আটকে আছে চালকের ৪৪ লাখ লাইসেন্স

চালকের তথ্যভান্ডার জটিলতায় লাইসেন্স নবায়ন ও যাচাইয়ের কাজ বন্ধ। তিন বছর ধরে সমস্যার সমাধান করতে পারেনি বিআরটিএ।

দেশে যানবাহনচালকের লাইসেন্সের একমাত্র অভিভাবক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। সংস্থাটির অন্যতম কাজ নতুন লাইসেন্স প্রদান ও পুরোনো লাইসেন্স নবায়ন। পাশাপাশি বিআরটিএ সব লাইসেন্সধারী চালকের তথ্যভান্ডার সংরক্ষণ করে। অর্থাৎ চালকেরা সঠিক নাকি ভুয়া লাইসেন্স দিয়ে যানবাহন চালাচ্ছেন, তা যাচাই করার মূল এখতিয়ার সংস্থাটির। কিন্তু তিন বছর ধরে এ লাইসেন্স–সংক্রান্ত কার্যক্রম প্রায় অচল হয়ে আছে।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে চালকের লাইসেন্স কার্যক্রম পরিচালনা করে বিআরটিএ। সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় ও বিআরটিএ সূত্র বলছে, ঠিকাদারের স্বেচ্ছাচারিতা ও বিআরটিএর অদক্ষতার কারণে প্রায় ৪৪ লাখ লাইসেন্স আটকে আছে। লাইসেন্সের জটিলতায় সড়ক নিরাপত্তা যেমন হুমকিতে পড়েছে, তেমনি লাইসেন্স পেতে বছরের পর বছর ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে গ্রাহককে।

বিদেশ যেতে ইচ্ছুক আবু বকর সিদ্দিকের ক্ষেত্রে লাইসেন্স পেতে পাঁচবার সময় বাড়িয়েছে বিআরটিএ। তিনি বলেন, প্রায় তিন বছর ধরে ঘুরছি। লাইসেন্স পেলে বিদেশ যেতে কিছু টাকা কম লাগত।

বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, ২০১১ সাল থেকে বিআরটিএর লাইসেন্স সরবরাহ, চালকের তথ্যভান্ডার তৈরি এবং তা সংরক্ষণের দায়িত্বে ছিল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান টাইগার আইটি। তারা নতুন লাইসেন্সের জন্য আবেদনকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য, আঙুলের ছাপ, ছবিসহ তথ্যভান্ডার অনলাইনে সংরক্ষণ করে। পাশাপাশি ২০১১ সালের আগের লাইসেন্সগুলোর তথ্যও অনলাইনে যুক্ত করে। সব মিলিয়ে প্রায় ৪৪ লাখ লাইসেন্সের তথ্যভান্ডার তৈরি করা হয়। চুক্তির জটিলতায় ২০১৯ সালের শুরুতে নতুন লাইসেন্স সরবরাহ প্রায় বন্ধ করে দেয় টাইগার আইটি। এ কাজের জন্য বিআরটিএ নতুন ঠিকাদার নিয়োগ করে ভারতের মাদ্রাজ প্রিন্টার্সকে।

সময়মতো লাইসেন্স না দিতে পারলে চালকদের মধ্যে লাইসেন্স নেওয়ার অনীহা বাড়বে, ভুয়া লাইসেন্স সংগ্রহের প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে।
অধ্যাপক হাদীউজ্জামান, পরিচালক সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট, বুয়েট

নিয়মানুযায়ী, পুরোনো লাইসেন্স নবায়ন এবং নতুন লাইসেন্সের তথ্যভান্ডার তৈরির সব কাজ করার কথা মাদ্রাজ প্রিন্টার্সের। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি দায়িত্ব নিয়ে চেষ্টা করেও তথ্যভান্ডার উদ্ধার করতে পারেনি। টাইগার আইটির সফটওয়্যার, ব্যবস্থাপনা ও তথ্য রাখার পদ্ধতির সঙ্গে তারা অভ্যস্ত নয়। অন্যদিকে বিআরটিএর নিজের কোনো তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ দল নেই। এ পরিস্থিতিতে মেয়াদ পেরিয়ে গেলে বা হারিয়ে গেলে পুনরায় লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে গ্রাহকদের কাছ থেকে ফি জমা নিয়ে একটি রসিদ ধরিয়ে দিচ্ছে বিআরটিএ।

টাইগার আইটির প্রকল্প পরিচালক এ বি এম মহিউদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, তারা এখন দায়িত্বে নেই। সবকিছু বিআরটিএকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে।

