আজও জানি না কে ছিল সেই উপকারী মানুষ

রওশন আরা বাচ্চু
রওশন আরা বাচ্চু

‘১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মিছিলে কাঁদানে গ্যাস ও পুলিশের গুলি করা শুরু হলে চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়। আন্দোলনকারীরা এদিক-সেদিক ছুটোছুটি শুরু করে। আমি নিচে পড়ে যাই। একসময় উঠে সেখানকার একটা হোটেলের এক কোনায় পড়ে থাকা কিছু ভাঙা রিকশার পেছনে গিয়ে লুকিয়ে থাকি। এর মধ্যে কাঁটাতারের বেড়া পার হতে গিয়ে শাড়ি আটকে যায়। কেউ একজন শাড়িটা ছাড়িয়েও দেয়। আমি আজও জানি না কে ছিল সেই উপকারী মানুষটা।’
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির আন্দোলনে অংশ নেওয়ার কথা বলতে গিয়ে এভাবেই স্মৃতিচারণা করছিলেন ভাষাসৈনিক রওশন আরা বাচ্চু। ১৯৫২ সালে পাকিস্তান সরকারের জারি করা ১৪৪ ধারা জারির বিরুদ্ধে যে দলটি প্রথম পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙে, সেই দলে ছিলেন এই ভাষাসৈনিক। সে সময় মুসলিম রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে হয়েও ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। ভাষা আন্দোলনে অংশ নেওয়ার গল্পসহ নানা বিষয় নিয়ে ২০ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।
ভাষাসৈনিক রওশন আরা বাচ্চু সর্বশেষ বিএড কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। অবসর নিয়েছেন ২০০২ সালে। এখন বয়স ৮৫ বছর। ‘বাঙালির ভাষা ও ভূখণ্ড’ শিরোনামে একটি বই লিখেছেন তিনি। ভাষা কী, কবে থেকে এ ভাষার শুরু হয়েছে এবং বাংলা ভাষার ঐতিহাসিক দিক নিয়েই মূলত বইটি লিখেছেন তিনি।
১৯৩২ সালের ১৭ ডিসেম্বর সিলেটের কুলাউড়ার উছলাপাড়ায় জন্ম রওশন আরা বাচ্চুর। বাবা এ এম আফরেফ আলী, মা মনিরুন্নেসা খাতুন। তাঁরা তিন বোন দুই ভাই। ভাইবোনদের মধ্যে বড় রওশন আরাই এখন বেঁচে আছেন।

রওশন আরা বাচ্চুর পরিবার নানাভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল। দাদা আহমদ আলী পড়াশোনা করেছিলেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের ইন্সপেক্টর জেনারেল অব রেজিস্ট্রেশনের দায়িত্বে। চাচা ছিলেন কংগ্রেস পার্টির সদস্য। মা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ না করলেও তাঁর ভেতর দেশপ্রেমের যে চেতনা ছিল, তা অভাবনীয়। তিনি বলেন, ‘আমি আমার জীবনের যা কিছু করতে পেরেছি, তার জন্য মায়ের অবদানই বেশি। যে যুগে আমি পড়াশোনা করেছি, তা যদি আমার মা না দেখতেন, তাহলে হতো না।’

রওশন আরা বাচ্চু ১৯৪৭ সালে পিরোজপুর গার্লস স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর বরিশাল বিএম কলেজ থেকে ১৯৪৮ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। কলেজে থাকাকালীন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন হন। ১৯৪৯ সালে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। সেখানে তিনিসহ আরও ৩২-৩৩ জন ছাত্রী থাকতেন।

ভাষা আন্দোলনে যোগ দেওয়া প্রসঙ্গে রওশন আরা বাচ্চু বলেন, ‘আমার পরিবার ছিল মুসলিম রক্ষণশীল পরিবার। সে সময়টা নারীদের জন্য বেশ কঠিন ছিল। আমি আমার কথাই বলি। রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে বলে নয় বছর বয়স থেকেই বাড়ির বাইরে যেতে দেওয়া হতো না। আমাদের বাড়ির পুকুরটা ছিল বাড়ির বাইরে। নয় বছর বয়সের পর থেকে সেখানে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হতো না। আর মুসলমান সমাজও সে সময় এত অগ্রসর ছিল না। এ কারণে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় আমাকে শিলংয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হলো।’

