে আমদানি করা
কয়লার ব্যবহার, বাংলাদেশ ও ভারতীয় অংশে
সঞ্চালন লাইন নির্মাণের খরচ বিদ্যুতের দামের
মধ্যে দেখানো, সিস্টেম লসের অংশ বাংলাদেশের
দরের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়াসহ বিভিন্ন কারণে।
পুরো বিষয় নিয়ে আইফার সমীক্ষা দলের প্রধান সাইমন নিকোলাস ই-মেইলে প্রথম আলোকে
বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য আদানি তাদের মালিকানাধীন অস্ট্রেলিয়ার কারমিখায়েল কয়লাখনি থেকে কয়লা আনবে। তা খালাস করা হবে ওডিশার ধামরায় অবস্থিত তাদের মালিকানাধীন বন্দরে। সেখান থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রে কয়লা নেওয়া হবে তাদের নির্মিত ৭০০ কিলোমিটার রেললাইনের মাধ্যমে। এতে বিদ্যুতের দাম পড়ে যাবে বেশি। আর এই অর্থ বাংলাদেশের কাছ থেকে আদায় করা হবে।
সাইমন নিকোলাস বলেন, এটা পরিষ্কার যে বাংলাদেশের সঙ্গে এই বিদ্যুৎ কেনার চুক্তিতে নানা বিনিয়োগে সংকটে থাকা আদানির নিজের স্বার্থ অনেক বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। আর বাংলাদেশের জন্য তা ঝুঁকিপূর্ণ হবে।
আদানি গ্রুপ ভারতের গুজরাটভিত্তিক একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান। তাদের জ্বালানি, বন্দর পরিচালনা, অর্থনৈতিক অঞ্চল, ভোগ্যপণ্য, কৃষিভিত্তিক শিল্পসহ বিভিন্ন খাতে ব্যবসা রয়েছে। বাংলাদেশ ভারত থেকে যে বিদ্যুৎ আমদানির যে উদ্যোগ নিয়েছে, তার অংশ হিসেবে আদানির কাছ থেকেও আমদানির চুক্তি হয়।
গত বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে চুক্তিটি সই হয়। আদানি গ্রুপ ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত।
আইফার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আদানি গ্রুপের কয়েক বছর ধরে খারাপ সময় যাচ্ছে। এ প্রভাব প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার দরেও পড়েছিল। তবে বাংলাদেশের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রয় চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার পরই তাদের শেয়ার দর বেড়ে যায়।
দেশীয় কয়লার কথা বলে আমদানি
আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করা হচ্ছে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ঝাড়খন্ডের গোড্ডা জেলায়। বাংলাদেশে বিদ্যুৎ আনতে ২৪৫ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করতে হবে। এর ৯৫ কিলোমিটার ভারতের অংশে, বাকিটা বাংলাদেশে। ভারতের অংশে যে লাইন নির্মিত হবে, তার ব্যয়ও বিদ্যুতের দামের মধ্যে ধরা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে আইফার প্রতিবেদনে। এতে আরও বলা হয়, আদানি শুরুতে মাত্র ১৬ কিলোমিটার দূরে তাদের খনি থেকে কয়লা এনে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু ২০১৬ সালের মে মাসে তারা একটি হালনাগাদ প্রস্তাব দেয়, যেখানে আমদানি করা কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বলা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আদানি এখন কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনা করছে। এগুলো সমুদ্রের কাছে, যাতে সড়ক অথবা রেলে কয়লা পরিবহনের খরচ কমানো যায়। কিন্তু গোড্ডায় তাদের প্রকল্প বন্দর থেকে ৭০০ কিলোমিটার দূরে। কয়লা পরিবহনে বাড়তি ব্যয় করেও তারা এ প্রকল্প লাভজনক দেখছে। কারণ, বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তি কোম্পানির অনুকূলে। এটা এতই আদানির অনুকূলে, যা বাংলাদেশের জন্য সহায়ক হবে না।
কয়লার দরে কারসাজির আশঙ্কা
দেশের বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনে আদানি আমদানি করা কয়লার প্রকৃত মূল্য দেখাবে, এর নিশ্চয়তা নেই। কারণ, এ প্রতিষ্ঠান খোদ নিজ দেশেই বেশি দাম দেখিয়ে কয়লা আমদানি করে ধরা পড়েছে। এ কেলেঙ্কারির সঙ্গে আদানি, রিলায়েন্স ছাড়াও দেশটির সরকারি প্রতিষ্ঠান এনটিপিসিও জড়িত রয়েছে। ভারতের শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ (ডিরেক্টরেট অব রেভিনিউ ইন্টেলিজেন্ট বা ডিআরআই) ২০১৬-এর জুলাইয়ে ডিআরআই ভারত সরকারের কাছে এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দেয়। সেখানে বলা হয়, কয়লা আমদানিকারকেরা আমদানির ক্ষেত্রে প্রকৃত মূল্যের চেয়ে ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ বেশি দাম দেখিয়েছে। এ অর্থ তারা পাচার করেছে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
দাম বেশি জেনেও চুক্তির সুপারিশ
বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, আদানির বিদ্যুৎ কিনতে সরকার ২০১৬ সালে বিদ্যুৎ বিভাগের যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন) শেখ ফয়েজুল আমীনকে সদস্যসচিব করে ৬ সদস্যের কমিটি গঠন করে। ওই কমিটি আদানি গ্রুপের বিদ্যুতের দাম বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ে বেশি বলে মত দেয়। এরপরও কমিটি ২৫ বছর মেয়াদে আদানির বিদ্যুৎ কেনার সুপারিশ করে। তবে এ চুক্তি বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইনের আওতায় করার পরামর্শ দেওয়া হয় কমিটির পক্ষ থেকে। এই আইন অনুযায়ী, আদানির সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে দেশের কোনো আদালতে যাওয়া যাবে না। পরে এই আইনের অধীনেই আদানির সঙ্গে চুক্তি হয়।
বিদ্যুৎ বিভাগ যা বলছে
সার্বিক বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব আহমেদ কায়কাউস প্রথম আলোকে বলেন, ‘আদানি ভারতে ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে কয়লার দাম বেশি দেখিয়েছে, এটা আমরাও শুনেছি। তবে সেটি তাদের দেশের শুল্ক গোয়েন্দা সংস্থা ধরেও ফেলেছে।
আমরা যখন বিদ্যুতের দাম দেব, তাদের তখন
এসব বিষয় পর্যবেক্ষণ করেই দাম দেব।’ তিনি বলেন, ‘এর সঙ্গে আমাদের দেশের শুল্ক বিভাগ যুক্ত
থাকবে। এ রকম কিছু তারা করলে তা ধরা পড়বে।’ তিনিও আদানির বিদ্যুতের দাম বেশি হওয়ার পেছনে সঞ্চালন লাইন স্থাপন, সিস্টেম লসও দামের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা, ভারতে বিদ্যুতের ওপর করপোরেট কর থাকার যুক্তি দেখান।