অবশ্য লাইসেন্সের জটিলতা বেশি দিন থাকবে না বলে মনে করেন বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পুরোনো লাইসেন্স কিছু কিছু প্রিন্ট করা হচ্ছে। কিন্তু গতি কম। শক্তিশালী প্রিন্টার শিগগিরই চলে আসবে। তখন সমস্যা হবে না।

তথ্যভান্ডার উদ্ধার করতে না পারার বিষয়ে বিআরটিএ চেয়ারম্যান বলেন, এটি কারিগরি সমস্যা। একটা ব্যবস্থা থেকে অন্য একটা ব্যবস্থা যেতে গেলে কিছু সমস্যা হয়। আশা করছেন, দ্রুত সমাধান হয়ে যাবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এখন দোষ খুঁজে লাভ কী? কাজটা হলেই হয়।’

যদিও তিন বছর ধরে লাইসেন্সের জটিলতার সমাধান করতে পারেনি বিআরটিএ। সংস্থাটির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, টাইগার আইটি আজীবন লাইসেন্স দেওয়ার কাজ নিজের আয়ত্তে রাখতে তথ্যভান্ডারটি না বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেছে। আর মাদ্রাজ প্রিন্টার্স দায়িত্ব এড়িয়েছে নতুবা তাদের সক্ষমতার ঘাটতির কারণে কাজটি করেনি। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএর দায়িত্ব ছিল টাইগার আইটি ও মাদ্রাজ প্রিন্টার্সকে এক জায়গায় বসিয়ে কাজটি আদায় করে নেওয়া। কিন্তু সংস্থাটির নেতৃস্থানীয়রা এটা কেন পারলেন না—এটা বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।

বিআরটিএ সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিষ্ঠান। লাইসেন্সের জটিলতার বিষয়ে সড়ক মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মো. নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, লাইসেন্স নিয়ে একটা সংকট আছে। শিগগিরই সমাধান হবে বলে বিআরটিএ থেকে তাঁকে জানানো হয়েছে। এ সংকটের পেছনে কে দায়ী, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এককভাবে কাউকে দায়ী করা কঠিন। তবে সমাধানটা জরুরি। সে পথেই তাঁরা হাঁটছেন।

সড়ক নিরাপত্তাঝুঁকিতে

সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো বৈধ লাইসেন্স ও চালকের দক্ষতা। পুলিশের দেওয়া তথ্য ধরে সড়ক দুর্ঘটনার কারণ বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই)। ১৯৯৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত তাদের তথ্যে দেখা গেছে, ৯০ শতাংশ দুর্ঘটনার পেছনে চালকের সম্পৃক্ততা রয়েছে।

সড়ক পরিবহন আইন অনুসারে, কোনো ব্যক্তি লাইসেন্স ছাড়া যানবাহন চালালে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা বা ছয় মাসের কারাদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। ভুয়া লাইসেন্সধারী চালকের শাস্তি কমপক্ষে এক লাখ থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা সর্বনিম্ন ছয় মাস থেকে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। অর্থাৎ ভুয়া লাইসেন্স নিয়ে যানবাহন চালালে শাস্তি কঠোর। এ আইন প্রয়োগ করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিআরটিএর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।

বিআরটিএর কর্মকর্তারা জানান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনো চালকের লাইসেন্স নিয়ে সন্দেহ হলে বিআরটিএর কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কম্পিউটারে থাকা নির্দিষ্ট প্রোগ্রামে লাইসেন্স নম্বরটি দিলে মুহূর্তেই জানতে পারতেন, সেটি ভুয়া, না সঠিক। কিন্তু এখন বিআরটিএর কর্মকর্তারা এ কাজ পারছেন না। তাঁদের ‘ডেটা এন্ট্রি প্যানেল’, ‘প্রুফ প্যানেল’ ও ‘অ্যাপ্রোভাল’ ইউজার আইডি ইনঅ্যাকটিভ অথবা লকড দেখাচ্ছে। এমনকি সড়ক দুর্ঘটনার পর চালকের লাইসেন্সও যাচাই করতে পারছেন না তাঁরা।

কেউ পুরোনো লাইসেন্স নবায়ন করতে এলে সঠিক আছে—এ সরল বিশ্বাসে ফি জমা নিচ্ছে বিআরটিএ। এরপর গ্রাহককে ফি পরিশোধের একটি রসিদ দেওয়া হয়, যা অ্যাকনলেজমেন্ট স্লিপ নামে পরিচিত। এটা দিয়ে গ্রাহক যানবাহন চালাতে পারবে উল্লেখ করে সিল দেওয়া হয়।

