প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর কল্যাণে তাঁর সরকারের পদক্ষেপগুলো তুলে ধরে বলেছেন, সরকার আগামী বাজেট থেকে দেশের সব প্রতিবন্ধীকে ভাতা প্রদান করবে। আজ মঙ্গলবার সকালে বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবসের এক অনুষ্ঠানে তিনি এই কথা বলেন।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ১২তম বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস-২০১৯ উপলক্ষে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। প্রধানমন্ত্রী এতে প্রধান অতিথির ভাষণ দেন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২ এপ্রিলকে বিশ্বব্যাপী অটিজম সচেতনতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য: ‘সহায়ক প্রযুক্তির ব্যবহার অটিজম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ব্যক্তির অধিকার’।
‘আগামী বাজেট থেকে দেশের যত প্রতিবন্ধী রয়েছে, তাদের আমরা ভাতা প্রদান করব, ইনশা আল্লাহ’ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বর্তমানে সরকার ১০ লাখ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে মাসিক ৭০০ টাকা হারে ভাতা দিচ্ছে। সেন্সাস রিপোর্ট অনুযায়ী দেশে এখন ১৪ লাখ প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী রয়েছে। তারা ভবিষ্যতে ভাতার আওতায় আসবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, অটিজমে আক্রান্ত শিশুরা সুস্থ পরিচর্যা পেলে স্বাভাবিকভাবে জীবনে সবার সঙ্গে মিলে চলতে পারবে। অটিজমে আক্রান্ত শিশুরা কোনো একটি বিশেষ ক্ষেত্রে পারদর্শী হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এদের মধ্যে যে সুপ্ত জ্ঞান ও প্রতিভা থাকে, সেটাকেও কাজে লাগাতে হবে।
শেখ হাসিনা প্রতিবন্ধীদের মেধাকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রেও সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘তাদের আপনারা যদি একটু কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেন, তাহলে তাদের জীবনটাও অর্থবহ হয়। তারা যতটুকু সুযোগ পায়, সেটাকে কাজে লাগাতে পারে।’
প্রতিবন্ধীদের জন্য তাঁর সরকার এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় আধা ঘণ্টা সময় বাড়িয়ে দিয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা যতটা সময় পায়, তার থেকে প্রতিবন্ধীরা একটু বেশি সময় পায় এই জন্য যে তারা যেন পরীক্ষাটা ঠিকমতো দিতে পারে। কারণ, তারা অন্য সবার মতো একই সঙ্গে লিখে শেষ করতে পারে না।
প্রধানমন্ত্রী ‘মুক্তা পানি’ মিনারেল ওয়াটারের বোতল হাতে নিয়ে অনুষ্ঠানের সবাইকে দেখিয়ে বলেন, ‘এটিও কিন্তু আমাদের প্রতিবন্ধীরাই তৈরি করছে।’ তিনি এই পানি কেনার জন্যও সবার প্রতি আহ্বান জানান।
শেখ হাসিনা প্রতিবন্ধীদের বহুমুখী প্রতিভার উদাহরণ দিয়ে বলেন, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা প্লাস্টিক ও বেত দিয়ে মোড়া তৈরি করছে, নানা সাংসারিক উপকরণ তৈরি করছে। তিনি সুযোগ পেলেই এগুলো সংগ্রহ করেন এবং ব্যবহার করেন বলেও জানান।
প্রধানমন্ত্রী প্রতিবছর দুই ঈদ এবং নববর্ষের জন্য যেসব শুভেচ্ছা কার্ড পাঠান, সেগুলো প্রতিবন্ধীদের চিত্রাঙ্কন থেকেই নির্ধারিত মূল্য দিয়ে সংগ্রহ করা বলেও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, প্রতিবন্ধীদের এই চিত্রাঙ্কন থেকে তৈরি কার্ড দিয়ে তাঁর মেয়ে এবং বিশ্ব অটিজম আন্দোলনের অগ্রপথিক সায়মা ওয়াজেদ হোসেন একটি অ্যালবাম তৈরি করেছেন। যেটি তাঁর সরকার উপহারস্বরূপও বিভিন্ন জায়গায় পাঠাচ্ছে।
মাকে দোষারোপ বন্ধের আহ্বান
অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের জীবনকে অর্থবহ করে তুলতে তাঁর সরকারের বিভিন্ন প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই অটিজম শিশু জন্মানোর ক্ষেত্রে মা-বাবা কারওরই কিছু করার থাকে না। তথাপি আমাদের সমাজে এ জন্য মাকেই যে দোষারোপ করা হয়।’ সেটি বন্ধেরও আহ্বান জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আশা করি, কেউ আর অযথা মাকে কোনোভাবে দোষারোপ করবেন না। কারণ, এতে মায়েরও কষ্ট। আল্লাহ মানুষটাকে এভাবে তৈরি করেছে, কাজেই তাকে অবহেলা করা কোনো সুস্থ মানুষের কাজ নয়।’ ‘প্রতিবন্ধী মানুষগুলোর প্রতি আমাদের আরও সহানুভূতিশীল হওয়া উচিত, আরও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত,’ বলেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রতিবন্ধীদের নিয়ে বিভিন্ন সরকারি উদ্যোগ
