আজমেরী ওসমান ও সুলতান শওকতনারায়ণগঞ্জের মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যার নেতৃত্বে ছিলেন আজমেরী ওসমান। তিনি জাতীয় পার্টির সাংসদ নাসিম ওসমানের ছেলে এবং আওয়ামী লীগের নেতা শামীম ওসমানের ভাতিজা।
গত মঙ্গলবার বিকেলে এ মামলার অন্যতম আসামি সুলতান শওকত ওরফে ভ্রমর আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এ কথা বলেন। পুলিশ ও আদালত সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
নারায়ণগঞ্জের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম কে এম মহিউদ্দিনের আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে সুলতান শওকত বলেন, গত ৬ মার্চ রাতে শহরের কলেজ রোডে আজমেরী ওসমানের নেতৃত্বে ত্বকীকে খুন করা হয়। খুনের পর লাশ বস্তাবন্দী করে আজমেরী ওসমানের গাড়িতে তুলে চারারগোপে নিয়ে শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।
ত্বকী নারায়ণগঞ্জের নাগরিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নেতা রফিউর রাব্বির ছেলে। গত ৬ মার্চ সে নিখোঁজ হয়েছিল।
সূত্রমতে, সুলতান শওকত বলেন, তিনি ৬ মার্চ বিকেলে শহরের কলেজ রোডে আজমেরী ওসমানের অফিস উইনার ফ্যাশনে যান। অফিসের অভ্যর্থনাকক্ষে তখন কাজল, শিপন ও জেকিসহ আরও কয়েকজন বল খেলছিলেন। তিনি অনেকক্ষণ ধরে খেলা দেখেন। একপর্যায়ে তিনি অফিসের সিসিটিভি ক্যামেরার মনিটরে দেখতে পান, রাজীব ও কালাম টয়োটা এক্স ফিল্ডার গাড়ি নিয়ে অফিস থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন। রাত সাড়ে নয়টার দিকে রাজীব, কালাম, মামুন ও লিটন ত্বকীকে নিয়ে আজমেরীর অফিসে আসেন। রাজীব ও কালাম ত্বকীকে আজমেরীর কক্ষে নিয়ে যান। এর দেড় ঘণ্টা পর কাজল তাঁকে (সুলতান শওকত) বলেন, ‘চলো তো দেখি, কাকে নিয়ে এসেছে।’ এরপর তাঁরা দুজন আজমেরীর পাশের কক্ষে যান। এ সময় আজমেরীর কক্ষ থেকে চিৎকার, চেঁচামেচি, গালিগালাজের শব্দ আসছিল। রাত ১২টার দিকে আজমেরী তাঁর কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন। দরজা খোলার পর তিনি (শওকত) দেখতে পান, আজমেরীর কক্ষের ভেতর কালাম, লিটন, রাজীব ও মামুন দাঁড়িয়ে আছেন। আর ত্বকীর লাশ চোঁখবাধা অবস্থায় পড়ে আছে মেঝেতে। দরজা খুলে বের হয়ে এসে আজমেরী ওসমান কাজলকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘সব শেষ। তোরা যেখানে পারিস লাশটা ফেলে আয়।’
সুলতান শওকত আরও বলেন, লিটন, রাজীব ও কালাম ত্বকীর লাশ নিয়ে যাওয়ার সময় আজমেরী তাঁকেও (শওকত) তাঁদের সঙ্গে যেতে বলেন। তিনি এতে রাজি না হলে আজমেরী শোকেস লক্ষ্য করে পিস্তল থেকে দুটি গুলি করেন। এরপর তিনিসহ রাজীব, কালাম, লিটন ও মামুন মিলে ত্বকীর লাশ আজমেরীর টয়োটা এক্স ফিল্ডার গাড়ির পেছনে তোলেন। চালক জামশেদ গাড়ি চালিয়ে চারারগোপে নিয়ে যান। রাত দেড়টার দিকে চারারগোপে ১৬ তলা দেলোয়ার টাওয়ারের বিপরীতে গাড়িটি থামে। গাড়ি থামার পর চালকের পাশের আসনে বসে তিনি (শওকত) গাড়ি পাহারা দেন। রাজীব, লিটন, মামুন ও কালাম ত্বকীর বস্তাবন্দী লাশ নিয়ে নদীর ঘাটের দিকে যান। ১৫-২০ মিনিট পর তাঁরা লাশটি শীতলক্ষ্যা নদীতে ফেলে ফিরে আসেন। এরপর সবাই আবার আজমেরীর অফিসে যান। পরে সেখান থেকে যে যার মতো চলে যান।