রওশন আরা বাচ্চু বলেন, শিলংয়ে তিনি ক্লাস ফোর পর্যন্ত লাবান প্রাইমারি স্কুলে পড়েন। প্রাথমিকে পাস করার পর লেডি কিন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভর্তি করানো হয় তাঁকে। কিন স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে শিলংয়ে বোমাবর্ষণ হচ্ছিল। তখন তাঁর বাবা চাকরি করতেন পিরোজপুরে। তাই সে সময় তাঁকে বাবার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এরপর পিরোজপুর ও বরিশালে পড়ালেখা করার পর ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে দর্শন বিভাগে ভর্তি হন। তখন অনার্স ক্লাসে তিনজন ছাত্র আর তিনজন ছাত্রী ছিল। তবে সাবসিডিয়ারি ক্লাসে অনেক শিক্ষার্থী ছিল।

রওশন আর বাচ্চু। ছবি ১৯৪৯ সালের। পারিবারিক অ্যালবাম থেকে সংগ্রহ করা

রওশন আরা বাচ্চু বলেন, ‘মেয়েদের রাজনীতিতে যুক্ত হওয়াও কঠিন ব্যাপার ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল নয়, সব জায়গায়ই এ অবস্থা ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম ঠিকই, তবে ছেলেদের সঙ্গে কথা বলতে পারতাম না—এমন কড়াকড়ি ছিল। কথা বললে ১০ টাকা জরিমানা। ক্লাস শুরুর আগে মেয়েদের কমন রুমে বসে থাকতে হতো। শিক্ষক ক্লাসে ডেকে নিয়ে যেতেন। ক্লাসে মেয়েদের বসানো হতো প্রথম বেঞ্চে। ছেলেদের পেছনে। ক্লাস শেষে মেয়েদের আবার কমনরুমে পৌঁছে দিতেন শিক্ষক। তবে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির পর এই কালাকানুন আর টেকেনি।’
ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গে রওশন আরা বাচ্চু বলেন, ‘আন্দোলন-সংগ্রামেও ছেলেদের সঙ্গে কাজ করা যেত না। আন্দোলনের জন্য পোস্টার লেখা, আঠা বানানোর কাজ—এগুলো মেয়েরা করে দিত। খবরের কাগজের মধ্যে আলতা দিয়ে এবং কাঠির মাথায় তুলা বেঁধে তুলি বানিয়ে লিখতাম।’
রওশন আরা বাচ্চুর ভাষ্য, তাঁর বন্ধু নুরুন্নাহার কবীর দ্রুত পোস্টার লিখতে পারতেন। আন্দোলনের জন্য প্রয়োজনীয় চাঁদা সংগ্রহ ও পোস্টার লেখাসহ অন্য কাজগুলো তাঁরা করতেন। এসব কাজ করতে গিয়েও তাঁরা ছাত্রদের সঙ্গে সরাসরি কাজ করতে পারেননি। তারপরও তাঁরা আন্দোলন সংগঠিত করার কাজ করেছিলেন। আন্দোলন করতে বেশি ছাত্রছাত্রী লাগবে। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কটি বিভাগে ৬০-৭০ জনের বেশি ছাত্রী ছিল না। তাই তাঁদের ওপর ভার ছিল ছাত্রী সংগ্রহ করা। তাঁরা দলে দলে ভাগ হয়ে বিভিন্ন স্কুল-কলেজে গিয়ে বুঝিয়ে আন্দোলনের জন্য ছাত্রী সংগ্রহ করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার সভায় ওই ছাত্রীদের আসতে বলতেন।
রওশন আরা আরও বলেন, ‘আমরা ভাষার বিষয়ে একটা জাতীয় ঐক্য তৈরি করতে চেয়েছি। জাতীয় ঐক্য না থাকলে কোনো আন্দোলন-সংগ্রাম সফল হতে পারে না। যত দূর পারি ওদের বোঝাতাম। মেয়েদের এসব বিষয়ে আগ্রহ তৈরি হতো। তাঁরা আন্দোলনে যোগ দিতে আসত।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই রওশন আরা ‘প্রগ্রেসিভ ফ্রন্টে’ যোগ দেন। হলে নির্বাচনে সদস্য হন তিনি। এ কারণে আন্দোলনে যুক্ত হওয়াটা তাঁর জন্য সহজ হয়ে যায়। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বেতন বৃদ্ধির প্রতিবাদে ‘নো ফি ক্যাম্পেইন’ এবং শিক্ষা খাতে সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে প্রাদেশিক ছাত্র কনভেনশনে যোগ দেন ছাত্রীরা। রক্ষণশীল পরিবেশেও ছাত্রীদের মধ্যে আন্দোলনের চেতনা গড়ে ওঠে সে সময়। পরে ‘উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা’ করার ঘোষণা দেওয়া হলে ছাত্রীরা যুক্ত হয়ে যান।

