শিশুদের জন্য এক উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার দৃঢ় সংকল্প পুনর্ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশকে তিনি এমন সমৃদ্ধ ও উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চান, যেখানে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও অক্ষরজ্ঞানহীনতা থাকবে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ অপরাহ্ণে জাতির পিতার ৯৯তম জন্মবার্ষিকী এবং জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধ প্রাঙ্গণে আয়োজিত শিশু-কিশোর সমাবেশ এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশকে উন্নত সমৃদ্ধিশালী করে এমনভাবে গড়ে তুলব যেখানে আগামীর শিশুদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ থাকবে এবং তারা সুন্দর জীবনের অধিকারী হবে, যে স্বপ্ন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেখেছিলেন।’
জাতির পিতা যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তেমন বাংলাদেশ গড়ে তোলাই তাঁর লক্ষ্য, উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, সবাইকে হারিয়ে ছয় বছর বিদেশে থাকতে বাধ্য হওয়ার পর ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দেশে ফিরেই তিনি এ প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেছিলেন।
লাখো জনতার মাঝে হারানো স্বজন খুঁজে ফেরা বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘আমি দেশবাসী বিশেষ করে টুঙ্গিপাড়া ও কোটালিপাড়ার জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই, তাঁদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার কোনো শেষ নেই এই কারণে যে, এই এলাকাটা (তাঁর নির্বাচনী আসন) আমার দেখার কোনো প্রয়োজনই হয় না। এখানকার সব দায়িত্বই জনগণ নিয়ে নিয়েছে। আমি তিন ভাই হারিয়েছি, কিন্তু পেয়েছি লাখো ভাই।’
মানবসেবাতেই তাঁর এ জীবন উৎসর্গকৃত উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি আমার জীবনটা উৎসর্গ করেছি, আমরা দুটি বোন (শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা) আমাদের জীবনটা উৎসর্গ করেছি জনগণের জন্য, জনগণের কল্যাণে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের জনগণ যদি ভালো থাকে, উন্নত জীবন পায়, সেটাই তাঁদের সবচেয়ে বড় পাওয়া। আর এ জন্যই দেশের জন্য তাঁরা কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে বলেন, ‘এই বাংলাদেশকে গড়ে তুলব উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে। যেন আজকের শিশু আগামী দিনে সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ ও সুন্দর জীবন পায়।’ তিনি বলেন, কখনোই তিনি মৃত্যুভয়ে ভীত নন, বারবারই তাঁর ওপর প্রাণঘাতী আঘাত আসায় তাঁর মনে হয়েছে, তাঁকে হয়তো তাঁর বাবার ভাগ্যই বরণ করতে হতে পারে। কিন্তু সে জন্য তিনি দমে যাননি বা কাজ থেকে কখনো দূরে সরে আসেননি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘সব সময় মনে করেছি আমাকে কাজ করতে হবে। বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে হবে। আর সিদ্ধান্ত নিয়েই আমি আজও পথ চলছি।’
ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশে আজকের শিশুদের ভবিষ্যৎ সুন্দর করে গড়ে তুলতে চান, উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘জাতির পিতা শিশুদের সব সময় ভালোবাসতেন। তাই তাঁর জন্মদিনটি আমরা শিশু দিবস হিসেবেই সব সময় উদযাপন করি।’
প্রধানমন্ত্রী কোটালিপাড়ার সন্তান এবং ক্ষণজন্মা কবি সুকান্তের ছাড়পত্র কবিতার সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলেন, ‘চলে যাব তবু যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ/ প্রাণপণে এ পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল/ এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি/ নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মস্থল টুঙ্গিপাড়ার বিভিন্ন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
