অশেষ সম্ভাবনা সত্ত্বেও ১১ মার্চের (১৯৪৮) ভাষা আন্দোলন তার অকালমৃত্যু ঠেকাতে পারেনি। এর আপাত-কারণ পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকা সফর এবং সেই সূত্রে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সংগ্রাম পরিষদের সম্পাদিত শান্তিচুক্তি। কিন্তু এর নেপথ্যে রয়েছে সংগ্রাম পরিষদে নানা মতাদর্শভিত্তিক নেতৃত্বে অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং সংগঠনবিশেষের পিছুটান। সে ক্ষেত্রে এমন আশঙ্কাও কাজ করেছে যে আন্দোলন যে তীব্রতা নিয়ে শক্তি সঞ্চয় করে চলেছে, তাতে এর নিয়ন্ত্রণ বামপন্থীদের হাতে চলে যেতে পারে। কাজেই বিশেষ উপলক্ষে সরকারের সঙ্গে আপসরফাই শ্রেয়।
তখনকার সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিচারে তেমন আশঙ্কার খুব একটা বাস্তব ভিত্তি ছিল না। ছাত্রদের বড়সড় অংশ এবং জনসাধারণের মধ্যে অন্ধ পাকিস্তানপ্রীতি তখনো প্রবল। বিরাজমান সাম্প্রদায়িক চেতনা এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভয়াবহতা তার প্রমাণ। তবে এ কথাও ঠিক যে এর মধ্যেই উদারপন্থা, গণতান্ত্রিক চেতনা এবং প্রগতিবাদিতা ছাত্র-যুবাদের মধ্যে ধীরেসুস্থে হলেও ক্রমবর্ধমান। এবং এ প্রভাব মার্চের আন্দোলনে দেখা গেছে। হয়তো তাই উদার গণতন্ত্রী হিসেবে পরিচিত তাজউদ্দীন আহমদও আন্দোলন স্থগিত করে চুক্তি সম্পাদনের পক্ষে ছিলেন না। আর বামপন্থী মহম্মদ তোয়াহা তো ননই। এমনকি শেখ মুজিবুর রহমানও আন্দোলনের পক্ষেই ছিলেন। তবু সংশ্লিষ্ট প্রধান সংগঠনগুলোর চাপে এবং জনা কয়েক রাজনীতিকের পরামর্শে আন্দোলন স্থগিত করা হয়। রাষ্ট্রপ্রধানের মর্যাদা রক্ষা করা বলে কথা।
স্বভাবতই যা ভাবা গিয়েছিল, তা-ই ঘটেছে। আটচল্লিশ থেকে একান্ন পর্যন্ত নতুন করে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে কোনো বলিষ্ঠ আন্দোলন গড়ে তোলা যায়নি। ডানপন্থীদের পিছুটানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল শাসকশ্রেণীর ফ্যাসিস্ট-সুলভ দমননীতি এবং নানা ষড়যন্ত্রের খেলা। নানা সুযোগ-সুবিধাসহ উদুর্বাদীদের সামনে এগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। চলেছে তাদের প্রচার ইসলামের নামে, পাকিস্তান রক্ষার নামে। সর্বোপরি ছিল ‘জিন্নাহ ফ্যাক্টর’। সাধারণ মানুষ তখনো তাঁর মুগ্ধ সমর্থক। ব্যতিক্রম কিছুসংখ্যক ছাত্র-যুবা এবং গণতান্ত্রিক ও প্রগতিবাদী রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী।
তাই ১৯৪৯ সালের ১১ মার্চ পালনের চেষ্টা সত্ত্বেও ছাত্র ফেডারেশনের নেতা-কর্মীরা পুলিশের দাপটে এবং ব্যাপক ছাত্র সমর্থনের অভাবে রাজপথে দাঁড়াতে পারেনি। দাঁড়াতে পারেনি নাদেরা বেগম, তকিউল্লাহ, নাসির আহমদ প্রমুখর নেতৃত্বে পরিচালিত ছোটখাটো বিক্ষোভ মিছিল। বাহাউদ্দিন চৌধুরী, ইকবাল আনসারি খান হেনরি, মৃণালকান্তি বাড়ড়ি, আবদুস সালাম, সৈয়দ আফজল হোসেন প্রমুখ তরুণ ছাত্রের উদ্দীপনাও কাজে আসেনি। অন্যরা এগিয়ে না আসায় সেবার ১১ মার্চ পালন ব্যর্থ হয়ে যায়।
কিন্তু এর প্রভাব হয়তো কিছুটা হলেও ছাত্রসমাজকে স্পর্শ করে থাকবে। তাই ১৯৫০ সালেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ১১ মার্চ আন্দোলন দিবস হিসেবে উদ্যাপিত হয়। এবং ওই ছাত্রসভায় নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। ছাত্রনেতা আবদুল মতিন হন কমিটির আহ্বায়ক। চেষ্টা চলে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি সক্রিয় করে তোলার। কিন্তু নানা কারণে আন্দোলনের পরিস্থিতি তৈরি করা যায়নি।
আটচল্লিশের আন্দোলনের পর প্রায় চার বছরের দীর্ঘ সময়টাকে একুশের প্রস্ত্ততিপর্ব বলা চলে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের তীব্রতা লক্ষ করেই বোধ হয় শাসকশ্রেণী দেশের সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিবেশ দূষিত করার চেষ্টা চালায়। এবং সে লক্ষ্যে কিছুটা সফলও হয়। এর প্রমাণ পরবর্তী সময়ে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং রাজনৈতিক দিক থেকে বামপন্থা দমনের নামে জেলে ও জেলের বাইরে কর্মীদের ওপর বর্বর নির্যাতন। রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে বন্দীদের ওপর গুলি চালিয়ে হত্যা, দেশের বিভিন্ন জেলে বন্দীহত্যার মতো বর্বরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ওঠেনি। এমনই ছিল সে সময় কমিউনিস্ট-বিরূপতা।
একই সঙ্গে বাংলাবিরোধীদের নানাভাবে চাঙা করে তোলা হয়। ধর্মীয় জাতীয়তায় বিশ্বাসী সাহিত্যিক-সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীদের তৎপরতা ছিল তখন লক্ষ করার মতো। বিশেষ করে ‘বাবায়ে উদুর্’ ড. আবদুল হক, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ফজলুর রহমান, মওলানা আকরম খাঁ প্রমুখর বক্তব্য ও তৎপরতায় উদুর্র অবস্থান ও ধর্মীয় ধ্যানধারণা বেশ জোর পায়ে চলতে থাকে। অবাঙালি-বাঙালি শাসকগোষ্ঠীর পরিকল্পনায় জোরদার হয়ে ওঠে ভাষাবিষয়ক ষড়যন্ত্র, বিশেষ করে আরবি হরফে বাংলা লেখার চেষ্টা, উদুর্ শিক্ষার প্রসার ইত্যাদি কর্মকাণ্ড। কেন্দ্রীয় বাজেট, প্রাদেশিক বাজেট এদিক থেকে অবিশ্বাস্য উদারতার পরিচয় রাখে। আশ্চর্য যে হরফবিষয়ক উদ্ভট কর্মকাণ্ডে উদ্যোগী ছিলেন আশকার ইবনে শাইখ, সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইনের মতো বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ।
এ ধরনের কিছু ঘটনা, বলা চলে শাসকগোষ্ঠীর অদূরদর্শিতার ফল বাংলা দাবির পক্ষে প্রেরণা জোগায়। যেমন আটচল্লিশে, তেমনি পঞ্চাশে পাকিস্তান গণপরিষদের অগণতান্ত্রিক আচরণ ভাষার দাবিকে সামনে নিয়ে আসে। মূলনীতি কমিটির উদুর্ রাষ্ট্রভাষা সুপারিশের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ ও সংগ্রাম কমিটি গঠন (নভেম্বর ১৯৫০) ভাষিক চেতনা নতুন করে জাগিয়ে তোলে। দেশজুড়ে শুরু হয় বিক্ষোভ সমাবেশ, মিছিল, প্রতিবাদ। পঞ্চাশ থেকে একান্নে পৌঁছে ভাষার দাবি ক্রমেই জোরালো হতে থাকে।
এবার অধিকসংখ্যায় শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, এমনকি সরকারি কর্মচারীদেরও অনেকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে এগিয়ে আসেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি (১৯৫১) পূর্ববাংলায় সর্বস্তরের বাংলা প্রচলনের দাবিতে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের কাছে স্মারকলিপি পাঠানো হয়। এসব ক্ষেত্রে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. কাজী মোতাহার হোসেন প্রমুখ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ভাষার দাবি যে নতুন করে শক্তি অর্জন করছে, নানা ঘটনায় তা স্পষ্ট হতে থাকে।
সূত্র: ভাষা আন্দোলন, আহমদ রফিক, প্রথমা প্রকাশন, ২০০৯