বাংলাদেশের সংসদীয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হোক এবং গণতান্ত্রিক সব দল তাতে অংশ নিক, এটাই ভারত দেখতে চায়। ভারত একেবারেই চায় না, আগেরবারের মতো এবারের নির্বাচন কোনোভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হোক।
আসন্ন ভোট নিয়ে বাংলাদেশের সর্বস্তরে উৎসাহ-উদ্দীপনা ও অংশগ্রহণে রাজনৈতিক দলগুলোর আগ্রহ ভারত লক্ষ করছে। ভারতের উৎফুল্ল হওয়ার এটা অন্যতম প্রধান কারণ। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা সম্প্রতি সে কথা জানিয়েছেনও। বলেছেন, সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হতে যাচ্ছে দেখে ভারত আনন্দিত। আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য না করলেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মনে করছে, সংবিধান অনুযায়ী ঠিক সময়েই ভোট হবে এবং সেই ভোট হবে অংশগ্রহণমূলক। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ধারা অব্যাহত থাকবে।
তবে মনোনয়ন ফরম কেনা নিয়ে পুলিশের সঙ্গে বিরোধী দলের সমর্থকদের সাম্প্রতিক সংঘর্ষের ঘটনা ভারতকে কিছুটা চিন্তায় ফেলেছে। ভারত মনে করে, এই ঘটনা অনভিপ্রেত। ভারত চায় না, নির্বাচন ঘিরে হিংসা মাথাচাড়া দিক। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র এ প্রসঙ্গে বলেছে, হিংসা ছড়ালে তাদেরই সুবিধা হয়, যারা গণতন্ত্রকে মানতে চায় না। সূত্রের কথায়, এটা যেমন সত্যি, তেমনি এটাও বোঝা যাচ্ছে, ভোটে অংশ নিতে মানুষ কত ব্যগ্র। সংঘর্ষের ঘটনা সেই তাগিদেরই প্রতিফলন।
বাংলাদেশের প্রতিটি নির্বাচন যিনি সব সময় গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে আসছেন, ভারতের সেই সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মুচকুন্দ দুবে এই হিংসাকে খুব বেশি গুরুত্ব দিতে অবশ্য রাজি নন। গতকাল শুক্রবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সহিংসতা সমর্থনীয় নয়। তবে আমাদের দেশের মতো পশ্চিমা দেশেও ভোটকে কেন্দ্র করে হিংসা ছড়ায়। ২০১৪ সালের ভোটের আগে-পরে যে ধরনের সহিংসতা দেখা গিয়েছিল, এবারের ঘটনা তার সঙ্গে তুলনীয় নয়। পরিকল্পিতও নয় বলে আমার ধারণা।’ দুবে বলেন, ‘একটা বিষয় মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশের মানুষের কাছে ভোট একটা উৎসবের মতো। সামরিক শাসনের সময়ও সেই উৎসব দেখা গেছে, গণতান্ত্রিক শাসনের সময়ও। আমি আশা করব, প্রশাসন এই বিষয়টি মনে রাখবে এবং হিংসা যাতে না ছড়ায়, সে জন্য সজাগ থাকবে।’
মুচকুন্দ দুবের মতো দেব মুখার্জিও বাংলাদেশে ভারতের হাইকমিশনার ছিলেন। এবারের নির্বাচনকে তাঁরা দুজনেই যথেষ্ট ইতিবাচক বলে মনে করছেন। দেব মুখার্জি প্রথম আলোকে বলেন, এবার সরকারের মনোভাব যেমন ইতিবাচক, বিরোধী দলগুলোর মনোভাবও তেমন। আগেরবার এই ইতিবাচক অবস্থান দেখা যায়নি। মনোভাবের ক্ষেত্রে এটা একটা বড় পরিবর্তন। সেই পরিবর্তনই এবার সবাইকে নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী ও উৎসাহী করে তুলেছে। মুচকুন্দ দুবে ইতিবাচক বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘এবার শুরু থেকেই সব মহল ঠিক দিকে এগিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নমনীয় হয়েছেন। বিরোধী জোটের নেতাদের সঙ্গে তিনি সংলাপে বসেছেন। বিরোধীরাও ভোটে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নির্বাচন কমিশনও বিরোধী জোটের দাবি মেনে ভোট গ্রহণের দিন পিছিয়েছে। এবার কোনো পক্ষই আগের বারের মতো ঋজু নয়। ফলে আশা করা যেতেই পারে, এবারের ভোট সুষ্ঠু ও অবাধ হবে। শান্তিতে হবে। ভোট লুট হবে না।’ দুই সাবেক হাইকমিশনার বলেন, এবার ভোটের পর যারাই সরকার গড়ুক, সেই সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না।
ভারত মনে করছে, ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্র মজবুত হচ্ছে এবং সেটাই সবচেয়ে ইতিবাচক দিক। হর্ষ বর্ধন শ্রিংলাও এই কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের পাশে বসে সম্প্রতি তিনি বলেন, ‘প্রতিবেশীদের গুরুত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের তালিকায় বাংলাদেশ শীর্ষে রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নে বাংলাদেশকে পাশে নিয়েই ভারত এগোতে চায়।’ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সূত্রের কথায়, এই লক্ষ্য পূরণের জন্য বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতার শক্তিসঞ্চয় যেমন জরুরি, তেমনই প্রয়োজন গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল শক্তির বিকাশ। ভারত মনে করছে, এবারের নির্বাচন সেই লক্ষ্যে আরও কয়েক কদম এগিয়ে যাবে।
ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনের সেন্টার ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজির ডিরেক্টর অলোক বনসল এই নির্বাচনকে পর্যবেক্ষণ করছেন উপমহাদেশের সার্বিক উন্নয়নের পরিপ্রেক্ষিতে। গতকাল প্রথম আলোকে তিনি বলেন, এই উপমহাদেশের ভাগ্য নির্ভর করছে একের সঙ্গে অন্যের সহযোগিতার ওপর। সহযোগিতা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য যেমন প্রয়োজন, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ সন্ত্রাসবাদী ও ধর্মীয় মৌলবাদী অপশক্তির মোকাবিলায়। বনসলের কথায়, বাংলাদেশে যে দল বা জোট ক্ষমতায় আসুক, ভারত চাইবে তারা এই অপশক্তিকে মোকাবিলা করে দেশের উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করুক। তিনি বলেন, গত পাঁচ বছরে বিরোধীহীন সংসদ বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে মজবুত করেনি। সুখের কথা, ওই দেশের বিরোধীরা তা উপলব্ধি করেছে। এবার নতুন জোটবদ্ধতা দেখা যাচ্ছে। সেই জোট নতুন বিরোধী নেতৃত্বের জন্ম দেয় কি না, এবারের ভোট সেই আগ্রহেরও জন্ম দিয়েছে।