গত সোমবার দিবাগত রাত দেড়টায় রূপগঞ্জ থেকে সুলতান শওকতকে গ্রেপ্তার করা হয়।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা যায়, একটি মাদক মামলায় গ্রেপ্তার লিটন গত ৩০ জুলাই আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ত্বকী হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কিছু তথ্য জানান। ওই জবানবন্দিতে সুলতান শওকতের নাম আসে। এরপর থেকে র্যাব সুলতান শওকতকে খুঁজছিল। লিটন হচ্ছেন আজমেরী ওসমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী।
লিটনের জবানবন্দির পর ৭ আগস্ট র্যাব-১১-এর সদস্যরা শহরের কলেজ রোডে ‘টর্চার সেল’ হিসেবে পরিচিত আজমেরী ওসমানের অফিসে অভিযান চালিয়ে রক্তমাখা জিনস প্যান্ট ও গজারির লাঠি এবং নাইলনের রশি উদ্ধার করেন। দেয়ালে ও শোকেসে অসংখ্য গুলির আলামত পাওয়া যায়।
এ অভিযানের কারণে শামীম ওসমান র্যাবের প্রতি ক্ষুব্ধ হন। গত ৮ অক্টোবর শহীদ জিয়া হলে অনুগতদের এক সভায় শামীম ওসমান র্যাবের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেন। এর পরপরই ত্বকী হত্যা মামলার তদারককারী কর্মকর্তা র্যাব-১১-এর কমান্ডিং অফিসার (পরিচালক) লে. কর্নেল জাহাঙ্গীর আলমকে চট্টগ্রামে র্যাব-৭-এ বদলি করা হয়। এতে থমকে যায় আলোচিত এ মামলার তদন্তকাজ।
সুলতান শওকতের জবানবন্দিতে ত্বকী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হিসেবে আরও যাঁদের নাম এসেছে, তাঁরা সবাই আজমেরীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী। নাসিম ওসমান, সেলিম ওসমান ও শামীম ওসমানের বিভিন্ন সভা-সমাবেশে তাঁদের দেখা যেত।
গতকাল অনেক চেষ্টা করেও ওসমান পরিবারের কারও সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
ত্বকীর লাশ উদ্ধার করা হয় ৮ মার্চ। ওই দিন রাতেই বাবা রফিউর রাব্বি অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে থানায় হত্যা মামলা করেন। ১৮ মার্চ জেলা পুলিশ সুপারের কাছে একটি অবগতিপত্র দেন। এতে ছেলে হত্যার জন্য শামীম ওসমান ও তাঁর ছেলে অয়ন ওসমানসহ মোট আটজনকে অভিযুক্ত করেন তিনি।
যোগাযোগ করা হলে রফিউর রাব্বি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘নাসিম ওসমান ও শামীম ওসমানের নির্দেশে আজমেরী ওসমান ও অয়ন ওসমান তাদের সহযোগী সন্ত্রাসীদের নিয়ে ত্বকীকে অপহরণের পর নির্মম নির্যাতন চালিয়ে খুন করেছে। আসামি ভ্রমরের (সুলতান শওকত) দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির পর তদন্তকারী সংস্থার উচিত অবিলম্বে নাসিম ওসমান, শামীম ওসমান, আজমেরী ওসমান, অয়ন ওসমানসহ তাদের সহযোগী খুনিদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা। ত্বকী হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই আমরা বলে আসছিলাম, ওসমান পরিবারই ত্বকীকে খুন করেছে। এ ছাড়া ত্বকী হত্যাকাণ্ডের পরপরই ১৩ মার্চ সাংসদ নাসিম ওসমান তাঁর ছেলে আজমেরী ওসমানের সঙ্গে মুঠোফোনে যেসব কথা বলেন, তাতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে কারা ত্বকীকে খুন করেছে।’
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা র্যাব-১১-এর সহকারী পুলিশ সুপার রবিউল হক বলেন, সুলতান শওকতের জবানবন্দির অনুলিপি হাতে পেলে তা পর্যালোচনা করে অন্যদের আইনের আওতায় আনা হবে।
সুলতান শওকত কে: সাংসদ নাসিম ওসমানের ছেলে আজমেরী ওসমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী সুলতান শওকত। তাঁর বাবা মৃত সোহরাব মিয়া। বাসা শহরের শহীদ সোহরাওয়ার্দী সড়কে। তাঁর মা মেহের নিগার ওরফে মিতা জেলা জাতীয় মহিলা পার্টির সাবেক সভানেত্রী। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই আজমেরী ওসমানের গাড়ির বহরে সুলতান শওকতকে দেখা যায়।