নাম প্রকাশ না করে বিআরটিএর একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, দেশে প্রচুর ভুয়া লাইসেন্স থাকার অভিযোগ আছে। এখন যাঁরা লাইসেন্স নবায়ন করতে আসছেন, তাঁদের মধ্যে যদি ভুয়া লাইসেন্স থাকে, তাহলে তো পরে বিপদে পড়তে হবে।

ভোগান্তির শেষ নেই

মো. সাব্বির গুলশানে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়ি চালান। মাঝারি যানের পেশাদার এই চালক ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে নিজের লাইসেন্সটি নবায়নের আবেদন করেছিলেন। বিআরটিএ তাঁকে স্মার্ট কার্ড লাইসেন্স সরবরাহের তারিখ দেয় ২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর। নির্ধারিত দিনে বিআরটিএতে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, লাইসেন্স কার্ড হয়নি। পরবর্তী তারিখ দেওয়া হয় ২৩ আগস্ট ২০২১। এদিন বিআরটিএ কার্যালয়ে গিয়ে ব্যর্থ হন সাব্বির। এবার তারিখ পড়ে ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২। সর্বশেষ তিনি মিরপুর কার্যালয়ে যান ৬ মার্চ। গিয়ে জানতে পারেন এবারও কার্ড হয়নি। তাঁকে আগামী ২০ নভেম্বর নতুন করে তারিখ দেওয়া হয়।

সাব্বির প্রথম আলোকে বলেন, লাইসেন্স নবায়ন করতে কর্মস্থল থেকে ছুটি নিয়ে চারবার বিআরটিএ কার্যালয়ে এসেছেন। কিন্তু কেন কার্ড পাচ্ছেন না, জানতে চেয়েও কোনো সদুত্তর পাননি তিনি। বিআরটিএ শুধু তাঁর লাইসেন্স সংগ্রহের রসিদে সময় বাড়ানোর সিল দিয়েই যাচ্ছে।

৬ মার্চ বিআরটিএ কার্যালয়ে ট্রাকচালক আমির হোসেন বলেন, তিনি ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে লাইসেন্স নবায়নের আবেদন করেছিলেন। দুবার সময় বাড়িয়ে আগামী নভেম্বর নতুন তারিখ দেওয়া হয়েছে। তিনি জানান, পেশাদার চালকের লাইসেন্সের মেয়াদ পাঁচ বছর। তাঁর লাইসেন্সের মেয়াদ পেরিয়েছে ২০১৮ সালে। আগামী বছরের শুরুতে পুনরায় নবায়নের সময় চলে আসবে। এখনো লাইসেন্সই হাতে পাননি। এভাবে কাজ ফেলে বিআরটিএ কার্যালয়ে এসে ধরনা দিতে হচ্ছে।

বিদেশ যেতে ইচ্ছুক আবু বকর সিদ্দিকের ক্ষেত্রে লাইসেন্স পেতে পাঁচবার সময় বাড়িয়েছে বিআরটিএ। তিনি বলেন, প্রায় তিন বছর ধরে ঘুরছি। লাইসেন্স পেলে বিদেশ যেতে কিছু টাকা কম লাগত।

স্মার্ট কার্ড লাইসেন্স, যানবাহনের ডিজিটাল নম্বরপ্লেট, যানবাহনের মালিকানার স্মার্ট কার্ডসহ নানা ডিজিটাল সেবা বিআরটিএ থেকে টাকার বিনিময়ে নিতে হচ্ছে গ্রাহকদের। এসব সেবার কোনো পর্যায়েই সরকার কোনো খরচ বহন করে না। এরপরও গ্রাহকদের দীর্ঘ ভোগান্তি ও হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে চালকের লাইসেন্সের জটিলতা, যা সড়ক নিরাপত্তার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক হাদীউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, প্রথম কথা হচ্ছে, বাংলাদেশে যে পদ্ধতিতে লাইসেন্স দেওয়া হয়, তাতে দক্ষ চালক পাওয়া খুব কঠিন। এরপরও সময়মতো লাইসেন্স না দিতে পারলে চালকদের মধ্যে লাইসেন্স নেওয়ার অনীহা বাড়বে, ভুয়া লাইসেন্স সংগ্রহের প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে। ইতিমধ্যে খবর পাওয়া যাচ্ছে, যানবাহনের তুলনায় লাইসেন্স কম থাকায় প্রায় ২০ লাখ যানবাহন চালাচ্ছেন ভুতুড়ে চালকেরা। এটা নিরাপদ সড়কের জন্য খুবই ঝুঁকির। তিনি আরও বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে, যেনতেন লাইসেন্সধারীর চেয়েও লাইসেন্সবিহীন চালকেরা সড়কে বেশি বেপরোয়া আচরণ করেন।