বিশিষ্ট সাহিত্যিক এবং বাংলাদেশ শিশু একাডেমীর চেয়ারম্যান সেলিনা হোসেন অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন।
গোপালগঞ্জ মালেকা একাডেমির পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী লামিয়া সিকদারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র আরাফাত হোসেন স্বাগত বক্তৃতা দেয়।
শেখ হাসিনাকে অনুষ্ঠানে গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোখলেসুর রহমান গোপালগঞ্জ জেলা ব্র্যান্ডিং-এর লোগোর একটি রেপ্লিকা উপহার দেন এবং প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা চিঠির ওপর ভিত্তি করে রচিত ‘বঙ্গবন্ধুকে লেখা চিঠি’র মোড়ক উন্মোচন করেন।
অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকে লেখা সেরা চিঠিটি দশম শ্রেণির ছাত্রী সুরাইয়া শারমিন পড়ে শোনায়।
‘আমার কথা শোন’ শীর্ষক একটি ভিডিও চিত্রও প্রদর্শিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী একটি বইমেলার উদ্বোধন করেন এবং বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের আঁকা ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’ শীর্ষক চিত্র প্রদর্শনী পরিদর্শন করেন।
পরে প্রধানমন্ত্রী টুঙ্গিপাড়া এবং কোটালীপাড়ার দুজন দরিদ্র মহিলা কণা বেগম ও তানজিলার নিকট সেলাই মেশিন হস্তান্তর করেন।
প্রধানমন্ত্রী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ৯৯তম জন্মবার্ষিকী এবং জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষে গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসন আয়োজিত সাহিত্য এবং সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের মাঝেও পুরস্কার বিতরণ করেন।
শিশু-কিশোরদের পরিবেশনায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও উপভোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।
জাতির পিতার রাজনীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু আমাদের একটি স্বাধীন দেশ এনে দেওয়ার পাশাপাশি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি এমনভাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, যেখানে শিক্ষা-দীক্ষা, চিকিৎসার সুব্যবস্থা থাকার পাশাপাশি প্রতিটি শিশু তার জীবনমানকে উন্নত করতে পারবে এবং সুন্দর জীবন পাবে।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় আক্ষেপ করে বলেন, ‘যদিও সে কাজ তিনি (বঙ্গবন্ধু) সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি। কারণ ৭৫-এর ১৫ আগস্ট তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। আর এ হত্যাকাণ্ডের মধ্যে তিনি তাঁর পিতাকে হারালেও সমগ্র বাঙালি জাতি তাদের সকল সম্ভাবনাকে হারিয়ে ফেলে।
সত্য সব সময়ই আপন মহিমায় উদ্ভাসিত হয়, উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, সেই সত্য আজ উদ্ভাসিত হয়েছে বলেই আজ দেশের প্রকৃত ইতিহাস দেশের মানুষ যেমন জানতে পারছে, তেমনি সাতই মার্চ জাতির পিতার ঐতিহাসিক যে ভাষণ, ’৭৫-এর পর সারা দেশে নিষিদ্ধ ছিল, যে ভাষণ বাজাতে গিয়ে সংগঠনের অনেক নেতা-কর্মীকে একদা জীবন পর্যন্ত দিতে হয়েছিল, আজ তা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্বের এক অমূল্য দলিল হিসেবে ইউনেসকোর আন্তর্জাতিক প্রামাণ্য দলিলে স্থান করে নিয়েছে। যাতে বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হয়েছে।’
বিশ্বে আড়াই হাজার বছরে মানুষকে উজ্জীবিত করার যত ভাষণ রয়েছে তাঁর মধ্যে সাতই মার্চের ভাষণ শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে স্থান করে নিয়েছে বলেও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
এ সময় জাতির পিতার দূরদর্শিতা এবং স্বাধীনতার পর তাঁর মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে করে যাওয়া ব্যাপক কর্মযজ্ঞের অংশবিশেষ তুলে ধরতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতির পিতা সম্পূর্ণ অবৈতনিক করে দিয়ে যান। তিনি মেয়েদের শিক্ষা মাধ্যমিক পর্যন্ত অবৈতনিক করে দেন এবং শিশুদের অধিকার রক্ষায় ১৯৭৪ সালেই এই বাংলাদেশে শিশু অধিকার আইন প্রণয়ন করেন, যা তখন জাতিসংঘ পর্যন্ত করেনি, তারা করেছে এই ১৯৮৯ সালে।
