পরিবেশ রক্ষা

আইন-আদালত আছে, নেই মামলা

রাজধানীর চারপাশের নদ–নদীগুলোর পানি শিল্পবর্জ্যের দূষণে কালো কুচকুচে। এই পানিতে মাছ বাঁচে না। বিশ্বের যেসব শহরের বায়ু সবচেয়ে দূষিত, তার একটি ঢাকা। শব্দদূষণে রাজধানীর বাসিন্দাদের অনেকেই কানে কম শোনার সমস্যায় ভোগেন। দখলে দখলে ঢাকার জলাশয়-খাল বিলীনের পথে। প্রকাশ্যেই বিক্রি হয় নিষিদ্ধ পলিথিন।

সার্বিকভাবে ঢাকার পরিবেশদূষণের এই যখন চিত্র, ঠিক বিপরীত ঘটনা পরিবেশ আদালতে। দেশে তিনটি পরিবেশ আদালতে মামলার সংখ্যা খুবই কম। পরিবেশবিষয়ক মামলার জন্য নির্দিষ্ট আদালতে তাই চলছে অন্য মামলার বিচার।

সব মিলিয়ে দেশের তিনটি পরিবেশ আদালতে এখন মামলা আছে ৭ হাজার ২ টি। এর মধ্যে মাত্র ৩৮৮টি বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫–এর অধীনে করা মামলা, যা মোট সংখ্যার মাত্র সাড়ে ৫ শতাংশ। অবশ্য অধিদপ্তরের আগ্রহ বেশি ভ্রাম্যমাণ আদালতে। ২০১৫ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের আগস্ট পর্যন্ত সময়ে পরিবেশ অধিদপ্তর ভ্রাম্যমাণ আদালতে মামলা করেছে ৮ হাজার ৭৫৬ টি। জরিমানা করা হয়েছে প্রায় ৫৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে আদায় করা হয়েছে প্রায় ৪৬ কোটি ৫৪ লাখ টাকা।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিযোগ, পরিবেশ অধিদপ্তর মামলা করে দূষণ ও দখলকারীদের কঠোর সাজা নিশ্চিতে আগ্রহী নয়। তারা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে যে জরিমানা করে, তার বড় অংশ আবার আপিল করে ছাড় পান দূষণকারীরা। সব মিলিয়ে দূষণ-দখল পরিস্থিতির উন্নতি হয় না।

যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির পরিবেশ রক্ষায় পারদর্শিতা সূচক-২০২০ অনুযায়ী, বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে পরিবেশ সুরক্ষায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৬২ তম। শিল্পায়নের দিক দিয়ে এগিয়ে থাকা দেশ থাইল্যান্ড, চীন ও ভিয়েতনাম এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। এমনকি পাকিস্তান ও নেপাল সূচকে বাংলাদেশের ওপরে। ভারত অবশ্য বাংলাদেশের পেছনে রয়েছে। পরিবেশসংক্রান্ত ১১টি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে সূচকটি তৈরি করা হয়।

পরিবেশ আদালতে মামলা কেন কম, সে বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক হুমায়ুন কবির সম্প্রতি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিবেশ আদালতে কেন কম মামলা দেওয়া হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখা হবে।’

কোন আদালতে কত মামলা
ঢাকার পরিবেশ আদালতের কার্যক্রম শুরু হয় ২০০৩ সালে। ঢাকা অঞ্চলের জন্য দুটি পরিবেশ আদালত রয়েছে। তার মধ্যে একটি মূল আদালত, অন্যটি আপিল আদালত। আদালত সূত্র জানায়, মূল পরিবেশ আদালতে বর্তমানে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ২ হাজার ৭৯৬। এর মধ্যে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে করা মামলার সংখ্যা মাত্র ১১৭ টি, যা মোট মামলার মাত্র ৪ দশমিক ১৮ শতাংশ। এর বাইরে ফৌজদারিসহ অন্যান্য নিয়মিত মামলার বিচার হয় এই আদালতে।

সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঢাকার পরিবেশ আদালতে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে পাঁচটি মামলা বিচারের জন্য পাঠানো হয়েছে। গত বছর পাঠানো হয় ২৯ টি। এর আগে ২০১৬ সালে ৪ টি, ২০১৭ সালে ৬ টি, ২০১৮ সালে ১৯টি এবং ২০১৯ সালে ৩টি মামলা পাঠানো হয়েছিল।

১০ বছর আগে ২০১১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর হাজারীবাগের বছিলা সেতুর পশ্চিম পাশে বুড়িগঙ্গা নদী থেকে বালু তুলে তীর দখলের অভিযোগে পাঁচটি বুলডোজার জব্দ করে পরিবেশ অধিদপ্তর। এ ঘটনায় পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করা হয়। এত দিনেও পরিবেশ অধিদপ্তর আদালতে কোনো তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়নি।

ঢাকার পরিবেশ আদালতে কর্মরত সরকার নিযুক্ত কৌঁসুলি (পিপি) ফিরোজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে এই আদালতে একেবারেই কম মামলা দেওয়া হয়। পরিবেশ অধিদপ্তর নিজেরা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে থাকে। যে কারণে আদালতে তাদের মামলার সংখ্যা কম।

ঢাকার জজকোর্টে অবস্থিত পরিবেশ আপিল আদালতে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ১১টি মামলা বিচারাধীন। এর বাইরে ওই আদালতে অন্য মামলা বিচারাধীন আছে ২ হাজার ২০৬ টি। এর মানে হলো, আপিল আদালতে মোট মামলার শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ পরিবেশসংক্রান্ত। এ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি এ এফ এম রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, আপিল আদালতে গত পাঁচ বছরে পরিবেশবিষয়ক মামলা এসেছে মাত্র ১১ টি। সেগুলোই এখন বিচারাধীন।

তৃতীয় পরিবেশ আদালতটি চট্টগ্রামে। ওই আদালত–সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সেখানে প্রায় দুই হাজার মামলার মধ্যে পরিবেশসংক্রান্ত মামলা আছে ২৬০ টি। শতকরা হিসাবে যা ১৩ শতাংশ। অভিযোগ আছে, এ আদালতেও ঠিক সময়ে তদন্ত প্রতিবেদন জমা না দেওয়া এবং সাক্ষী হাজির না করায় মামলা ঝুলে থাকে। চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবেশ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের জনবল কম। পাহাড় কাটাসহ পরিবেশসংক্রান্ত অপরাধে পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়। এ জন্য নিয়মিত মামলা কম।

তদন্তে বিলম্ব, সাক্ষী আসেন না
ঢাকার পরিবেশ আদালতে বছরের পর বছর মামলা অনিষ্পন্ন অবস্থায় পড়ে থাকে। যেমন প্রায় ১৭ বছর আগে ২০০৪ সালের ২৪ জুলাই নিষিদ্ধ পলিথিনসহ দুই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ ঘটনায় করা মামলার অভিযুক্ত দুই আসামি মো. শাহীন ও আসাদুলের বিরুদ্ধে দুই বছর পর অভিযোগ গঠন করা হয়। মামলাটিতে ১৭ জন সাক্ষীর একজনকেও হাজির করা হয়নি।

১০ বছর আগে ২০১১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর হাজারীবাগের বছিলা সেতুর পশ্চিম পাশে বুড়িগঙ্গা নদী থেকে বালু তুলে তীর দখলের অভিযোগে পাঁচটি বুলডোজার জব্দ করে পরিবেশ অধিদপ্তর। এ ঘটনায় পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করা হয়। এত দিনেও পরিবেশ অধিদপ্তর আদালতে কোনো তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়নি।

বিদ্যমান পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে পরিবেশ অধিদপ্তরকে নির্বাহী ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আদালত থাকার পরও এ ধরনের আইনি ক্ষমতা বিচারপ্রক্রিয়ার মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ আইনে ভারসাম্য আনা দরকার।
ফওজুল আজিম, আইন কমিশনের মুখ্য গবেষক

যথাসময়ে তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা না দেওয়া প্রসঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (আইন) খোন্দকার মো. ফজলুর হক প্রথম আলোকে বলেন, পরিবেশ আদালতে মূল সমস্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন সময়মতো না যাওয়া। আগে এসব প্রক্রিয়ায় অনেক সময় লাগত। তবে এখন নিয়মিত তদারকি ও যথাসময়ে প্রতিবেদন দেওয়ার কাজ চলছে।

একই চিত্র চট্টগ্রাম পরিবেশ আদালতেও। ২০০৯ সালে কক্সবাজারে কারেন্ট জাল দিয়ে সাগরে জাটকা ধরার অভিযোগে করা মামলাটি চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিবেশ আদালতে বিচারাধীন। এই মামলায় সাক্ষী রয়েছেন ১২ জন। কিন্তু এখনো একজন সাক্ষীর সাক্ষ্যও হয়নি। আদালত থেকে সাক্ষীদের ধার্য দিনে হাজিরার জন্য সমন পাঠানো হলেও তাঁদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অপর দিকে মামলার দুই আসামির মধ্যে মো. আলী জামিনে। শুরু থেকে পলাতক রয়েছেন মো. সেলিম।

চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার হাশিমপুর এলাকায় মেসার্স বিঅ্যান্ডবি ব্রিকস নামের একটি ইটভাটার বিরুদ্ধে ২০১২ সালে করা মামলার বিচারও আটকে আছে।

কারাদণ্ড কম, অর্থদণ্ড বেশি
ঢাকার পরিবেশ আদালতের সাধারণ নিবন্ধন খাতার তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের মামলায় কারাদণ্ড কম। বেশির ভাগ মামলায় আদালত আসামিদের আর্থিক দণ্ড দিয়েছেন। গত ১০ বছরে নিষ্পন্ন হওয়া ২০০ মামলার মধ্যে ১৪৭টি মামলার আসামিকে বিভিন্ন অঙ্কের অর্থদণ্ড দিয়েছেন আদালত। আর ২৯টি মামলার আসামি অব্যাহতি পেয়েছেন। ২৪টি মামলায় আসামি খালাস পেয়েছেন।

কেবল পরিবেশ আদালতেই নয়, পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সারা দেশে যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়, সেখানেও অর্থদণ্ড বেশি দেওয়া হয়। কারাদণ্ডের মতো সাজা দেওয়ার সংখ্যা কম। পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, গত পাঁচ বছরে দেশে ৪ হাজার ৪৪০টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে কারাদণ্ড দেওয়া হয় মাত্র ১৬৬ জনকে। অবৈধ পলিথিন জব্দ, অবৈধ ইটভাটা, কালো ধোঁয়া, শব্দদূষণ, পাহাড় কাটা, জলাশয় ভরাট, নির্মাণসামগ্রী দিয়ে পরিবেশদূষণসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে এ অর্থদণ্ড ও কারাদণ্ড দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।

আইন কমিশনের মুখ্য গবেষক ফওজুল আজিম দীর্ঘদিন পরিবেশ আদালতের বিচারক ছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যমান পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে পরিবেশ অধিদপ্তরকে নির্বাহী ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। আদালত থাকার পরও এ ধরনের আইনি ক্ষমতা বিচারপ্রক্রিয়ার মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ আইনে ভারসাম্য আনা দরকার। তিনি বলেন, নির্বাহী ক্ষমতা কমিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরে অভিযোগ জানানোর জন্য থানার মতো একটি ব্যবস্থা রাখতে হবে। কেউ অভিযোগ দিলে তা লিপিবদ্ধ করে আদালতে পাঠাবে অধিদপ্তর।

সরাসরি মামলা করা যায় না
বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, পরিবেশ আদালতে সাধারণ মানুষ অথবা পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো সরাসরি মামলা করতে পারে না। কেউ মামলা করতে চাইলে প্রথমে অধিদপ্তরের কাছে অভিযোগ জানাতে হয়। প্রতিকার না পেলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আদালতে মামলা করতে পারেন।

পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ৭ ধারায় বলা হয়েছে, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে যদি প্রতীয়মান হয় যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান আইনের ব্যত্যয় করছেন, তাহলে ক্ষতি নির্ধারণ করে তা পরিশোধের নির্দেশ দিতে পারবেন। ক্ষতিপূরণ না দিলে মহাপরিচালক আদালতে ক্ষতিপূরণ মামলা করতে পারবেন। এ নির্দেশ অমান্য করলে ফৌজদারি মামলা করা যাবে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পরিবেশ আদালতে মামলা কম হওয়ার অন্যতম একটি কারণ সরাসরি মামলার সুযোগ না থাকা। বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন এ জন্য আইন সংশোধনের দাবি করেছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, বিদ্যমান আইনে সংক্ষুব্ধ কোনো ব্যক্তি সরাসরি আদালতে মামলা করতে গিয়ে আমলাতান্ত্রিক বাধার সম্মুখীন হন। এ বাধা দূর করতে হবে। আইন সংশোধনীর মাধ্যমে পরিবেশসংক্রান্ত সব অপরাধের বিচারের ক্ষমতা পরিবেশ আদালতকে দেওয়া জরুরি।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান আরও বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর পরিবেশ রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। দূষণকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। পরিবেশ রক্ষা করতে গেলে অধিদপ্তরকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। তাদের সক্ষমতাও বাড়াতে হবে।