ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তির পর এখন আকাশপথে উড্ডয়ন তথ্য অঞ্চল বা এফআইআর নির্ধারণ করতে চায় বাংলাদেশ। কারণ, ওই এলাকার আকাশসীমায় বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে এই আকাশসীমায় উড্ডয়নের জন্য ভারত ও মিয়ানমারের অনুমতি নিতে হয়। এমনকি ওভার ফ্লাইং চার্জ বা উড্ডয়ন ফি চলে যাচ্ছে ওই দুই দেশের কাছে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশ কয়েক বছর ধরে দুই প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বিষয়টি সুরাহার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। গত বছর মিয়ানমার এফআইআর পরিবর্তনে বাংলাদেশের অনুরোধে সাড়া দিয়েছে। সর্বশেষ গত সোমবার ভারতও এ–সংক্রান্ত চিঠির জবাব দিয়েছে বলে দুই দেশের কূটনৈতিক সূত্র ও বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর কাল বৃহস্পতিবার এক দিনের সফরে ঢাকায় আসছেন। তাঁর এই সফরে ভারতের সঙ্গে এফআইআর পরিবর্তনের প্রসঙ্গটি বাংলাদেশ আলোচনায় তুলতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এখনো এটা বলতে পারছি না। কালকে (আজ বুধবার) কর্মকর্তারা আমাকে বিভিন্ন বিষয়ে ব্রিফিং দেবেন, তখন বলতে পারব এ বিষয়টি ওঠাব কি না।’
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সমুদ্রসীমা নির্ধারণের পরও আকাশসীমার একটা অংশ অন্য দেশের নিয়ন্ত্রণে থাকায় বাংলাদেশ একদিকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে দেশের সীমানার মধ্যে আকাশপথে চলাচল–সম্পর্কিত তথ্য অন্য দেশের কাছে চলে যাচ্ছে।
২০১২ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের এবং ২০১৪ সালে ভারতের সমুদ্রসীমার বিরোধের নিষ্পত্তি হয়। মূলত এর পর থেকে বাংলাদেশ সরকার বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানান, বাংলাদেশ থেকে বঙ্গোপসাগরের ওপর দিয়ে আকাশপথে উড্ডয়নের আন্তর্জাতিক রুটের একটি অংশ কলকাতা এফআইআর ৫০৭ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। দক্ষিণ সুন্দরবন ধরে বাংলাদেশের একটি অংশ কলকাতা এফআইআরের মধ্যে পড়েছে। আর সেন্ট মার্টিনের একটি অংশ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম পড়েছে ইয়াঙ্গুন এফআইআরের অধীনে।
আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (আইকাও) ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, উড়োজাহাজ চলাচলের ক্ষেত্রে এফআইআর হচ্ছে আকাশপথের একটি বিশেষায়িত এলাকা; যার মাধ্যমে ফ্লাইট চলাচলের তথ্য ও সতর্কবার্তা দেওয়া হয়। সাধারণত ছোট দেশগুলোতে একটি এফআইআর থাকে আর বড় আয়তনের দেশগুলোর থাকে একাধিক এফআইআর। যেমন ভারতের কলকাতা ছাড়াও মুম্বাই, দিল্লি, চেন্নাই—তিনটি এফআইআর আছে। মিয়ানমারের আছে দুটি। বাংলাদেশের একটি এফআইআর আছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট) অ্যাডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলম গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ভারত ও মিয়ানমারকে এফআইআর পরিবর্তন ও হালনাগাদ করার প্রস্তাব দিয়ে বাংলাদেশ চিঠি দিয়েছে।
প্রতিবেশী মিয়ানমার এবং ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তির পর ২০১৫ সালে বঙ্গোপসাগরে সীমান্ত বেসলাইন নির্ধারণ করা হয়। এ সময় সরকারের উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠকে একজন কর্মকর্তা প্রথমবারের মতো আকাশপথের চলাচলের বিষয়টি সার্বভৌম করতে এফআইআর সংশোধনের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। তিনি প্রস্তাব করেন, বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখন ভূখণ্ডের সঙ্গে মিলিয়ে সাগরের বুকেও বাংলাদেশের মানচিত্র সমন্বয় করে নেওয়া জরুরি। এ জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ করে আইকাওয়ের (আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ) কাছে আবেদন করতে হবে। তার আগে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে নিতে হবে। কারণ, মানচিত্র অনুযায়ী এফআইআর পরিবর্তন আর হালনাগাদের ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশের সহযোগিতা লাগবে। কেননা, এতে শুধু বাংলাদেশের মানচিত্রের সংশোধন ও পরিবর্তন হলেই চলবে না; ওই দুই দেশেরও বাংলাদেশের অনুরোধে সাড়া দিয়ে তাদের মানচিত্রেও সংযোজন, বিয়োজন করতে হবে।
