উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে কেজিতে ৩ থেকে ৪ টাকা। বাড়তি উৎপাদনের ফলে দাম কমলেও কৃষকের তেমন একটা লাভ হয়নি।
দেশের কৃষকেরা এ বছর আগাম বা কন্দ পেঁয়াজের উৎপাদন ২ লাখ টন বাড়িয়েছেন। এ মৌসুমে উৎপাদিত হয়েছে প্রায় সাড়ে ৬ লাখ টন পেঁয়াজ। বাড়তি উৎপাদনের কারণে বাজারে দেশি পেঁয়াজের সরবরাহ ভালো। আমদানিও কমেছে।
কন্দ পেঁয়াজ বাজারে মুড়িকাটা নামে পরিচিতি। প্রতিবছর ডিসেম্বর থেকে মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত মুড়িকাটার মৌসুম চলে। এ বছর এই পেঁয়াজ উৎপাদনে কৃষকের ব্যয় কেজিতে ৩ থেকে ৪ টাকার মতো বেড়েছে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের হিসাবে, এ বছর প্রতি কেজি মুড়িকাটা পেঁয়াজ উৎপাদনে ১৯ টাকা ২০ পয়সা ব্যয় হয়েছে।
কৃষকেরা বলছেন, এই বাড়তি খরচের কারণ গত মৌসুমে পেঁয়াজের দাম অত্যধিক বেশি ছিল। মুড়িকাটা পেঁয়াজ উৎপাদন করা হয় ছোট ছোট পেঁয়াজ রোপণ করে, যা কিনতে কৃষককে অনেক বেশি ব্যয় করতে হয়েছে। এর ওপর পরিচর্যার ব্যয় তো আছেই।
ফরিদপুরের বুরাইছ ইউনিয়নের শৈলমারি কৃষক সমিতি (সিআইজি ক্লাব) সভাপতি কাজী সামসুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এবার পেঁয়াজের আবাদ বেশ বেড়েছে। হাটে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৩০ টাকা করে বিক্রি করা যায়। তবে খরচ বেশি হওয়ায় লাভ কম।
এদিকে কৃষকেরা উৎপাদন বাড়ানোয় আমদানি কমছে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর থেকে চলতি সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়া নিয়ে একটি প্রতিবেদন দেওয়া হয়। এতে দেখা যায়, নভেম্বরে ৪৬ হাজার টন পেঁয়াজ এসেছিল। জানুয়ারিতে তা ২৫ হাজার টনে নেমে আসে। নভেম্বরে যে পেঁয়াজ গড়ে প্রতি কেজি ৭২ টাকা ছিল, তা জানুয়ারিতে কমে ৩৭ টাকায় নামে।
বাড়তি উৎপাদন ও ভারত রপ্তানি খুলে দেওয়ায় গত জানুয়ারির শুরুতে বাজারে পেঁয়াজের দাম বেশ কমে গিয়েছিল। তখন সরকার আমদানিতে ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। এরপর থেকে পেঁয়াজের দাম মোটামুটি ৩৫ থেকে ৪৫ টাকা কেজির মধ্যে ছিল। ভারত রপ্তানি খুলে দিলেও আমদানি তেমন একটা হয়নি।
বাজারে গত কয়েক দিনে দাম কেজিতে ১০ টাকার মতো বেড়েছে। প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪৫ টাকার আশপাশে। রাজধানীর সুপারশপগুলোতে তা ৪৫ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। এই মূল্যবৃদ্ধির কারণও তুলে ধরা হয় কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে। বলা হয়, এবার বৃষ্টির কারণে বীজ থেকে উৎপাদিত হালি পেঁয়াজ রোপণে ১৫ দিন দেরি হয়েছে। এর ফলে তা বাজারে আসতে কিছু সময় লাগছে। সাধারণ মার্চের শুরুতে এই পেঁয়াজ বাজারে আসে।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইউসুফ প্রথম আলোকে বলেন, মুড়িকাটা পেঁয়াজ এখন শেষের দিকে। নতুন পেঁয়াজ বাজারে আসা শুরু করেছে। ফলে সামনে দাম কমবে।
দেশে পেঁয়াজের কোনো সংকট নেই। ফলে আমদানিরও দরকার নেই।অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম, কৃষি অর্থনীতিবিদ
বাজারে দাম ভালো থাকায় হালি পেঁয়াজ পরিণত হওয়ার আগেই কৃষকেরা খেত থেকে তুলে সরবরাহ শুরু করেছেন। পুরান ঢাকার পাইকারি ব্যবসাকেন্দ্র শ্যামবাজারের নবীন ট্রেডার্সের মালিক নারায়ণ চন্দ্র সাহা প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন হাট থেকে ফড়িয়ারা হালি পেঁয়াজ নিয়ে আসছেন। এতে দাম কমছে। তিন দিন আগে মণপ্রতি দর ১ হাজার ৪০০ টাকা ছিল, গতকাল ১ হাজার ২০০ টাকায় নেমেছে।
নারায়ণ চন্দ্র সাহা আরও বলেন, শ্যামবাজারে গতকাল ভারতীয় পেঁয়াজ প্রতি কেজি ৩৫ টাকার আশপাশে এবং হালি পেঁয়াজ ৩২-৩৩ টাকা দরে বিক্রি হয়।
পেঁয়াজের দাম হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় ব্যবসায়ীদের একটি অংশ পেঁয়াজ আমদানিতে শুল্ক তুলে নেওয়ার দাবি জানিয়েছিল। গত রোববার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অনুষ্ঠিত আন্তমন্ত্রণালয় সভায় বিষয়টি উত্থাপন করা হয়। কিন্তু কৃষি মন্ত্রণালয়ের আপত্তিতে শুল্ক কমানোর পথে হাঁটেনি সরকার। মন্ত্রণালয় আশা করছে, চলতি বছর পেঁয়াজের উৎপাদন প্রায় ৩০ লাখ টন হবে, যা সাধারণত ২৩-২৪ লাখ টনের মধ্যে থাকে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে ‘বাংলাদেশ চাল, আলু ও পেঁয়াজের প্রাপ্যতা ও দামের অস্থিরতা একটি আন্তপ্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা প্রতিবেদন-২০২০’ গত ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশ করা হয়। এতে দেখা যায়, বাংলাদেশে গত ১০ বছরে পেঁয়াজের আবাদ, উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা প্রায় ৬০ শতাংশ বেড়েছে।
গবেষণা দলটির সমন্বয়ক কৃষি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, দেশে পেঁয়াজের কোনো সংকট নেই। ফলে আমদানিরও দরকার নেই।