মাতৃভাষার দাবিতে বায়ান্নয় রাজপথে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিল বাঙালি। সে সময়ে যাঁরা যুক্ত ছিলেন সেই আন্দোলনে, তাঁদের নিজ চোখে দেখা ঘটনা।
২০ ফেব্রুয়ারির সন্ধ্যাটা আমার কাছে খুব থমথমে মনে হয়েছিল। কী রকম একটা বিপৎসংকেতের মতো শোনাচ্ছিল সরকারি গাড়ি থেকে ১৪৪ ধারা জারির সংবাদ পরিবেশনটি। যখন শুনলাম সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিপক্ষে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তখন আমরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হই। রাত ৯টা-১০টার সময় আমরা সাত-আটজন বন্ধুবান্ধব মিলিত হই ফজলুল হক হলের পুকুরের পূর্ব পাড়ে। যত দূর মনে পড়ে, সেখানে মোহাম্মদ সুলতান, আবদুল মতিন, জিল্লুর রহমান, কামরুদ্দীন আহমদ, গাজীউল হক, আনোয়ারুল হক খান ও এম আর আখতার মুকুল উপস্থিত ছিলেন। অনেক পরে শুনেছি যে ওই বৈঠকে একজন গুপ্তচরও উপস্থিত ছিলেন।
ওই সভায় একটা প্রশ্ন ওঠে, বিনা প্রস্তুতিতে ১৪৪ ধারা ভেঙে অযথা শক্তিক্ষয় করা হবে কি না। অবশেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, ১৪৪ ধারা ভাঙতে হবে এবং আন্দোলন বন্ধ করা চলবে না। আমরা কেমন করে আইন অমান্য করব, তার কোনো স্পষ্ট ছবি তখন আমাদের মনে ছিল না। তরুণ মনে এই আশা ছিল যে একবার ১৪৪ ধারা ভাঙলে বেশির ভাগ ছাত্রই স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসবে আন্দোলনকে জোরদার করার জন্য।
পরদিন সকালে আমি আর মোহাম্মদ সুলতান জগন্নাথ কলেজ ও পার্শ্ববর্তী কয়েকটি স্কুলে গেলাম ধর্মঘট কেমন চলছে দেখার জন্য। নবাবপুরে আওয়ামী লীগের অফিসে একবার ঢুঁ মেরে দেখলাম, ১৪৪ ধারা ভাঙা উচিত হবে কি না, এ নিয়ে বেশ কথাবার্তা চলছে। শহরে তখন একটা উত্তেজনার ভাব। আর্টস বিল্ডিংয়ে ফিরে এসে দেখি মিটিং শুরু হয়েছে। গাজীউল হক দুহাত তুলে সভা পরিচালনার চেষ্টা করছেন। আওয়ামী লীগ সেক্রেটারি শামসুল হক সাহেব নিজের অনেক কথা বলে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিরোধিতা করলেন। এমন সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের কনভেনার আবদুল মতিন সাহেব অত্যন্ত প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের সঙ্গে প্ল্যান দিলেন যে একসঙ্গে ১৪৪ ধারা ভাঙলে পুলিশ লাঠিচার্জ করতে পারে। সুতরাং ১০ জন ১০ জন করে ছোট ছোট দল এগিয়ে যাবে ১৪৪ ধারা ভাঙার জন্য। গাজীউল হক সেই প্ল্যানকে সভার সিদ্ধান্ত হিসেবে ঘোষণা করলেন। উত্তেজনায় জমায়েত ফেটে পড়ল। ভাইস চ্যান্সেলর মোয়াজ্জেম হোসেন সাহেব সবাইকে একবার শান্ত করার চেষ্টা করলেন।
আইন ভাঙার প্ল্যানে এমন একটা অতর্কিত ভাব ছিল যে অনেকে ভালো করে বুঝতে পারল না কী করতে হবে। আগের রাতে যাঁদের মধ্যে আইন ভাঙার ব্যাপারে একটু ইতস্তত ভাব ছিল, দেখলাম, তাঁদের সেই দোটানা ভাব কখন কেটে গেছে। পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছাড়বে বলে অনেকে রুমাল ভিজিয়ে নিল। ভিড়ের মধ্যে আমিও আমার রুমালটা ভিজিয়ে নিলাম। তার জন্য মনে কেমন যেন একটা লজ্জা হচ্ছিল। প্রক্টরের গেটের কাছে ক্রমশ ভিড় জমছে, কিন্তু রাস্তায় বের হওয়ার কোনো উৎসাহ দেখা যাচ্ছে না। চতুর্দিকে একটা বিশৃঙ্খলার ভাব। কেউ কারও কথা শুনছে বলে মনে হচ্ছে না। আমি দেখলাম, আমাদের আগের দিনের প্ল্যান প্রায় ভেস্তে যাওয়ার জোগাড়। হঠাৎ করে আমার মনে হলো, আমরা কয়েকজন যদি গেটের বাইরে গিয়ে ১৪৪ ধারা ভাঙি, তবে কেমন হয়। আমাকে ১৪৪ ধারা ভাঙতে হবে, এমন কোনো পূর্বসিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল বলে আমার মনে নেই। আমি যেহেতু আগের দিন ১৪৪ ধারা ভাঙার ওপর জোর দিই, সে জন্য বন্ধুদের একটা প্রত্যাশা ছিল যে আমি প্রথমে ১৪৪ ধারা ভাঙার জন্য এগিয়ে যাব।
যাঁরা ১৪৪ ধারা ভাঙার জন্য এগিয়ে এলেন, মোহাম্মদ সুলতান তাঁদের নাম লিখে দিলেন। আমি তাঁকে বললাম, ‘তুই আমার পঙ্খিরাজটা (সাইকেল) দেখিস, আমি চললাম।’ গলা ফাটিয়ে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে গেলাম কয়েকজনকে সঙ্গে করে। তখন বেলা সোয়া একটা। উত্তেজনায় সারা গা থেকে তখন আগুনের ভাপ বেরোচ্ছে। প্রথমে পুলিশ আমাদের ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে এবং পরে রাস্তার এক ধারে ঘেরাও করে রাখে।
আমরা এগিয়ে যাওয়ার পর যখন অন্য ছাত্ররা গেট পার হয়ে রাস্তায় নামতে শুরু করল, তখন আমাদের কয়েকজনকে পুলিশ একটা ট্রাকে তুলে নিল। ট্রাকটা যখন তেজগাঁওয়ের দিকে চলতে শুরু করল, তখন মনের অবস্থা হালকা করার জন্য আমি বললাম, ‘দূরে কোথাও কোনো মজাপুকুরে আমাদের চ্যাংদোলা করে ছুড়ে ফেলা হবে।’
ট্রাকটা চলার সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডা হাওয়ায় মানসিক উত্তেজনা কিছু কমল, কিন্তু দুর্ভাবনা বাড়তে থাকল। অবশেষে আমাদের তেজগাঁও পুলিশ স্টেশনে হাজির করা হলো। (সংক্ষেপিত)
● সূত্র: একুশের সংকলন: স্মৃতিচারণ, বাংলা একাডেমি, ১৯৮০
● মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান: প্রয়াত সাবেক প্রধান বিচারপতি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা।