আগরতলা মামলাকে কালিমালিপ্ত করার জন্য পাকিস্তানি শাসকেরা এর সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিল ‘ষড়যন্ত্র’ শব্দটি। কিন্তু এই মামলাই জোয়ার এনে দিল বাঙালির মুক্তির বাসনায়। শেখ মুজিব হয়ে উঠলেন বঙ্গবন্ধু। মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে ফিরে দেখা সেই ঘটনা।
আগরতলা মামলায় আসামিদের বিবৃতি প্রদানের সময় আদালতকক্ষে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে।
যখন স্টুয়ার্ড মুজিবুর রহমান তাঁর ওপর পরিচালিত নিষ্ঠুর নির্যাতনের হৃদয়বিদারক বর্ণনা দিচ্ছিলেন, তখন প্রত্যেক অভিযুক্তের চোখ অশ্রুসিক্ত হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু অকস্মাৎ দাঁড়িয়ে যান এবং মঞ্জুর কাদেরের (সরকারপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি) দিকে আঙুল উঁচিয়ে উচ্চ স্বরে ক্রোধান্বিতভাবে বলেন,
‘মিস্টার মঞ্জুর কাদের, আপনি কি শুনতে পাচ্ছেন?
আমি এর প্রতিশোধ নেব।’
আদালতকক্ষের প্রতিটি লোক হতবিহ্বল হয়ে গেলেন। বিচারকেরা একে অপরের প্রতি তাকালেন এবং মঞ্জুর কাদের ছিলেন নির্বাক।
যে লোকটি রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে অল্প দিনের মধ্যে শাস্তিপ্রাপ্ত হবেন, রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলির দিকে আঙুল উঁচিয়ে তাঁর এই উক্তি ছিল অভাবনীয় এবং অকল্পনীয়।
(সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত) সূত্র: সত্য মামলা আগরতলা, কর্নেল শওকত আলীর (প্রথমা প্রকাশন ২০১১) গ্রন্থ থেকে।
ঢাকা সেনানিবাসের তখনকার সিগন্যালস অফিসার্স মেসে আদালত স্থাপন করা হয়। উত্তর দিকে উঁচু একটা প্ল্যাটফর্মে বিচারকেরা বসতেন।
পশ্চিম দিকের দেয়াল ঘেঁষে অভিযুক্তদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সরকারপক্ষের আইনজীবীরা বসতেন হলের পূর্ব দিকে।
অভিযুক্তদের আইনজীবীরা বসতেন মাঝখানে। তাঁদের পেছনে দক্ষিণ দিকে দর্শনার্থীদের বসার ব্যবস্থা ছিল।
আমরা সেখানেই বসতাম। বিচারকদের ডান দিকে বসতেন সাংবাদিকেরা।
শেখ মুজিবুর রহমান সাহেবকে আমি এই মামলার সময়ই প্রথম দেখলাম। যেদিন প্রথম দেখি, দেখলাম, কাঠগড়ায় একদম সামনে দাঁড়ানো ৪৪-৪৫ বছর বয়সের একজন অসম্ভব সুদর্শন ব্যক্তি।
তাঁকে দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। কোনো ভয় নাই, ডর নাই, নির্বিঘ্ন চিত্ত। তাঁর হাতে একটা পাইপ ধরা, যেন কিছুই হয়নি, এ রকমভাবে সবার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছিলেন।
হঠাৎ আমার শাশুড়ির দিকে চোখ পড়তেই তিনি বলে উঠলেন, ‘আরে বুয়া, আপনি?’
আমার শাশুড়ি বললেন, ‘আমার ছোট ছেলেও তো...।’ তাঁর কথা শেষ হওয়ার আগেই শেখ মুজিব বললেন, ‘আপনার ছোট ছেলে মানে? আমি তো আবু-নূরুকে চিনি। ছোট ছেলে কোনটা?’
এরপর যখন আমার শাশুড়ি হুদাকে শেখ মুজিবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন, তখন তিনি বললেন, ‘ওর বউ কোনটা?’
এরপর শেখ মুজিব আমাকে ডাকলেন। তখন আমি তাঁর সামনে গেলাম। যেতেই তিনি আমার মাথায় হাত দিয়ে বললেন, ‘বউ, তোকে আমি বলি, তুই একটুও ভয় পাবি না, আমাদের কিচ্ছু হবে না। আমরা সবাই নির্দোষ। দেখিস, আমরা সবাই সসম্মানে ছাড়া পাব। একটুও ভয় পাবি না।’
আদালতকক্ষে আমাকে ঢুকতে দেখলেই শেখ সাহেব সব সময় জিজ্ঞেস করতেন ভালো আছি কি না। আর প্রতিবারই দূর থেকে বলতেন,
‘একটুও ভয় পাবি না, কোনো ভয় নাই। ভয় পাবি না।
আমরা সবাই ছাড়া পাব।
’ (সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত) কর্নেল হুদা ও আমার যুদ্ধ, নীলুফার হুদার (প্রথমা প্রকাশন ২০১১) গ্রন্থ থেকে।
‘...যমের মতো জাঁদরেল কালো গাউন পরিহিত তিনজন বিচারপতি এবং সতর্কতাদানকারী বহুসংখ্যক ডিএফআই এবং আইবির লোক ক্ষুদ্র কক্ষটিতে শ্যেনদৃষ্টিতে শেখ সাহেবের দিকে চেয়ে আছেন।
এমন সময় আকস্মিক ডাক, ‘ফয়েজ, এই ফয়েজ!’ একটু পরেই আমার ডান ঊরুতে শেখ সাহেব হাত বাড়িয়ে কিছু একটা দিয়ে খুঁচিয়ে দিলেন।
দেখলাম তাঁর সেই বিখ্যাত পাইপের আঘাত। আমি অন্যদিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বললাম,
‘মুজিব ভাই, কথা বলা মানা। মাথা ঘোরাতে পারছি না। বের করে দেবে।’
তক্ষুনি উত্তর এল যথেষ্ট উচ্চ কণ্ঠে,
‘ফয়েজ, বাংলাদেশে থাকতে হলে শেখ মুজিবের সাথে কথা বলতে হবে।’
তাঁর এই কথা ছিল রাজনৈতিক ও প্রতীকধর্মী। স্তম্ভিত কোর্ট, সমস্ত আইনজীবী ও দর্শকগণসহ সরকারি অফিসাররা তাঁর এই সুস্পষ্টভাবে উচ্চারিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন।
প্রধান বিচারপতি একবার ডান দিকে ঘাড় বাঁকা করে শেখ মুজিব ও অন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দিকে তাকালেন।
কিছুই বললেন না।
(সংক্ষেপিত ও পরিমার্জিত) ‘আগরতলা মামলা’, শেখ মুজিব ও বাংলার বিদ্রোহ, ফয়েজ আহমদের (সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯৪) গ্রন্থ থেকে।