জাতির পিতার করে যাওয়া শিশু অধিকার আইনের আলোকেই তাঁর সরকার ২০১১ সালে জাতীয় শিশু নীতিমালা প্রণয়ন করেছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এর পাশাপাশি শিশুদের শিক্ষা, খেলাধুলা, শরীরচর্চা, সাংস্কৃতিক চর্চা—সবদিকে যেন তাদের পারদর্শিতা গড়ে ওঠে, সেদিকে তাঁর সরকার দৃষ্টি দিয়েছে এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলে শিশুদের আধুনিক প্রযুক্তি দক্ষতাসম্পন্ন করে গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, তাঁর সরকার দেশের প্রতি জেলায় একটি করে মোট ৬৫টি ভাষা প্রশিক্ষণ ল্যাবসহ ২ হাজার ১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুদের প্রযুক্তি শিক্ষায় দক্ষ করে গড়ে তুলতে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব প্রতিষ্ঠা করেছে।
প্রধানমন্ত্রী এ সময় প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত বিনা মূল্যে পাঠ্যপুস্তক প্রদান, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা এবং দৃষ্টি ও শ্রবণপ্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা পাঠ্যপুস্তক প্রদান এবং তাঁর সরকারের শিক্ষা সম্প্রসারণে বৃত্তি এবং উপবৃত্তি প্রদানের তথ্য তুলে ধরেন।
মাসের শুরুতে প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার মাকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের বৃত্তির টাকা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে এবং ঝরে পড়া বন্ধে স্কুল পর্যায়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং অভিভাবকদের সহযোগিতায় ‘মিড ডে মিল’ বা ‘টিফিন’ প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।
ছোট্ট সোনামণিদের উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতার মানবদরদি চারিত্রিক গুণাবলি তুলে ধরে বলেন, ‘আমার দাদির কাছে গল্প শুনেছি, বাবা ছোটবেলায় খুব মানবদরদি ছিলেন। নিজের বই গরিব শিক্ষার্থী, যারা কষ্ট করে লেখাপড়া করত তাদের মাঝে তিনি বিলিয়ে দিতেন। দূর দূরান্তের শিক্ষার্থীদের নিজের ছাতাটা পর্যন্ত দিয়ে দিতেন। তাদের অনেককেই বাড়িতে নিয়ে আসতেন গোলা থেকে চাল দিয়ে দিতেন আবার অনেক সময় নিজের খাবারটি পর্যন্ত তাদের সঙ্গে ভাগ করে খেতেন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই যে তাঁর মধ্যে (বঙ্গবন্ধু) একটি দানশীল মনভাব, মানুষের জন্য ভালোবাসা সেই ভালোবাসার টানেই তিনি আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে যেতে পেরেছিলেন।’ তাঁর দাদা-দাদি এ জন্য তাঁদের প্রাণপ্রিয় খোকাকে (বঙ্গবন্ধু) কখনো ভর্ৎসনা নয়, বরং উৎসাহ জোগাতেন, বলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা।
জাতির পিতার বড় হয়ে ওঠার পেছনে তাঁর (বঙ্গবন্ধু) মা-বাবার অবদানকে প্রাসঙ্গিকভাবেই এ সময় আলোচনায় তুলে আনেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা (বঙ্গবন্ধু) সারা জীবন যে রাজনীতি করেছেন তাতে আমার দাদা-দাদু সব সময় সমর্থনটা দিয়ে গেছেন এবং আদর যত্ন দিয়ে মানুষ করার পাশাপাশি সেই যুগে কলকাতায় রেখে তাঁকে পড়িয়েছেন।’
বঙ্গবন্ধুর আজন্ম ছায়াসঙ্গী তাঁর সহধর্মিণী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের নৈতিক দৃঢ়তা, দেশের প্রতি পিতার মতোই কর্তব্যবোধ এবং মানুষের জন্য ভালোবাসার বিভিন্ন খণ্ডচিত্রও আলোচনায় তুলে আনেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘আমার মায়ের নিজের কোনো চাহিদা ছিল না, আমার বাবার রাজনীতির পাশে সব সময় ছিলেন। তাঁরও যতটুকু অর্থসম্পদ ছিল, তা বাবাকে দিতেন কারণ বাবা দেশের কাজ করেন, মানুষের কাজ করেন, সেই চিন্তা থেকে। আর সে জন্যই তিনি (বঙ্গবন্ধু) এত বড় আত্মত্যাগ করতে পেরেছিলেন।’