আগের অপরাধগুলো বিবেচনায় নিলে এমন ঘটনা ঘটত না

সাভারে শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মির্জা তাসলিমা সুলতানা। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক (সাভার) শামসুজ্জামান

তাসলিমা সুলতানা
প্রশ্ন

ছাত্র হয়ে শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যার বিষয়টি আমাদের কী ধরনের বার্তা দিচ্ছে?

মির্জা তাসলিমা সুলতানা: শিক্ষকদের যে হেনস্তা করা যায়, সাম্প্রতিক বাংলাদেশে এটি একটি স্বাভাবিক ঘটনা। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে শিক্ষকদের লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এখন স্কুল-কলেজ পর্যায়েও এসব হচ্ছে। শিক্ষক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নতুন করে কোনো বার্তা দিচ্ছে না। বার্তা ছিল ও বার্তা আছে। এসব যদি এভাবে চলতে থাকে, রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের সরকার যদি এই পদ্ধতিতে গণতান্ত্রিক সংগঠনগুলোকে ধ্বংস করে—এমন ঘটনা আরও ঘটবে, পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।

প্রশ্ন

কিশোর অপরাধের দায়টা কার বলে মনে করেন?

মির্জা তাসলিমা সুলতানা: আমরা একটি রাষ্ট্রব্যবস্থায় আছি। আমি প্রথমত সবকিছুর দায় দেব রাষ্ট্রকে। কারণ, রাষ্ট্রের একটি পরিকল্পনা থাকা উচিত। তবে রাষ্ট্র সবকিছু একা করবে না, একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রব্যবস্থা থাকলে রাষ্ট্রের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো সঠিকভাবে কাজ করবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে কিশোর গ্যাংয়ের মতো অপরাধী চক্র গড়ে উঠবে না। রাষ্ট্রের সঠিক নিয়ন্ত্রণ ও সঠিক পরিকল্পনা থাকলে এগুলো গড়ে ওঠে না।

প্রশ্ন

সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গায় আমরা কি এ ধরনের ঘটনা রোধে ভূমিকা রাখতে পারছি?

মির্জা তাসলিমা সুলতানা: সমাজ কিন্তু এখন একা একা চলে না। এটা আমাদের প্রবণতা, আমরা রাষ্ট্রের দায়কে সমাজের দিকে ফেরাতে চাই। রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোকে অপরাধীরা তাদের অভয়ারণ্য হিসেবে ব্যবহার করছে। এগুলো তো বাচ্চাদের চোখে পড়ছে। বাচ্চারা এগুলো দেখে উৎসাহিত হচ্ছে। তারা গ্যাং তৈরি করে থাকছে, যাদের অনেককেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়। গণমাধ্যমের সংবাদ অনুযায়ী, যে শিক্ষার্থী পিটিয়ে শিক্ষককে হত্যা করেছে, সে নিজেই একটা উদাহরণ। এর আগেও সে অপরাধ করে পার পেয়েছে।

প্রশ্ন

এ ধরনের অপরাধে পারিবারিক দায় কতটুকু বলে মনে করছেন?

মির্জা তাসলিমা সুলতানা: অনেক সময় আমরা বলে থাকি, সন্তানের অপরাধের জন্য পিতা–মাতা দায়ী, এটা আমি ঠিক মনে করি না। কারণ, অপরাধী তো পরিবারে গড়ে ওঠে না। এই যেমন কিশোর গ্যাং, তার তো আসলে গ্যাং আছে। গণমাধ্যমের সংবাদ অনুযায়ী, যে ছেলে শিক্ষককে হত্যা করেছে, তার সমবয়সী কিশোরেরা তাকে দাদা বলে ডাকে। এর মানেই হচ্ছে সে একটা নেতৃত্ব অর্জন করেছে কিশোর অবস্থাতেই এবং সেটি হচ্ছে গ্যাংয়ের নেতৃত্ব। এতে প্রমাণিত হয়, ওই এলাকায় এ ধরনের কর্মকাণ্ডের পৃষ্ঠপোষক আছে এবং সে নিশ্চিত ছিল যে এ ধরনের কাজ করে সে পার পেয়ে যেতে পারে। না হলে দিবালোকে শিক্ষককে এভাবে পেটানোর ক্ষমতা তার হতো না। এর আগেও সে অপরাধ করেছে। তখন যদি সে অপরাধগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে সঠিকভাবে পদক্ষেপ নেওয়া হতো, তাহলে হয়তো এ ধরনের ঘটনা ঘটত না।

প্রশ্ন

শিক্ষক হত্যার ঘটনায় ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কি তাদের দায় এড়াতে পারে?

মির্জা তাসলিমা সুলতানা: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এ ধরনের ঘটনা রোধে কাজ করতে পারছে না। কারণ, রাষ্ট্রের কোনো সহযোগিতা নেই। এ ধরনের ঘটনা যদি আরও ঘটে, তাহলে শিক্ষকেরা তো আর কাউকে শাসন করতে যাবেন না। কারণ, তাঁরা নিজের নিরাপত্তা আগে নিশ্চিত করতে চাইবেন।

প্রশ্ন

অনেকে বলছেন, শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণে শাসন করায় এ ঘটনা ঘটিয়েছে সে। শিক্ষকের শাসন কেন মানতে পারছে না এ ধরনের শিক্ষার্থীরা?

মির্জা তাসলিমা সুলতানা: আমাদের রাষ্ট্র তো এখন ভীষণভাবে পৌরুষের ওপর চেপে বসেছে। পৌরুষের সঙ্গে ওই ক্ষমতার সম্পর্ক। এগুলো যখন বাড়ে, তখন রাষ্ট্রের মধ্যে এমন কিছু উপাদান আছে এবং এমন অবস্থা জারি আছে, সেগুলো এই অপরাধগুলোকে বাড়তে সাহায্য করে।

প্রশ্ন

কিশোরদের মধ্যে শ্রদ্ধাবোধ ও নৈতিকতা ফিরিয়ে আনতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে?

মির্জা তাসলিমা সুলতানা: কিশোরেরা যে অপরাধী চক্র হয়ে উঠতে পারে, সেটি নিয়ে জোরালো কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। শুধু সংশোধনাগারে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের নিয়ে গেলেই যে সমস্যার সমাধান হবে, এমনটি নয়। কেবল একটি প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা দিয়ে চূড়ান্তভাবে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এর জন্য রাষ্ট্রের পরিকল্পনা প্রয়োজন। কিন্তু রাষ্ট্রে যারা ক্ষমতা চর্চা করতে পারে, দেখাতে পারে, হম্বিতম্বি দেখাতে পারে, তাদেরই তো সম্পূর্ণ রাষ্ট্র পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে।

কঠোর পদক্ষেপ নিলে অপরাধ কমে যাবে, বিষয়টি এমন নয়। ওই শিক্ষার্থীর কাউন্সেলিংয়ের দরকার ছিল এবং তার পরিবারকে জানানো উচিত ছিল। স্কুলগুলোতে কাউন্সেলর বা মনোরোগ চিকিৎসক থাকেন না। রাষ্ট্রকেই এটা ভাবতে হবে। থানা-পুলিশকে তো অন্য অপরাধীদের সঙ্গে কিশোর অপরাধীদের মেলালে হবে না। তাদের সংশোধনের জন্য পুলিশকে এ-সংক্রান্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

মির্জা তাসলিমা সুলতানা: আপনাকেও ধন্যবাদ।