রওশন আরা আরও বলেন, ‘১৯৫২ সালে পাকিস্তান সরকারের জারি করা ১৪৪ ধারা জারির বিরুদ্ধে আমার দলটিই প্রথম পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙে। ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে ছাত্রীরা ১০ জন করে ছোট দলে ভাগ হয়ে বিভিন্ন স্কুল-কলেজ থেকে ছাত্রীদের সংগঠিত করে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় নিয়ে আসে। এরই মধ্যে ১৪৪ ধারা ভাঙার প্রশ্নে বিতর্ক ওঠে। মোজাফফর আহমেদ, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌, ফিজিক্যাল ইনস্ট্রাক্টর মতিউর রহমানের মতো শিক্ষকেরা পুলিশের হামলায় ছাত্রছাত্রীদের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা করে ছাত্রীদের চলে যেতে বলেন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা বিনয়ের সঙ্গে তা উপেক্ষা করে। শিক্ষার্থী অলি আহাদ ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে দৃঢ় থাকেন। কিন্তু আবুল হাশিম বলেন, এখনই ১৪৪ ধারা না ভেঙে প্রশাসনিকভাবে সমাধান করা হবে। এসব বিতর্কের কারণে আমি ও অপর আন্দোলনকর্মী শাফিয়া সভা বয়কট করে মেয়েদের কমন রুমে চলে যাই। আমরা ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে ছিলাম। এরপর ছাত্রদের অনুরোধে আবার ফিরে এসে ছোট ছোট দলে মিছিলের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে পুলিশ লাঠি দিয়ে ব্যারিকেড দেয়। ছেলেদের দল বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ তাদের গাড়িতে তুলে নেয়। এরপর মেয়েদের দলগুলো বের হওয়ার চেষ্টা করে। অনেকে ব্যারিকেডের নিচে দিয়ে চলে যায় কিন্তু আমি ব্যারিকেড ভেঙেই যাই। আমাদের এগিয়ে যাওয়া দেখে অনেক ছেলেমেয়েও তখন যোগ দেয়। সবাইকে নিয়ে একটি মিছিল বের হয়। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেলের কাছে যেতেই পুলিশ লাঠিপেটা ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। অন্ধকার হয়ে যায় পুরো এলাকা। শুরু হয় পুলিশের গুলি। আন্দোলনকারীরা এদিক-ওদিক ছুটোছুটি শুরু করে। আমি নিচে পড়ে যাই। একসময় উঠে সেখানকার একটি হোটেলের এক কোনায় পড়ে থাকা কিছু ভাঙা রিকশার পেছনে গিয়ে লুকিয়ে থাকি। এর মধ্যে কাঁটাতারের বেড়া পার হতে গিয়ে শাড়ি আটকে যায়। কেউ একজন শাড়িটা ছাড়িয়েও দেয়। আমি আজও জানি না কে ছিল সেই উপকারী মানুষটা। এরপর অ্যানেক্সে এসএম হলের প্রভোস্ট ওসমান গণির বাসভবনে গিয়ে আশ্রয় নিই। সেখানে খবর আসে সালাম, বরকত, জব্বার শহীদ হয়েছে। আরও শুনতে পাই বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেশিয়ামের কাছে ওহিউর রহমান নামের ১২-১৪ বছরের একটি ছেলেও পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে। বিকেলে হোস্টেলের সামনের পথ দিয়ে মুনীর চৌধুরীর বিষণ্ন মনে হেঁটে যাওয়া দেখেছি। তিনি (মুনীর চৌধুরী) পরে আমাদের হোস্টেলে পৌঁছে দেন।’

এরপর ২২ ফেব্রুয়ারির গায়েবানা জানাজা, শোক মিছিল ও ২৩ ফেব্রুয়ারির হরতালসহ প্রতিটি কর্মসূচিতে রওশন আরা বাচ্চু সোচ্চার ভূমিকা পালন করেন।