দেশের মানুষের মধ্যে টিকা নেওয়ার আগ্রহ বেড়ে গেছে। বয়স্কদের অনেকেই এখন টিকাদানকেন্দ্রগুলোতে ভিড় করে টিকা নিচ্ছেন। ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশব্যাপী করোনার টিকা দেওয়া কার্যক্রম শুরু হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুসারে, গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৪৫১ জন টিকা নিয়েছেন। ঢাকা মহানগর এলাকায় ৪৬টি টিকাদানকেন্দ্রে গত ২৪ ঘণ্টায় টিকা নিয়েছেন ১৯ হাজার ১১৫ জন।
রাজধানীর মহাখালীতে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে সহযোগী অধ্যাপক মোস্তফা কামাল বুধবার তাঁর মাকে নিয়ে এসেছিলেন ওই হাসপাতালের টিকাদানকেন্দ্রে। মা আসমা খাতুনের বয়স ৭০ বছর। তাঁর ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। সকাল সোয়া ৯টার দিকে টিকা দিয়ে দোতলা থেকে নামার পর প্রথম আলোর সঙ্গে কথা হয় মোস্তফা কামালের। তিনি বলেন, ‘মায়ের ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ সমস্যা থাকলেও তা নিয়ন্ত্রণে আছে। তাই টিকা দিতে নিয়ে এসেছি।’ ৩ ফেব্রুয়ারি সুরক্ষা অ্যাপে নিবন্ধন করার পর আজ টিকা দেওয়ার তারিখ পান তিনি। মোস্তফা কামাল নিজে টিকা নিয়েছেন ৮ ফেব্রুয়ারি।
বলা হচ্ছিল টিকা নিতে লোক আসবে না। এখন দেখা যাচ্ছে বিপুলসংখ্যক লোক আসছে। সামনে আরও আসবেমোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন,সভাপতি ,বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) কনভেনশন সেন্টারে হুইলচেয়ারে করে টিকা নিতে আসেন সাবেক সাংসদ (সিলেট-৬ আসন) সৈয়দ মকবুল হোসেন। দুবারের এই সাংসদ প্রথম আলোকে বলেন, অ্যাপে নিবন্ধন করার পর আজ টিকা দেওয়ার তারিখ পেয়েছেন। তাই টিকা নিতে এসেছেন।
বিএসএমএমইউর তথ্য অনুযায়ী, আজ সকাল ৮টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত ১ হাজার ৮৩৭ জনকে টিকা দেওয়া হয়েছে।
একই সেন্টারে টিকা নিতে আসেন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আবদুর রহমান সরকার। তিনি রাজধানীর গ্রিন রোডের বাসিন্দা। আবদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। তবে নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ২০০৮ সালে হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। এখন নিয়মিত চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে রয়েছেন। নভেম্বরে করোনায় আক্রান্ত হয়ে তিনি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। এখন তিনি টিকা নিতে এসেছেন।
বুধবার সকাল ৯টা থেকে বেলা একটা পর্যন্ত জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, বিএসএমএমইউ কনভেনশন সেন্টার এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাঁচটি টিকাদানকেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, সেখানে বয়স্করা টিকা নিচ্ছেন। শারীরিক সমস্যা থাকলেও চিকিৎসকের পরামর্শ অনুসারে টিকা নিতে এসেছেন অনেকেই। টিকাদানকেন্দ্রগুলোতে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের ভিড় বেশি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় রাজধানীর পাঁচটি টিকাদানকেন্দ্রে ৩ হাজার ৭৫৪ জন টিকা নিয়েছেন।
অনেকই মা–বাবা বা পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের নিয়ে এসেছেন টিকাদানকেন্দ্রে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় ওই পাঁচটি টিকাদানকেন্দ্রে ৩ হাজার ৭৫৪ জন টিকা নিয়েছেন। বিএসএমএমইউর অধ্যাপক সৈয়দ মোজাফফর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আরও বেশিসংখ্যক মানুষ টিকা নিতে আসবে। সেটা মাথায় রেখে আমাদের সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে।’
গত বছরের ঈদুল ফিতরের সময় হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল আবদুস সালাম বিশ্বাসের (৫৬)। এখন চলাফেরা করতে হয় লাঠিতে ভর করে। মহাখালী বাজার এলাকার বাসিন্দা আবদুস সালাম ও তাঁর স্ত্রী মজিউন্নেসা বেগম (৫০) টিকা নিতে আসেন শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের টিকাদানকেন্দ্রে। তাঁর ছেলে মাসুদ রায়হান বলেন, ‘চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলেই বাবাকে নিয়ে এসেছি।’
