করোনাকালে বাংলাদেশে আইনের শাসনের অবনতি হয়েছে। ২০২১ সালে আইনের শাসনের সূচকে ১৩৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৪তম। দক্ষিণ এশিয়ার ছয়টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট (ডব্লিউজেপি) গতকাল শুক্রবার বৈশ্বিক আইনের শাসন সূচক প্রকাশ করেছে। এই সংস্থার সাবেক সভাপতিদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেডেলিন অলব্রাইট ও কলিন পাওয়েলের মতো ব্যক্তিরা রয়েছেন। সংস্থাটি ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে আইনের শাসনের এই সূচক প্রকাশ করে আসছে। এর আগে গত বছরের মার্চে প্রকাশিত সূচকে বাংলাদেশ ১২৮টি দেশের মধ্যে ১২২তম অবস্থানে ছিল।
সাতটি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আইনের শাসনের এই সূচক করা হয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৫তম, নিয়ন্ত্রণমূলক ক্ষমতার প্রয়োগের দিক থেকে ১২২তম, ফৌজদারি বিচারের দিক থেকে ১১৭তম, দেওয়ানি বিচার পাওয়ার দিক থেকে ১২৯তম, দুর্নীতি না হওয়ার দিক থেকে ১১২তম, জননিরাপত্তায় ১১১তম এবং সরকারি তথ্য প্রকাশের দিক থেকে ১০২তম অবস্থানে রয়েছে। এই বিষয়গুলোর পাঁচটিতেই বাংলাদেশের অবস্থার অবনতি হয়েছে। শুধু জননিরাপত্তা ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ১ লাখ ৩৮ হাজার খানা এবং ৪ হাজার ২০০ জন আইনজীবী ও বিশেষজ্ঞের মতামত নিয়ে এই সূচক করা হয়েছে। বাংলাদেশের এক হাজার খানা (পরিবার) এবং আইন পেশাসংশ্লিষ্ট ১৭ জনের মতামত নেওয়া হয়েছে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আইনের শাসনে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে নেপাল (৭০তম)। এরপরেই শ্রীলঙ্কা (৭৬) ও ভারত (৭৯)। খারাপ অবস্থানের দিক দিয়ে বাংলাদেশের পরেই রয়েছে পাকিস্তান (১৩০) ও আফগানিস্তান (১৩৪তম)। তবে সামগ্রিকভাবে আইনের শাসনের দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার ছয়টি দেশেরই অবস্থার অবনতি হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ভুটান ও মালদ্বীপের বিষয়ে প্রতিবেদনে কিছু বলা হয়নি।
মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইনের শাসন সূচক প্রতিবেদনটি আমাদের নজরে এসেছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির সূচকে যেভাবে এগোচ্ছে, তার সঙ্গে আইনের শাসনের উন্নতি হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমরা তার উল্টো চিত্র দেখতে পাচ্ছি। গত দুই দিনে সারা দেশে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক হামলার মধ্য দিয়ে দেশের আইনের শাসনের অবনতির বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়েছে। আমরা যারা আইনের শাসনের জন্য কথা বলি, তাদেরকে উল্টো উন্নয়নবিরোধী হিসেবে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা চিহ্নিত করেন।’
আইনের শাসনের অবনতি হলে উন্নয়ন টেকসই হবে না বলে মন্তব্য করেন সুলতানা কামাল।
ডব্লিউজেপি সূচকে বাংলাদেশের পরেই রয়েছে উগান্ডা, হন্ডুরাস, জিম্বাবুয়ে ও মিয়ানমার। বিশ্বে করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর প্রথমবারের মতো এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হলো। সেখানে দেখা গেছে, বেশির ভাগ দেশেই আইনের শাসনের অবনতি হয়েছে।
আইনের শাসন সূচকে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে ডেনমার্ক, নরওয়ে ও ফিনল্যান্ড। অপর দিকে আইনের শাসনের সবচেয়ে খারাপ অবস্থা কঙ্গো, কম্বোডিয়া ও ভেনেজুয়েলায়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই সূচকে যেসব দেশ রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে ৭৪ দশমিক ২ শতাংশ দেশেই করোনাকালে আইনের শাসনের অবনতি হয়েছে। এসব দেশে বিশ্বের প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষের বসবাস। এসব দেশের মানুষের সংখ্যা ৬৫০ কোটি।
করোনাকালে আইনের শাসনে সবচেয়ে বেশি উন্নতি হয়েছে উজবেকিস্তানে। সবচেয়ে বেশি অবনতি হওয়া দেশগুলোর মধ্যে মিয়ানমার, নাইজেরিয়া, নিকারাগুয়া, চেক রিপাবলিক ও আর্জন্টিনা।
ডব্লিউজেপির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিল নিউকম বলেন, ‘এবারের আইনের শাসন সূচকে এত বেশিসংখ্যক দেশে নেতিবাচক প্রবণতা দেখা গেছে যে তা আমাদের সবার জন্য একটি সতর্কবার্তা।’ তিনি বলেন, ‘প্রতিটি দেশের মানুষের ন্যায়বিচার, সুযোগ প্রাপ্তি ও শান্তির মৌলিক ভিত্তি হলো আইনের শাসন। বৈশ্বিক মহামারি থেকে পুনরুদ্ধারের যে সময় আমাদের সামনে অপেক্ষা করছে, সেখানে এই মৌলিক ভিত্তিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।’