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকার সমাজকল্যাণ পরিদপ্তরের মাধ্যমে দেশের ৪৭টি সাধারণ বিদ্যালয়ে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের সমন্বিত শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ করে দেয়। সে সময়ের বাস্তবতায় প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের মূলধারার বিদ্যালয়ে অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে সমন্বিত শিক্ষা কার্যক্রম ছিল প্রগতিশীল, যুগোপযোগী ও কার্যকর একটি পদক্ষেপ।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য তাঁর সরকারের সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার রয়েছে উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘প্রতিবন্ধী জনগণের জন্য যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন ছাড়াও শিক্ষা, কর্মসংস্থান, চলাফেরা, যোগাযোগ সহজ করা এবং তাদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা আমরা গ্রহণ করেছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পিতা–মাতা ও অভিভাবকহীন নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী মেয়েদের জন্য সরকার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৫০ আসনবিশিষ্ট এবং নিউরো-ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী ছেলেদের জন্য বগুড়ায় ৫০ আসনবিশিষ্ট পরিচর্যাকেন্দ্র স্থাপন করেছে। পর্যায়ক্রমে দেশের আটটি বিভাগীয় শহরে বৃহৎ পরিসরে এ ধরনের পরিচর্যাকেন্দ্র স্থাপন করা হবে। আর যখন সম্ভব হবে, তখন প্রত্যেক জেলাতেই এই ধরনের কেন্দ্র করে দেওয়া হবে।
ক্রীড়াক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীদের অবদান
প্রতিবন্ধীদের ক্রীড়াক্ষেত্রে বিশেষ অবদান, বিশেষ করে স্পেশাল অলিম্পিকে প্রতিবারই দেশের জন্য স্বর্ণ জিতে আনায় তাদের কৃতিত্বের উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতীয় সংসদ চত্বরে প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েদের খেলাধুলার জন্য ৪ দশমিক ১৬ একর জমি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অনুকূলে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ঢাকার অদূরে সাভারে প্রায় ১২ একর জমিতে ৪৬৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ইনক্লুসিভ প্রতিবন্ধী স্পোর্টস কমপ্লেক্স স্থাপনের ডিপিপি প্রণয়নের কাজ চলছে।
শেখ হাসিনা বলেন, ঢাকার মিরপুরে ৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৫ তলা মাল্টিপারপাস প্রতিবন্ধী কমপ্লেক্স নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। সেখানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, থেরাপিসহ অন্যান্য সেবা প্রদানের একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। তিনি আরও বলেন, সমন্বিত বিশেষ শিক্ষা নীতিমালার আওতায় ইতিমধ্যে ৬২টি বিশেষ প্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা পড়ালেখার সুযোগ পাচ্ছে। এ জন্য তাঁর সরকার বার্ষিক ২৩ কোটি টাকা বরাদ্দ প্রদান করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ হোসেনের (অটিজম সম্পর্কিত জাতীয় উপদেষ্টা কাউন্সিলের চেয়ারপারসন) কাছ থেকেই প্রথমে এ সম্পর্ক জানতে পারেন এবং তারপর থেকেই এ রোগে আক্রান্তদের সহায়তার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। যার জন্য এখন বাংলাদেশেই শুধু নয়, বিশ্বব্যাপীও এর জন্য সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে।
সমাজকল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদের সভাপতিত্বে স্বাস্থ্য এবং পরিবারকল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালিক, সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী শরিফ আহমেদ এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান রাশেদ খান মেনন অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব জোয়েনা আজিজ অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন।
অটিজমে আক্রান্তদের পক্ষে একজন এসএসসি পরীক্ষার্থী অনুভূতি ব্যক্ত করে অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অটিজমে আক্রান্ত পাঁচটি শিশুকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এবং অটিজম সচেতনতা সৃষ্টিতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনজন ব্যক্তি এবং তিনটি প্রতিষ্ঠানকেও পুরস্কৃত করেন। তিনি অনুষ্ঠানে নীল বাতিও প্রজ্বালন করেন।
প্রধানমন্ত্রী পরে অটিস্টিক শিশুদের পরিবেশনায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও উপভোগ করেন।