বিএসএমএমইউ কনভেনশন সেন্টারে উপস্থিত বিএসএমএমইউর উপপরিচালক খোরশেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ধরনের অসুস্থতায় টিকা নিতে কোনো সমস্যা নেই। আমি নিজেও ৭ ফেব্রুয়ারি শুরুর দিন টিকা নিয়েছি।’
বাড্ডার বাসিন্দা নাবিল আমির (৪০) মা ও তাঁর শাশুড়িকে নিয়ে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে টিকা দিতে এসেছিলেন শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে। নিবন্ধন ফরম দেখানোর পর ১০টার দিকে তাঁরা টিকা দেওয়ার সারিতে দাঁড়ান। একজন স্বেচ্ছাসেবক বলেন, সেখানে অ্যাপের মাধ্যমে ৪৭৪ জন নিবন্ধন করেছেন। এর মধ্যে সকাল ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত ২৯ জনের নাম টিকা নেওয়ার তালিকায় উঠেছে।
জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে বারিধারার বাসিন্দা নুরুল আবেদিন (৭৪) ও কানিজ রসুল (৭১) দম্পতি এসেছিলেন টিকা নিতে। প্রথম আলোকে তাঁরা বলেন, অ্যাপের মাধ্যমে নিবন্ধন করেছেন তাঁরা।
ওই টিকাদানকেন্দ্রের জ্যেষ্ঠ স্টাফ নার্স সানজিদা আফরিন বলেন, ‘অ্যাপ ছাড়া সেখানে তাৎক্ষণিক নিবন্ধনের সুযোগ নেই। আজ ১০০ জনের মতো টিকা দেওয়ার জন্য নিবন্ধন করেছেন। সকাল ৮টা থেকে সোয়া ৯টা পর্যন্ত ৩২ জন টিকা দিয়েছেন।’
জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অভ্যর্থনাকারী মো. আরিফ হোসেন নিবন্ধন করা ব্যক্তিদের নাম টিকা দেওয়ার চূড়ান্ত তালিকায় তুলছিলেন। তিনি বলেন, ‘তিনতলায় নিবন্ধনের কাগজ জমা দেওয়ার পর নিচতলায় তাঁরা একটি খাতায় নাম তুলে টোকেন দিচ্ছেন টিকা নেওয়ার জন্য। সকাল সাড়ে ৯টা পর্যন্ত ৩০ জনের নাম তোলা হয়েছে।’
গত সোমবার টিকার জন্য সুরক্ষা অ্যাপে ফরম পূরণ করেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ঈশানী চক্রবর্তী। তিনি উত্তর আমেরিকা যাচ্ছেন। কিন্তু এসএমএস পাননি। তবে অপেক্ষা না করে টিকা নিতে আসেন বিএসএমএমইউ কনভেনশন সেন্টারে।
মানবেন্দ্র চক্রবর্তী (৬৬) ও রীতা চক্রবর্তীও (৫২) ফিরতি বার্তা না পেয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের টিকাদান কেন্দ্রে চলে আসেন। টিকা নিয়ে যাওয়ার সময় তাঁদের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। গেন্ডারিয়ার বাসিন্দা মানবেন্দ্র চক্রবর্তী বলেন, ২ ফেব্রুয়ারি তাঁরা ফরম পূরণ করেন। এখন পর্যন্ত কোনো ফিরতি এসএমএস পাননি।
গতকাল তাঁর ছোট ভাই এ কেন্দ্রে টিকা নিতে এসে টিকাদান কর্মীদের কাছে বিষয়টি বলেন। কর্মীরা খুদে বার্তা ছাড়াই চলে আসতে বললে আজ তাঁরা এসে টিকা দিয়েছেন।
দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত হাসপাতালটিতে তাৎক্ষণিক নিবন্ধনসহ (৩৭টি) মোট ৭৮৩টি নাম নিবন্ধনভুক্ত হয়েছে। গতকাল ৭৮০ জনের মতো টিকা নিয়েছেন। এ তথ্য দেন হাসপাতালের জ্যেষ্ঠ স্টাফ নার্স রেজাউল করিম।
ইংরেজি সংবাদপত্র দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম আজ দুপুর পৌনে ১২টার দিকে বিএসএমএমইউ কনভেনশন সেন্টারে টিকা নেন। টিকা দেওয়ার পর তাঁর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন। মাহফুজ আনাম বলেন, ‘অ্যাপের মাধ্যমে নিবন্ধন করেছিলাম। খুব সংহত ও সুন্দরভাবে টিকা কার্যক্রম চলেছে। আমি সরকারি সেবা এত দ্রুততার সঙ্গে পেতে অভ্যস্ত নই। কিন্তু এ ব্যাপারে পাচ্ছি। সুপরিকল্পিত ও সুন্দরভাবে সবকিছু পরিচালিত হচ্ছে। ই-প্ল্যাটফর্মে ফরম পূরণ করা ও জবাব আসার বিষয়টিও আমাদের জন্য নতুন। টিকার জন্য একটি ডিজিটাল অবকাঠামো দাঁড় করানো হয়েছে।’
সামনের দিনগুলোতে টিকা নিতে আসা মানুষের সংখ্যা বাড়লে টিকা দিতে সক্ষমতা বাড়াতে হবে বলে মনে করেন মাহফুজ আনাম। তিনি বলেন, টিকা নেওয়ার পর তাঁকে আধঘণ্টা পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছিল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় কি না জানার জন্য।
বিএসএমএমইউ কনভেনশন সেন্টার পরিদর্শনে এসে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বলা হচ্ছিল টিকা নিতে লোক আসবে না। এখন দেখা যাচ্ছে বিপুলসংখ্যক লোক আসছে। সামনে আরও আসবে।’