আমি এখনো এটা বলতে পারছি না। কালকে (আজ বুধবার) কর্মকর্তারা আমাকে বিভিন্ন বিষয়ে ব্রিফিং দেবেন, তখন বলতে পারব এ বিষয়টি ওঠাব কি না।পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন
বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আকাশপথে উড্ডয়নের বিষয়ে সহযোগিতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ, মিয়ানমার, ভারত ও থাইল্যান্ড—এই চার দেশের একটি ফোরামে বাংলাদেশ ২০১৭ সালে বিষয়টি প্রথম তুলতে চেয়েছিল; কিন্তু সেবার তা আলোচ্যসূচিতে ছিল না। ২০১৮ সালে ঢাকায় ওই ফোরামের ষষ্ঠ বৈঠকে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি তোলে। তখন ভারত ও মিয়ানমার বিষয়টি কূটনৈতিক চ্যানেলে তোলার প্রস্তাব দেয়। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে কূটনৈতিকভাবে সুরাহার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কাজ শুরু করে এবং দুই দেশকে চিঠি দেয়। মিয়ানমার গত বছর এ বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাবের কথা জানায়।
গতকাল দিল্লির একটি কূটনৈতিক সূত্র প্রথম আলোকে জানিয়েছে, এফআইআর পরিবর্তনের বিষয়ে বাংলাদেশ যে অনুরোধ জানিয়েছিল, ভারত গত সোমবার তার জবাবে চিঠি দিয়েছে। এখন এ বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে বলেন, ২০১৪ সালে সংশোধনীর প্রস্তাব করার পর বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ নিজেদের সীমিত সামর্থ্যের কথা তুলে সময় চায়। তখন উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠকে জরুরি ভিত্তিতে রাডার কিনে কলকাতা এফআইআরের বিকল্প হিসেবে তিন থেকে পাঁচটি এয়ার রুট (আকাশপথ) নির্ধারণের প্রস্তাব আসে।
বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের ঢাকা ও চট্টগ্রামের রাডারগুলো পুরোনো হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া রাডার দুটি সর্বোচ্চ আড়াই শ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত নেভিগেশন করতে পারে। ফলে বাংলাদেশ নতুন যে সমুদ্রসীমা পেয়েছে, সেখানে এয়ার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের সামর্থ্য বাংলাদেশের নেই। তাই ওই এলাকার আকাশসীমায় আন্তর্জাতিক গন্তব্যের ফ্লাইট থেকে বাংলাদেশ উড্ডয়ন ফি (ওভার ফ্লাইং চার্জ) আদায় করতে পারছে না। সেটা চলে যাচ্ছে ভারত ও মিয়ানমারের কাছে। তবে গত বছরের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে বিষয়টি সুরাহার জন্য সরকার নতুন রাডার স্থাপনসহ স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা চালুর জন্য কাজ শুরু করেছে। এরই মধ্যে রাডার কেনার প্রক্রিয়া এগিয়ে চলেছে এবং জনবল নিয়োগের প্রস্তুতি চলছে। জনবল প্রশিক্ষিত করার পর আইকাওয়ের কাছে বাংলাদেশ এফআইআর পরিবর্তনের আবেদন জানাবে।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, বাংলাদেশ গত বছর মিয়ানমারকে এফআইআর পরিবর্তনের বিষয়ে একটি মানচিত্র দিয়েছে। মোটামুটি ৪৬ বর্গকিলোমিটারের একটি এলাকা ছাড়া বাকি অংশ পরিবর্তনের প্রস্তাবে আপত্তি না থাকার কথা জানিয়েছে মিয়ানমার।
কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, দুই প্রতিবেশীর সঙ্গে সমুদ্রে বাংলাদেশের সীমা চূড়ান্ত হওয়ার পর আকাশসীমার বিষয়টিরও দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া জরুরি। কেননা, এর সঙ্গে দেশের সার্বভৌমত্ব এবং নিরাপত্তার প্রশ্নও জড়িত।